বিশ্বজুড়ে শিক্ষার সংকট by মাছুম বিল্লাহ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অস্ত্র খাতে
বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। অথচ শিক্ষার দিক দিয়ে এই দেশগুলো বিশ্বে পিছিয়ে আছে।
নতুন এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস
রিসার্চ ইন্সটিটিউট (সিপরি) প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, গত পনেরো বছরে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অস্ত্র খাতে বিনিয়োগ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮
সালে দেশগুলোর অস্ত্র খাতে বার্ষিক গড় বিনিয়োগ ছিল চার হাজার কোটি মার্কিন
ডলার, বর্তমানে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যখন অস্ত্র খাতে বিনিয়োগের গতি বাড়িয়েছে,
গণতান্ত্রিক দেশগুলো তখন মনোযোগী হয়েছে অন্যদিকে। অনেক দেশ অস্ত্র কেনা
কমিয়েছে। কেউবা অস্ত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ আগের পর্যায়ে রেখেছে। অস্বচ্ছ ও
অগণতান্ত্রিক ধারার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শিক্ষা খাতে সরকারি
বিনিয়োগের তুলনামূলক চিত্র আঁকা কঠিন। অবশ্য সীমিত পর্যায়ের উপাত্তে দেখা
যায়, শুধু উন্নত বিশ্বের চেয়ে নয়, গড়ে সারা বিশ্বের শিক্ষা বিনিয়োগের
সূচকেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পিছিয়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ে
যাচ্ছে। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে একবার
চীন সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা
বিশ্লেষণের পর চীন সরকার তার কাছে পরামর্শ চেয়েছিল, এই পরিস্থিতিতে তাদের
এখন বৈশ্বিক মণ্ডলে আর কী করা দরকার। তিনি বলেছিলেন, চীনের এখন দরকার
অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের মতো বহু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা।
বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বে শিক্ষা খাতে গড় বিনিয়োগ জাতীয় বাজেটের পাঁচ শতাংশ। ইউরোপীয় দেশগুলো এ খাতে জাতীয় বাজেটের ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে। তুরস্ক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখে ৪.২ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের বাকি সব দেশ শিক্ষা খাতে এর চেয়ে কম বরাদ্দ রাখে। উদাহরণস্বরূপ মিসরে জাতীয় বাজেটের ৩.৮ শতাংশ, ইরানে ৩.৬ শতাংশ, বাহরাইনে ২.৬ শতাংশ এবং লেবাননে মাত্র ২.২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয় শিক্ষা খাতে। তবে ব্যতিক্রম ওমান। এখানে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ৪.৩ শতাংশ। অস্ত্র ও শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগের এই অসামঞ্জস্য থেকেই বোঝা যায়, কেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশেও গণতন্ত্র নেই।
শিক্ষকতায় বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, কারণ যে দেশের শিক্ষক যতটা গুণী, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততটাই ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকদের প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা, শিক্ষক নিয়োগ ও ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, শিক্ষক রাজনীতি ও তাদের কারও কারও দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এগুলোর সবকিছুই শিক্ষার প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মানের বিষয়টিতে তেমন কোনো অর্থবহ আলোচনা শোনা যায় না আমাদের দেশে। অর্থাৎ সংকট আমার দেশেও অন্যরকম।
২০১৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কোর ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে (ওয়ানটেড : ট্রেইন্ড টিচার্স টু এনশিয়ুর এভরি চাইল্ডস রাইট টু প্রাইমারি এডুকেশন)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯৩টি দেশে শিক্ষক ঘাটতি চরমে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শ্রেণীকক্ষে আরও ৪০ লাখ শিক্ষক প্রয়োজন। তার সঙ্গে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষার মান নিশ্চিত করাও। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটি শিশু পড়া বা লেখার মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ বলে জানাচ্ছে ইউনেস্কো। সংস্থাটি তাই বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ২০১৫-উত্তর উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করছে, তখন শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। শিক্ষকের উন্নয়ন দেশের জন্য কেন একটি বিনিয়োগ? ইউনেস্কোর যুক্তি হচ্ছে আজকের শিশু প্রাপ্তবয়সে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা যেহেতু কারও পক্ষে আগাম বলে দেয়া সম্ভব নয়, সেহেতু আজ এবং আগামীকালের শিক্ষকদের এমন জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রয়োজন যা তাদের ভবিষ্যতের প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার বহুমুখী চাহিদা মেটানোর যোগ্য করে তুলবে। কিন্তু তাদের হিসাবে ২৫ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি শিশু চার বছর স্কুলে কাটানোর পরও যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। আবার এসব শিশুর তিন-চতুর্থাংশই দক্ষিণ এশিয়ার। এই বিপুলসংখ্যক শিশুর পড়া, লেখা বা গণনা করার মতো জ্ঞানের অভাবকে তারা বলছেন শিক্ষণের সংকট বা লার্নিং ক্রাইসিস।
সবার জন্য শিক্ষার বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীদের অন্যতম একজন গবেষক, নিহান কসেলেচি বলেন, আমরা সমস্যা দেখছি শিক্ষার গুণগত মানে, শিক্ষকদের গুণগত মানে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে নেই। কসেলেচি আরও বলেছেন, আপনি ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত যদি বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ভালো হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের অনুপাত ভালো নয়। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। (সূত্র : জাতিসংঘ রেডিও, ১৪ অক্টোবর ২০১৪)। ইউনেস্কোর ২০১৪ সালের প্রকাশিত এই সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় যেসব দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কম, সে রকম ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্দশ। রিপোর্টটিতে ২০১২ সালের যে পরিসংখ্যান সংকলন করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার ৬০ শতাংশের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন বা মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা দেয়ার গুণে গুণান্বিত নন। ফলে শিক্ষকের সংকট যে রয়েছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। এটি তো সর্বজনবিদিত সত্য, প্রশিক্ষণবিহীন একজন শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে উপযুক্ত এবং কাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শন করতে পারেন না। শিশুদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ও অন্যান্য মানসিক চাহিদা পূরণে অক্ষম তিনি। অর্থাৎ তিনি যে শিক্ষাদান করবেন তা হবে আংশিক এবং অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর। শিক্ষণের সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা। ব্রিটেনেও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে রাজনীতিবিদরা প্রতিবছরই বিতর্ক করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি তারা চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার মান নিয়ে তুলনা করেন। তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে চীনা ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অংকে এত ভালো কেন। আমরা কাদের সঙ্গে তুলনা করছি? আমরা কারও সঙ্গে তুলনা করছি না, নিজেরাই দাবি করছি যে, আমরা শিক্ষায় খুবই ভালো করছি।
এদিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। দারিদ্র্য, বিজ্ঞানভীতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা না থাকা, মাঠপর্যায়ে বিজ্ঞানাগার ও দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকায় বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিশেষ ইনক্রিমেন্ট ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু করার কথাও ভাবা যেতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষা এখন শহরকেন্দ্রিক, শতকরা আশি ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই বিজ্ঞানাগার। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে শুধু মুখে কথা বললেই হবে না, বাস্তবভিত্তিক চিন্তা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সব পর্যায়ে।
এরপর যদি উচ্চশিক্ষায় আসি তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এত ভঙ্গুর এবং ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থা বিশ্বের আর কোথাও নেই কিছু পিছিয়ে পড়া আফ্রিকান দেশ ছাড়া। এখানকার উচ্চশিক্ষার সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা। শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রমোশন, ভিসি নিয়োগ, পরীক্ষা সবকিছুই রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ একটি পার্টির ছাত্রসংগঠন নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি কীভাবে চলবে। সেখানে কারও কিছু বলার নেই। হয় তাদের অন্যায় আবদার শুনতে হবে, না হয় জীবন দিতে হবে। মানুষের জীবন তো একটিই, তো সে কেন আর কথা বলতে যাবে। অতএব ওইসব ছাত্রনেতা এবং ক্যাডার যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে সেভাবেই চলবে। এর ব্যত্যয় কেউ ঘটাতে পারে না, ঘটানোর সাহসও কারও নেই। বাধ্য হয়ে সাধারণ মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা তাদের পতাকাতলে হাজির হয়, তা না হলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যাবে না। আর তাই তো প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছাত্রলীগ কর্মীদের উদ্দেশে যথার্থই বলেছেন, তোমরা পড়াশোনা করার সময় পাওনা, তোমরা রাজনীতি করছ, দেশের জন্য কাজ করছ, অতএব তোমাদের চাকরির ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। আর গবেষণা? সে তো অনেক আগেই উধাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর শিক্ষকরা গবেষণা করবেনই বা কেন? যেসব শিক্ষক সবকিছু বাদ দিয়ে সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করতে পারেন, তারা তো প্রমোশন, ভালো পজিশন, বিদেশ ভ্রমণ সবকিছুই অতি সহজে বাগিয়ে নিতে পারেন, তাহলে অযথা এত কষ্ট কেন? শিক্ষার এতসব সংকট থেকে আমরা কবে এবং কীভাবে মুক্তি পাব? দেশভেদে সমস্যা এবং সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন ধরনের। কিন্তু আমার দেশে যে সমস্যা চলছে তা থেকে আমরা আসলেই কি রেহাই পাব?
বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বে শিক্ষা খাতে গড় বিনিয়োগ জাতীয় বাজেটের পাঁচ শতাংশ। ইউরোপীয় দেশগুলো এ খাতে জাতীয় বাজেটের ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে। তুরস্ক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখে ৪.২ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের বাকি সব দেশ শিক্ষা খাতে এর চেয়ে কম বরাদ্দ রাখে। উদাহরণস্বরূপ মিসরে জাতীয় বাজেটের ৩.৮ শতাংশ, ইরানে ৩.৬ শতাংশ, বাহরাইনে ২.৬ শতাংশ এবং লেবাননে মাত্র ২.২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয় শিক্ষা খাতে। তবে ব্যতিক্রম ওমান। এখানে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ৪.৩ শতাংশ। অস্ত্র ও শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগের এই অসামঞ্জস্য থেকেই বোঝা যায়, কেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশেও গণতন্ত্র নেই।
শিক্ষকতায় বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, কারণ যে দেশের শিক্ষক যতটা গুণী, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততটাই ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকদের প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা, শিক্ষক নিয়োগ ও ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, শিক্ষক রাজনীতি ও তাদের কারও কারও দলীয় লেজুড়বৃত্তির বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। এগুলোর সবকিছুই শিক্ষার প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে শিক্ষকদের গুণগত মানের বিষয়টিতে তেমন কোনো অর্থবহ আলোচনা শোনা যায় না আমাদের দেশে। অর্থাৎ সংকট আমার দেশেও অন্যরকম।
২০১৪ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কোর ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে (ওয়ানটেড : ট্রেইন্ড টিচার্স টু এনশিয়ুর এভরি চাইল্ডস রাইট টু প্রাইমারি এডুকেশন)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯৩টি দেশে শিক্ষক ঘাটতি চরমে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শ্রেণীকক্ষে আরও ৪০ লাখ শিক্ষক প্রয়োজন। তার সঙ্গে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিক্ষার মান নিশ্চিত করাও। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটি শিশু পড়া বা লেখার মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ বলে জানাচ্ছে ইউনেস্কো। সংস্থাটি তাই বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ২০১৫-উত্তর উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণের কাজ করছে, তখন শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। শিক্ষকের উন্নয়ন দেশের জন্য কেন একটি বিনিয়োগ? ইউনেস্কোর যুক্তি হচ্ছে আজকের শিশু প্রাপ্তবয়সে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা যেহেতু কারও পক্ষে আগাম বলে দেয়া সম্ভব নয়, সেহেতু আজ এবং আগামীকালের শিক্ষকদের এমন জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রয়োজন যা তাদের ভবিষ্যতের প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার বহুমুখী চাহিদা মেটানোর যোগ্য করে তুলবে। কিন্তু তাদের হিসাবে ২৫ কোটির মধ্যে ১৩ কোটি শিশু চার বছর স্কুলে কাটানোর পরও যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক দক্ষতা অর্জন করেনি। আবার এসব শিশুর তিন-চতুর্থাংশই দক্ষিণ এশিয়ার। এই বিপুলসংখ্যক শিশুর পড়া, লেখা বা গণনা করার মতো জ্ঞানের অভাবকে তারা বলছেন শিক্ষণের সংকট বা লার্নিং ক্রাইসিস।
সবার জন্য শিক্ষার বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীদের অন্যতম একজন গবেষক, নিহান কসেলেচি বলেন, আমরা সমস্যা দেখছি শিক্ষার গুণগত মানে, শিক্ষকদের গুণগত মানে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক যথেষ্ট পরিমাণে নেই। কসেলেচি আরও বলেছেন, আপনি ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত যদি বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ভালো হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের অনুপাত ভালো নয়। সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। (সূত্র : জাতিসংঘ রেডিও, ১৪ অক্টোবর ২০১৪)। ইউনেস্কোর ২০১৪ সালের প্রকাশিত এই সর্বসাম্প্রতিক গবেষণায় যেসব দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের পরিমাণ ৭৫ শতাংশের কম, সে রকম ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্দশ। রিপোর্টটিতে ২০১২ সালের যে পরিসংখ্যান সংকলন করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার ৬০ শতাংশের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন বা মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা দেয়ার গুণে গুণান্বিত নন। ফলে শিক্ষকের সংকট যে রয়েছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। এটি তো সর্বজনবিদিত সত্য, প্রশিক্ষণবিহীন একজন শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে উপযুক্ত এবং কাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শন করতে পারেন না। শিশুদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা ও অন্যান্য মানসিক চাহিদা পূরণে অক্ষম তিনি। অর্থাৎ তিনি যে শিক্ষাদান করবেন তা হবে আংশিক এবং অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর। শিক্ষণের সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা। ব্রিটেনেও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে রাজনীতিবিদরা প্রতিবছরই বিতর্ক করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি তারা চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার মান নিয়ে তুলনা করেন। তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে চীনা ও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অংকে এত ভালো কেন। আমরা কাদের সঙ্গে তুলনা করছি? আমরা কারও সঙ্গে তুলনা করছি না, নিজেরাই দাবি করছি যে, আমরা শিক্ষায় খুবই ভালো করছি।
এদিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। দারিদ্র্য, বিজ্ঞানভীতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা না থাকা, মাঠপর্যায়ে বিজ্ঞানাগার ও দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকায় বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিশেষ ইনক্রিমেন্ট ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু করার কথাও ভাবা যেতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষা এখন শহরকেন্দ্রিক, শতকরা আশি ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই বিজ্ঞানাগার। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে শুধু মুখে কথা বললেই হবে না, বাস্তবভিত্তিক চিন্তা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সব পর্যায়ে।
এরপর যদি উচ্চশিক্ষায় আসি তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো এত ভঙ্গুর এবং ক্ষয়ে যাওয়া অবস্থা বিশ্বের আর কোথাও নেই কিছু পিছিয়ে পড়া আফ্রিকান দেশ ছাড়া। এখানকার উচ্চশিক্ষার সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা। শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রমোশন, ভিসি নিয়োগ, পরীক্ষা সবকিছুই রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। বিশেষ একটি পার্টির ছাত্রসংগঠন নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় মোটামুটি কীভাবে চলবে। সেখানে কারও কিছু বলার নেই। হয় তাদের অন্যায় আবদার শুনতে হবে, না হয় জীবন দিতে হবে। মানুষের জীবন তো একটিই, তো সে কেন আর কথা বলতে যাবে। অতএব ওইসব ছাত্রনেতা এবং ক্যাডার যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে সেভাবেই চলবে। এর ব্যত্যয় কেউ ঘটাতে পারে না, ঘটানোর সাহসও কারও নেই। বাধ্য হয়ে সাধারণ মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা তাদের পতাকাতলে হাজির হয়, তা না হলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যাবে না। আর তাই তো প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছাত্রলীগ কর্মীদের উদ্দেশে যথার্থই বলেছেন, তোমরা পড়াশোনা করার সময় পাওনা, তোমরা রাজনীতি করছ, দেশের জন্য কাজ করছ, অতএব তোমাদের চাকরির ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। আর গবেষণা? সে তো অনেক আগেই উধাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর শিক্ষকরা গবেষণা করবেনই বা কেন? যেসব শিক্ষক সবকিছু বাদ দিয়ে সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করতে পারেন, তারা তো প্রমোশন, ভালো পজিশন, বিদেশ ভ্রমণ সবকিছুই অতি সহজে বাগিয়ে নিতে পারেন, তাহলে অযথা এত কষ্ট কেন? শিক্ষার এতসব সংকট থেকে আমরা কবে এবং কীভাবে মুক্তি পাব? দেশভেদে সমস্যা এবং সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন ধরনের। কিন্তু আমার দেশে যে সমস্যা চলছে তা থেকে আমরা আসলেই কি রেহাই পাব?
মাছুম বিল্লাহ : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ও শিক্ষা গবেষক, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক
No comments