নতুন স্নায়ুযুদ্ধে জয়ী হবে কে by এম আবদুল হাফিজ
রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে
একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতা এখন অনস্বীকার্য। শেষ পর্যন্ত কে জিতবে এ
যুদ্ধে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ-বিতর্ক ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীতে এ
মুহূর্তে ৭২০ কোটি মানুষের বাস। তাদের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী শক্তিধর
আমেরিকা একজনকেও যদি সমীহ করে- তিনি হচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভাদিমির
পুতিন। এ ভীতি অকারণ নয়। আজকের বিশ্বে প্রায় প্রতিটি ফ্রন্টেই কৌশলের দৌড়ে
পুতিনই এগিয়ে এবং তা ঈর্ষণীয় সাফল্যের সঙ্গে। তিনি ইতিমধ্যে সিরিয়া,
ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনে সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির রুশবিরোধী কার্যক্রম গুঁড়িয়ে
দিতে সক্ষম হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, রুশরা ঘোড়ার পিঠে জিন স্থাপনে মন্থর;
কিন্তু তা একবার বাঁধা হয়ে গেলে ঘোড়দৌড়ে তারা থাকে সর্বাগ্রে।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে করুণার পাত্রে পরিণত হওয়া মৃতপ্রায় রুশরা প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে আবার ফিনিক্স পাখির মতো ভস্মাবশেষ থেকে জেগে উঠেছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রাশিয়ার অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর রুশরা ধৈর্যের সঙ্গে তার পরিচর্যা করে তাতে পূর্বাবস্থার চেয়েও অধিক প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছে। পুতিনের অনুসৃত নীতি ও কৌশল প্রতিরোধের ও অর্থনৈতিক অবরোধের (Containment and Sanction) পশ্চিমা নীতি অপমানজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের জন্য অনুসৃত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইন রাজনীতির খেলায় পশ্চিমারা নয়, রাশিয়াই থাকবে সুবিধাজনক অবস্থানে। শুধু পরিসংখ্যানেই পুতিন পশ্চিমা শক্তির চেয়ে এগিয়ে নেই, যে কোনো নির্মোহ বিশ্লেষণেও এ যুক্তির সমর্থন মেলে।
পশ্চিমারা যেমন পুতিনকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে, বিদগ্ধ সমাজও তাকে বরমাল্য পরিয়েছে। আশ্চর্য নয় যে, ফোর্বস ম্যাগাজিন দ্বিতীয়বারের মতো পুতিনকে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আখ্যায়িত করেছে। অন্য যে কোনো বিশ্বনেতার চেয়ে পুতিন অনেক ভালো জানেন শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা কীভাবে শক্তি সঞ্চয় করে। এবং তিনি তা আয়ত্ত করেছেন তার কেজিবির অভিজ্ঞতার বদৌলতে।
তিনি আলবৎ জানেন, আমেরিকা তার ক্ষমতার খেলায় ইংরেজদের মতোই টার্গেট দেশগুলোতে অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ বা প্রতিবিপ্লব ঘটায়। বিশেষ করে যেসব দেশে বৈধ ও জাতীয়তাবাদী সরকার অধিষ্ঠিত, সেখানে এটাই ইঙ্গ-মার্কিন কৌশল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ইরান, চিলি, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও ইউক্রেন। জন পারকিনস তার Confessions of An Economic Hit Man গ্রন্থে বলেছেন কীভাবে তার মতো যরঃ সধহ-দের কনসালট্যান্ট হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো হয় সেসব দেশের কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক ও রাজনীতিকদের জোর করে তাদের প্রদর্শিত পথ অবলম্বনে বাধ্য করার জন্য। হিটম্যানরা প্রায় ক্ষেত্রেই সফল হয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলে সেখানে পেশাদার খুনিদের পাঠানো হয় মার্কিন প্রভাব সৃষ্টির পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের অপসারণের জন্য।
সিআইএ প্রেরিত এ ধরনের হিটম্যানরা এতই কার্যকর যে, শুধু তাদেরই প্রচেষ্টায় অনেক দেশ স্রেফ আমেরিকার ব্যানানা রিপাবলিক হিসেবে টিকে থাকে। তারা ব্যর্থ হলে সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে ইঙ্গ-মার্কিনিরা অবাধ্য রাষ্ট্রগুলোয় কোনো না কোনো বাহানায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বহাল রাখতে সামরিক হস্তক্ষেপে প্রবৃত্ত হয়। যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে এবং সীমিত আকারে লিবিয়ায়।
পুতিন তার গোয়েন্দা অভিজ্ঞতার কারণে এও জানেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে রুশ স্বার্থে আঘাত হেনেছে এবং ভবিষ্যতেও হানবে রাশিয়ায় সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে। একসময় পূর্ব জার্মানিতে (যা এখন একীভূত জার্মানির অংশ) কেজিবি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী পুতিন জানেন, হিটম্যানরা রাশিয়ার সর্বত্র ওঁৎ পেতে আছে। এ জন্যই তিনি ইউএসএআইডি এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো কুখ্যাত সংস্থাগুলোকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। কারণ গোয়েন্দা হিসেবে তিনি জানেন, এরা ইঙ্গ-মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের অগ্রগামী দল।
কাউন্টার ইনটেলিজেন্স গোয়েন্দা পেশার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। প্রেসিডেন্ট পুতিন এতেও পারদর্শী বিধায় তিনি রাশিয়ার কোনো রিপাবলিক বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝেন। তার মূল্যায়নে মার্কিনিদের গায়ে পড়ে জর্জিয়া বা ইউক্রেনে রাশিয়ার সঙ্গে টেক্কা দেয়ার উদ্দেশ্য একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানো। প্রসঙ্গত বুঝতে হবে যে, আমেরিকার সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য আসে যুদ্ধ-অর্থনীতি থেকে। অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র বড় বড় যুদ্ধ যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধ থেকে ফায়দা হাসিল করেছে। ওবামার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাওয়ায় তার প্রশাসন এখন ছুতা খুঁজছে কী করে আরেকটি যুদ্ধ বাধিয়ে পরাশক্তিটির জন্য যুদ্ধ-অর্থনীতির ফায়দা নেয়া যায়। রাশিয়াই যদি সে যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তাহলে যুদ্ধ তো ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাই আমেরিকার মিত্র হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধ চায় না, বরং রুশ ভালুককে না খেপিয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস জ্বালানির সুবিধা নিতে চায়।
রাশিয়াও সাবধানে পা ফেলছে ইউক্রেনে। এতে করে মার্কিনিরাও নৈরাশ্যে নিমজ্জিত। ইউক্রেনে রাশিয়াকে ঘায়েল করতে না পারায় হতাশায় ভুগছে আমেরিকা, যাকে একজন চীনা জেনারেল মার্কিন স্ট্র্যাটেজির নিশ্চলতা বলেছেন। আমেরিকার বিপরীতে রাশিয়া যে অসম শক্তির কৌশল প্রয়োগ করতে চায় তা হল এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ, যা শেষ পর্যন্ত আমেরিকার বিশাল অদৃশ্য সাম্রাজ্য ও শক্তির ভিত নাড়িয়ে দেবে। এ স্ট্র্যাটেজির
একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে ডলারের
শক্তিকে খর্ব করতে পারা। রাশিয়া ব্রিকসে (ইজওঈঝ) তার সহ-সদস্যদের সমর্থনে এটি করতে সক্ষম। চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ব্রিকস সদস্যরা ডলারে বাণিজ্য করা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। প্রায় স্থবিরতায় নেমে আসা মার্কিন অর্থনীতিতে এ পদক্ষেপ বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
আমেরিকার অন্তর্নিহিত শক্তি দেশটির যুদ্ধ করার সামর্থ্য। এ বিষয়টিকেই টার্গেট করেছেন পুতিনের অন্যতম উপদেষ্টা সের্গেই গ্রাজিয়েভ। পুতিনের উপদেষ্টারা তাকে একটি সুবিন্যস্ত ডলারবিরোধী মৈত্রীজোট গঠনের সুপারিশ করেছেন, যার সদস্য দেশগুলো তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও ডলার ব্যবহার করবে না। কালক্রমে এ ডলারবিরোধী মৈত্রীজোটই হবে যুদ্ধবিরোধী কোয়ালিশন, যা মার্কিন আগ্রাসনকে বহুলাংশে প্রতিরোধ করতে পারে।
আমেরিকার মৈত্রীবন্ধন থেকে ইউরোপের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সংঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে ইউক্রেন ইস্যু। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতিমধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কারণ উল্লিখিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গত দুদশকে রুশ অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হয়েছে।
অন্যদিকে ব্রিকসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে পুতিনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ভারত ও চীন উভয়েই ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ায় মস্কোর বৈধ অধিকারকে সমর্থন করে। এ সমর্থন রাশিয়াকে পশ্চিমা মৈত্রীজোটের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনে সাহসী করে তুলেছে।
মস্কো মূলত কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের পর একক পরাশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। সম্মুখ সংঘাতে রাশিয়া আমেরিকার সমর শক্তির কাছে নিতান্তই দুর্বল। মস্কোকে তাই কৌশলের সঙ্গে সম্মুখ সমর পরিহার করতে হবে। রাশিয়া করছেও তাই এবং ১০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের নতুন একটি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছে, যার মালিকানা থাকবে ব্রিকসের হাতে। এতে পশ্চিমা ঋণদাতাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি দুই-ই হ্রাস পাবে।
যদিও পুতিন তার দেশ এবং ব্রিকস ব্লকের জন্য সঠিক পদক্ষেপই নিচ্ছেন; কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও বসে নেই এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পশ্চিমা মৈত্রীর গড়ে তোলা সাম্রাজ্য ধসে পড়বে না। তারাও তাদের তাঁবেদার ও জ্বালানি সম্রাট সৌদি আরবকে দিয়ে তেলের মূল্যের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। রাশিয়ার অর্থনীতিতে জ্বালানির প্রভাবকে ক্ষুণœ করতে এখনকার তেলের মূল্য পতন যৌথভাবে তাদেরই সৃষ্টি। ওয়াশিংটন জানে, আমেরিকার শক্তি প্রদর্শন এবং তার বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের পথে একমাত্র বাধা রাশিয়া।
কিন্তু পুতিন একজন জুডো খেলোয়াড়, যার জানা আছে কী করে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করা যায়। পুতিন আরও জানেন, ওয়াশিংটনের ইউনিপোলার মোমেন্ট পেরিয়ে গেছে- তার আর এখন রুশ সামরিক শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জো নেই। পুতিন অপেক্ষায় আছেন কখন একক পরাশক্তি তার সমরশক্তিতে সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমরা যদি ইতিহাসের পাঠ নিয়ে থাকি তাহলে জানার কথা, রুশরা শত্র“কে কখনও আধমরা ছাড়ে না, তাদের পিষ্ট করে। নেপোলিয়ন ও হিটলারের পর এখন হয়তো আমেরিকানদের পালা সেই পরিণতি ভোগ করার।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে করুণার পাত্রে পরিণত হওয়া মৃতপ্রায় রুশরা প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে আবার ফিনিক্স পাখির মতো ভস্মাবশেষ থেকে জেগে উঠেছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রাশিয়ার অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর রুশরা ধৈর্যের সঙ্গে তার পরিচর্যা করে তাতে পূর্বাবস্থার চেয়েও অধিক প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছে। পুতিনের অনুসৃত নীতি ও কৌশল প্রতিরোধের ও অর্থনৈতিক অবরোধের (Containment and Sanction) পশ্চিমা নীতি অপমানজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের জন্য অনুসৃত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইন রাজনীতির খেলায় পশ্চিমারা নয়, রাশিয়াই থাকবে সুবিধাজনক অবস্থানে। শুধু পরিসংখ্যানেই পুতিন পশ্চিমা শক্তির চেয়ে এগিয়ে নেই, যে কোনো নির্মোহ বিশ্লেষণেও এ যুক্তির সমর্থন মেলে।
পশ্চিমারা যেমন পুতিনকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছে, বিদগ্ধ সমাজও তাকে বরমাল্য পরিয়েছে। আশ্চর্য নয় যে, ফোর্বস ম্যাগাজিন দ্বিতীয়বারের মতো পুতিনকে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আখ্যায়িত করেছে। অন্য যে কোনো বিশ্বনেতার চেয়ে পুতিন অনেক ভালো জানেন শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা কীভাবে শক্তি সঞ্চয় করে। এবং তিনি তা আয়ত্ত করেছেন তার কেজিবির অভিজ্ঞতার বদৌলতে।
তিনি আলবৎ জানেন, আমেরিকা তার ক্ষমতার খেলায় ইংরেজদের মতোই টার্গেট দেশগুলোতে অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ বা প্রতিবিপ্লব ঘটায়। বিশেষ করে যেসব দেশে বৈধ ও জাতীয়তাবাদী সরকার অধিষ্ঠিত, সেখানে এটাই ইঙ্গ-মার্কিন কৌশল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ইরান, চিলি, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও ইউক্রেন। জন পারকিনস তার Confessions of An Economic Hit Man গ্রন্থে বলেছেন কীভাবে তার মতো যরঃ সধহ-দের কনসালট্যান্ট হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো হয় সেসব দেশের কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক ও রাজনীতিকদের জোর করে তাদের প্রদর্শিত পথ অবলম্বনে বাধ্য করার জন্য। হিটম্যানরা প্রায় ক্ষেত্রেই সফল হয়। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলে সেখানে পেশাদার খুনিদের পাঠানো হয় মার্কিন প্রভাব সৃষ্টির পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের অপসারণের জন্য।
সিআইএ প্রেরিত এ ধরনের হিটম্যানরা এতই কার্যকর যে, শুধু তাদেরই প্রচেষ্টায় অনেক দেশ স্রেফ আমেরিকার ব্যানানা রিপাবলিক হিসেবে টিকে থাকে। তারা ব্যর্থ হলে সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে ইঙ্গ-মার্কিনিরা অবাধ্য রাষ্ট্রগুলোয় কোনো না কোনো বাহানায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ বহাল রাখতে সামরিক হস্তক্ষেপে প্রবৃত্ত হয়। যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে এবং সীমিত আকারে লিবিয়ায়।
পুতিন তার গোয়েন্দা অভিজ্ঞতার কারণে এও জানেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে রুশ স্বার্থে আঘাত হেনেছে এবং ভবিষ্যতেও হানবে রাশিয়ায় সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে। একসময় পূর্ব জার্মানিতে (যা এখন একীভূত জার্মানির অংশ) কেজিবি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী পুতিন জানেন, হিটম্যানরা রাশিয়ার সর্বত্র ওঁৎ পেতে আছে। এ জন্যই তিনি ইউএসএআইডি এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো কুখ্যাত সংস্থাগুলোকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। কারণ গোয়েন্দা হিসেবে তিনি জানেন, এরা ইঙ্গ-মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের অগ্রগামী দল।
কাউন্টার ইনটেলিজেন্স গোয়েন্দা পেশার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। প্রেসিডেন্ট পুতিন এতেও পারদর্শী বিধায় তিনি রাশিয়ার কোনো রিপাবলিক বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝেন। তার মূল্যায়নে মার্কিনিদের গায়ে পড়ে জর্জিয়া বা ইউক্রেনে রাশিয়ার সঙ্গে টেক্কা দেয়ার উদ্দেশ্য একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানো। প্রসঙ্গত বুঝতে হবে যে, আমেরিকার সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য আসে যুদ্ধ-অর্থনীতি থেকে। অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র বড় বড় যুদ্ধ যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধ থেকে ফায়দা হাসিল করেছে। ওবামার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাওয়ায় তার প্রশাসন এখন ছুতা খুঁজছে কী করে আরেকটি যুদ্ধ বাধিয়ে পরাশক্তিটির জন্য যুদ্ধ-অর্থনীতির ফায়দা নেয়া যায়। রাশিয়াই যদি সে যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তাহলে যুদ্ধ তো ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাই আমেরিকার মিত্র হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধ চায় না, বরং রুশ ভালুককে না খেপিয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস জ্বালানির সুবিধা নিতে চায়।
রাশিয়াও সাবধানে পা ফেলছে ইউক্রেনে। এতে করে মার্কিনিরাও নৈরাশ্যে নিমজ্জিত। ইউক্রেনে রাশিয়াকে ঘায়েল করতে না পারায় হতাশায় ভুগছে আমেরিকা, যাকে একজন চীনা জেনারেল মার্কিন স্ট্র্যাটেজির নিশ্চলতা বলেছেন। আমেরিকার বিপরীতে রাশিয়া যে অসম শক্তির কৌশল প্রয়োগ করতে চায় তা হল এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ, যা শেষ পর্যন্ত আমেরিকার বিশাল অদৃশ্য সাম্রাজ্য ও শক্তির ভিত নাড়িয়ে দেবে। এ স্ট্র্যাটেজির
একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে ডলারের
শক্তিকে খর্ব করতে পারা। রাশিয়া ব্রিকসে (ইজওঈঝ) তার সহ-সদস্যদের সমর্থনে এটি করতে সক্ষম। চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ব্রিকস সদস্যরা ডলারে বাণিজ্য করা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। প্রায় স্থবিরতায় নেমে আসা মার্কিন অর্থনীতিতে এ পদক্ষেপ বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
আমেরিকার অন্তর্নিহিত শক্তি দেশটির যুদ্ধ করার সামর্থ্য। এ বিষয়টিকেই টার্গেট করেছেন পুতিনের অন্যতম উপদেষ্টা সের্গেই গ্রাজিয়েভ। পুতিনের উপদেষ্টারা তাকে একটি সুবিন্যস্ত ডলারবিরোধী মৈত্রীজোট গঠনের সুপারিশ করেছেন, যার সদস্য দেশগুলো তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও ডলার ব্যবহার করবে না। কালক্রমে এ ডলারবিরোধী মৈত্রীজোটই হবে যুদ্ধবিরোধী কোয়ালিশন, যা মার্কিন আগ্রাসনকে বহুলাংশে প্রতিরোধ করতে পারে।
আমেরিকার মৈত্রীবন্ধন থেকে ইউরোপের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সংঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে ইউক্রেন ইস্যু। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতিমধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কারণ উল্লিখিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গত দুদশকে রুশ অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হয়েছে।
অন্যদিকে ব্রিকসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে পুতিনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ভারত ও চীন উভয়েই ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ায় মস্কোর বৈধ অধিকারকে সমর্থন করে। এ সমর্থন রাশিয়াকে পশ্চিমা মৈত্রীজোটের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনে সাহসী করে তুলেছে।
মস্কো মূলত কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের পর একক পরাশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। সম্মুখ সংঘাতে রাশিয়া আমেরিকার সমর শক্তির কাছে নিতান্তই দুর্বল। মস্কোকে তাই কৌশলের সঙ্গে সম্মুখ সমর পরিহার করতে হবে। রাশিয়া করছেও তাই এবং ১০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের নতুন একটি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছে, যার মালিকানা থাকবে ব্রিকসের হাতে। এতে পশ্চিমা ঋণদাতাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি দুই-ই হ্রাস পাবে।
যদিও পুতিন তার দেশ এবং ব্রিকস ব্লকের জন্য সঠিক পদক্ষেপই নিচ্ছেন; কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও বসে নেই এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পশ্চিমা মৈত্রীর গড়ে তোলা সাম্রাজ্য ধসে পড়বে না। তারাও তাদের তাঁবেদার ও জ্বালানি সম্রাট সৌদি আরবকে দিয়ে তেলের মূল্যের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। রাশিয়ার অর্থনীতিতে জ্বালানির প্রভাবকে ক্ষুণœ করতে এখনকার তেলের মূল্য পতন যৌথভাবে তাদেরই সৃষ্টি। ওয়াশিংটন জানে, আমেরিকার শক্তি প্রদর্শন এবং তার বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের পথে একমাত্র বাধা রাশিয়া।
কিন্তু পুতিন একজন জুডো খেলোয়াড়, যার জানা আছে কী করে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করা যায়। পুতিন আরও জানেন, ওয়াশিংটনের ইউনিপোলার মোমেন্ট পেরিয়ে গেছে- তার আর এখন রুশ সামরিক শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জো নেই। পুতিন অপেক্ষায় আছেন কখন একক পরাশক্তি তার সমরশক্তিতে সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমরা যদি ইতিহাসের পাঠ নিয়ে থাকি তাহলে জানার কথা, রুশরা শত্র“কে কখনও আধমরা ছাড়ে না, তাদের পিষ্ট করে। নেপোলিয়ন ও হিটলারের পর এখন হয়তো আমেরিকানদের পালা সেই পরিণতি ভোগ করার।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক
No comments