জিম্বাবুয়ে দিনযাপন- রাইটিং স্টিল by মঈনুস সুলতান
জিম্বাবুয়ের মুগাবে সরকারের বিরুদ্ধে লেখা কবিতা ও কবিতার বই সরকারের রোষানলে পড়বে জেনেও একদল কবির চেষ্টায় আয়োজন করা হয় এক বইমেলার। কিন্তু সরকারি বাধায় মুহূর্তেই পণ্ড হয়ে যায় সেই মেলা
হারারে শহরের চিতুংউইজা এলাকার রাজসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। এখান থেকে আমরা জুলিয়াস নায়ারে রোডে হারারে গার্ডেনের গ্রন্থমেলায় যেতে চাইছি। ফুয়েল সরবরাহে বেজায় নিদান যাচ্ছে, তাই এ শহর থেকে ট্যাক্সিগুলো এনডেনজার্ড প্রজাতির প্রাণীর মতো বিরল হয়ে আসছে দিনকে দিন। অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দুরারোগ্য রোগীর চিরে ফেলা পেটের অন্ত্রতন্ত্রের মতো দেখতে পেঁচানো খানাখন্দের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। লরিতে রবার্ট মুগাবের অনেকগুলো পোস্টার সাঁটা হলেও ‘কাচিরে ফার্মে’র তলায় লেখা স্টাউনটন পরিবারের নাম ও লোগো পরিষ্কার পড়া যায়। ঝাঁকুনিতে খাবি খেলে ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে ওঠে একঝাঁক কাক। লরিটি দাঁড়ালে ক্রিস্টিনা ড্রাইভারের সঙ্গে চিসোওনা ভাষায় কথা বলে। হারারে গার্ডেনের গ্রন্থমেলায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য সে মোটা অঙ্কের টাকা চাইলে তা দিতে আমাদের অসুবিধা কিছু হয় না। দিন কয়েক হলো আমাদের রোজগার বেড়েছে। রবার্ট মুগাবের জানুপিএফ পার্টির সরকার ২৯টি এনজিওর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে আমাদের আয়-রোজগার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে হালফিল জানা গেছে, শুধু খাদ্য ও ত্রাণ কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। তবে কিনা যেসব সাহায্যকারী সংস্থা পিসওয়ার্ক করছে, তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমরা একটি জার্মান ফান্ডিং এজেন্সির বদৌলতে ‘অল্টারনেটিভ টু ভায়োলেন্সে’র ওপর স্থানীয় লেখকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ করে দিনওয়ারি মাইনে পাচ্ছি। এ ধরনের অ্যাকটিভিটি পিসওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, শহরে যে গ্রন্থমেলা হচ্ছে, তাতে এক দফা হাজিরা দেওয়া, লেখকদের সঙ্গে কিঞ্চিৎ সহবত করা তো কাজের মধ্যেই পড়ে।
টায়ারের খাঁজে পা দিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠতে গেলে কতগুলো কাক রীতিমতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ শুরু করে। জিম্বাবুয়ের কাকগুলো সম্পূর্ণ কালো নয়, এদের পালকে সাদার মিশ্রণ আছে। গাড়িতে রাখা হাঁড়ি হাঁড়ি মধু। তার সৌরভে কাকগুলো আপাতত মাতোয়ারা। সূর্যস্নানের ইজি চেয়ারে শুয়ে রোদচশমার ভেতর দিয়ে প্লেবয় ম্যাগাজিনের নগ্নচিত্রে চোখ রেখেছে বেজায় দশাসই সুরতের এক কৃষ্ণাঙ্গ। আমরা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ট্রাকের খোলে দাঁড় করানো দুটি নাদুসনুদুস বলদের দিকে তাকাই। আতঙ্ক হয়, যদি তারা পদাঘাত করে, তা হলে এ যাত্রায় কুপোকাত হতে বাকি কিছু থাকবে না। ক্রিস্টিনার সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রসন্তানের চিসোওনা ভাষায় টুকটাক আলাপ হয়। ট্রাকটি এ মুহূর্তে কৃষ্ণাঙ্গদের করতলগত হলেও, তা নিয়ে আসা হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ স্টাউনটন পরিবারের কাচিরে ফার্ম থেকে। মধুর হাঁড়িগুলো জানুপিএফ ক্যাডারদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, বলদদের কসাইখানায় নামিয়ে তবে বিকেল নাগাদ আমাদের অবশ্যই তাঁরা পৌঁছে দেবেন হারারে গার্ডেনে। বেশ কিছু সচিত্র প্লেবয় ম্যাগাজিনের সঙ্গে একটি সেক্সটয়ও জোগাড় করেছেন তিনি বৃদ্ধ ফার্মার জেমস ও মার্গারেট দম্পতির নাতির অর্কিড হাউস থেকে। বড়শিতে লাগা মাছের মতো তুলে টয়টি তিনি ক্রিস্টিনাকে দেখান।
একজন তরুণীকে কীভাবে সেক্সটয় ব্যবহার করতে হয়, তা ব্যাখ্যা করা রুচিসম্মত নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা নাচার। জানুপিএফ পার্টি করণেওয়ালাদের ক্ষমতা প্রবল। তাদের কোনো আচরণের বিরুদ্ধাচরণ করা ঠিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। তাই নীরব থেকে আমি ক্রিস্টিনার রিঅ্যাকশন বুঝতে চেষ্টা করি। সে কালো গগলসে চোখ ঢেকে আছে বলে বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝাও যায় না। ‘কোয়াচিরেরে’ বা ‘জিম্বাবুয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ হালফিল ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। ছোট এক দল চাকরিবাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রবার্ট মুগাবের জানুপিএফকে সমর্থন দিচ্ছে। জার্মান ফান্ডিং সংস্থা যারা পিসওয়ার্কে টাকা ঢালছে, তাদের লিংক হচ্ছে ক্রিস্টিনা। হারারের ব্যাংকগুলোয় লেনদেন একদম হচ্ছে না। তাই ক্রিস্টিনা ক্যাশ ইউরো ক্যারি করছে। অল্টারনেটিভ টু ভায়োলেন্স সে ক্যাশ দিয়ে ফান্ড করে। পিস পোয়েট্রি প্রজেক্ট বলে আরও কিছু ক্ষুদ্র প্রকল্পের নামে সে নির্বাচিত কবিদের হাতে তুলে দিয়েছে কিছু টাকা। এ কড়িতে ২৩ জন লেখকের লেখা নিয়ে আজ গ্রন্থমেলায় বের হবে রাইটিং স্টিল বলে একটি সংকলন।
মাত্র তিন দিন আগে লোডশেডিংয়ের রাতে এভেনডেইল এলাকায় ক্রিস্টিনা হাঁটছিল একাকী। মুখোশধারীরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় নির্জন এক পার্কে। সেলফোন ও ল্যাপটপের সঙ্গে তারা ছিনিয়ে নেয় ফান্ডিংয়ের এক তাড়া ইউরো। না, ধর্ষিতা সে হয়নি, তবে টর্চের আলোয় তারা যখন তার স্তনযুগলে জানুপিএফ পার্টির স্টিকারের সঙ্গে রবার্ট মুগাবের ছবি সাঁটছিল, তখন অত্যন্ত দীর্ঘকায় এক কৃষ্ণাঙ্গ পাঁচ ব্যাটারি টর্চ জ্বেলে এসে তাদের চাপা স্বরে ধমক দিলে, তারা তার শরীর ছেড়ে ত্রস্তে ছুটে পালায়। টর্চওয়ালা তাকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছাকাছি নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘নাডিনোয়েমরমবো’ বা ‘সরি’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি জিম্বাবুয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুগাবের সমর্থক গ্রুপ সে যে বিরুদ্ধবাদী লেখকদের প্রকল্পে ফান্ড করছে, এ জন্য বদলা নিল? সে যে ইদানীং ক্যাশ নিয়ে চলাফেরা করে, তা মুগাবেবিরোধী বেশ কয়েকজন কবি-লেখক জানেন। তার তো এ গোত্রের লেখকদের সঙ্গে বেশ জানাশোনা—দীর্ঘদেহের টর্চওয়ালা কৃষ্ণাঙ্গ কে? তাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার পেছনে তাঁর মোটিভই বা কী?
ছিনতাই হওয়ার পর পর জার্মান ফান্ডাররা ক্রিস্টিনাকে একটি দামি সেলফোন দিয়েছে। এতে লম্বাচওড়া সব ই-মেইল ও নানা কিসিমের ডকুমেন্ট অনায়াসে ডাউনলোড করা যায়। ট্রাক রেলিংয়ে বসা সাদা-কালো কাক নিয়ে মাউন্ট প্লেজেন্ট এলাকা পাড়ি দিলে তার সেলফোনে পর পর টেক্সট আসতে শুরু করে। সরকার দেশের ইনডিপেনডেন্ট নিউজপেপার বলে খ্যাতিমান ডেইলি নিউজকে ব্যান্ড করেছে। একটু আগে জানুপিএফের ক্যাডাররা তার দপ্তরে ঢুকে বোমাবাজি করে। তার চেয়েও বড় খবর হচ্ছে, বেরি বিয়েরাক বলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতাকে হাজতে পোরা হয়েছে। একসময় পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া এ জার্নালিস্ট কয়েদখানায় ইঁদুর ও তেলাপোকায় উপদ্রুত হয়েও কীভাবে যেন বাইরে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তা ইন্টারনেটে এখন চাউর হচ্ছে।
ট্রাক আমাদের হারারে গার্ডেনে নামিয়ে দিলে দেখি, গ্রন্থমেলায় লোকসমাগম একেবারেই হয়নি। বাগিচায় পাথরের যুগল ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে বেহদ নির্জনে পরস্পরের শরীর স্পর্শ করে খুব অন্তরঙ্গভাবে। শুধু জিম্বাবুয়ে নয়, এ গ্রন্থমেলাকে সাবসাহারান আফ্রিকার প্রকাশনাশিল্পের লিডিং শোকেস মনে করা হয়। অন্যান্য বছরে যেখানে এ মেলায় দুই শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়ে থাকে, এবারে বুকস্টলের সংখ্যা কুল্লে ৪০। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রকাশনী এসেছে আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে। মেলায় পাঠক, ক্রেতা ও দর্শকদের তালাশ না পেয়ে এইডস রোগে মৃত কোনো ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানের ইমেজ মনে আসে। কবরের পাশে অনুষ্ঠানের ইন্তেজাম হয়েছে, কফিনে রাখা হয়েছে ফুলের ডালি, কিন্তু অজানা কোনো ভীতির কারণে প্রতিবেশীদের কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি গোর দিতে। আর স্টলে স্টলে বিক্রেতারা গোর খনকের মতো দাঁড়িয়ে আছে নেহাত দায়সারাভাবে।
দেখতে দেখতে বেশ ড্রামাটিক কায়দায় গ্রন্থমেলার পাঠক ও খরিদদারেরা বেরিয়ে আসেন বাগিচার ছন, বাঁশ, পাথর ও কাঠের তৈরি কটেজের পেছন থেকে। বেশ কিছু পাঠক চলে গিয়েছিলেন ঝোপঝাড় জাকারান্দা গাছের সারির আবডালে। তারাও গতর থেকে ঘাসপাতা ও ধুলাবালু মুছে ঢুকে পড়ছেন বুকস্টলে। ঠিক তখনই আমরা কবি কাইজিতো মুচিমওয়াকে দেখতে পাই। জিম্বাবুয়ে ওপেন ইউনিভার্সিটির রিজিওন্যাল ডিরেক্টর যশস্বী এ লেখককে রক্তাক্ত দেখে তাজ্জব লাগে। ক্রিস্টিনা তাঁর দিকে ছুটে যায়। তাঁকে ঘিরে মুখচেনা আরও দুজন কবি। তাঁর মাথা ফেটে চুইয়ে চুইয়ে খুন ঝরছে। এক নারী সংস্কৃতিকর্মী রুমাল দিয়ে চেপে তা মুছিয়ে দিচ্ছেন। ক্রিস্টিনার সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারি, রাইটিং স্টিল নামের সংকলনটির মোড়ক ঘণ্টা খানেক আগে উন্মোচিত হলে গোলযোগের সূত্রপাত হয়। গ্রন্থটি দ্রুত বিক্রি হতে থাকলে পুলিশের আস্ত এক ট্রুপ মেলার প্রাঙ্গণে ঢুকে তা বাজেয়াপ্ত করে। স্টল থেকে ছিনিয়ে নিতে গেলে কবি কাইজিতো মুচিমওয়া প্রতিবাদ করেন। বইয়ের বান্ডিল নিয়ে তাঁর সঙ্গে দারোগার ঠেলাধাক্কা হলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। তারপর যেসব পাঠক ওপেনলি এ বই হাতে মেলায় ঘুরপাক খাচ্ছেন, তাঁদের জনে জনে ধাওয়া করে লাঠির দুই-চার ঘা দিয়ে পুলিশ বইটি ছিনিয়ে নেয়। এ বইয়ের ফান্ডিংয়ের সূত্রও ক্রিস্টিনা, তাই একটু টেনশন লাগে।
ঝরা পাতা মড়মড় করে বাগিচার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ান হরিণের চামড়ার ঢাল হাতে কয়েকজন তরুণ-তরুণী। এ ঢালওয়ালারা মাকড়সার জাল বলে এক গুপ্ত লেখক সংঘের সদস্য। পুলিশি তুলতবিলের সময় তাঁরা ‘পাসি নে জানুপিএফ, পাসি নে রবার্ট মুগাবে’ বা ‘নিপাত যাক জানুপিএফ ও রবার্ট মুগাবে’ আওয়াজ দিলে ষান্ডা গোছের কিছু পুলিশ তাঁদের ধরে ধরে ডান্ডাপেটা করে। তাঁরা এখন প্রতিরোধের প্রতীক ঢাল হতে মাঠে অবতরণ করেছেন। ব্যূহ রচনা করে খুব রোয়াবের সঙ্গে র্যাপ গানের ছন্দমিল দিয়ে তাঁরা পায়ের তালে ঝরাপাতা ছত্রখান করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ছড়াগান পরিবেশন করেন। তাঁদের অনেকেই পিসওয়ার্কের নানাবিধ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। আন্দাজ করি, শান্তিবাদীরা আত্মরক্ষার জন্য ঢাল ব্যবহার করতে পারেন বটে, তবে তলোয়ার আক্রমণাত্মক অস্ত্রবিশেষ, সুতরাং তা ইস্তেমাল করা হবে শক্ত গোনাহর শামিল। তবে এখানে অন্তত একটি তলোয়ার বা বর্শার উপস্থিতি থাকলে বিষয়টি জমিয়ে লোমহর্ষক কায়দায় বর্ণনা করা যেত।
ক্রিস্টিনা স্টলে স্টলে ঘুরে পাঠকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে রাইটিং স্টিল-এর অন্তত একটি কপি জোগাড়ের চেষ্টা চালায়। ফান্ডারদের দেখানোর জন্য তার একটি কপি চাই-ই। জলে ভেজা একখানা রাইটিং স্টিল পাওয়া যায় খিলখিলানো এক অল্পবয়সী পাঠিকার কাছে। তার সঙ্গী-সাথী অন্য সেহেলিদের গা-গতরও সম্পূর্ণরূপে ভেজা। ধাওয়ার সময় এক তাগড়া পুলিশ ডান্ডা হাতে প্রকৃত পাঠার প্রজননী আচরণের ইশারা করে কিশোরীদের দিকে তেড়ে গেলে তারা বাগিচার ‘চিসিপিটে’ বা ফোয়ারা উথলানো চৌবাচ্চায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতঃপর সলিল স্নানে সিক্ত হলে লেপটানো, ভেজা পরিচ্ছদের অন্তরালে অসমতল নিসর্গের মতো তাদের দেহরেখা খানিক প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাদের অস্বস্তি দেখে মনে হয়, ভবিষ্যতে গ্রন্থমেলায় যাওয়ার সময় কাঁধে ছালায় করে কিছু গামছা নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে।
বেজায় ভুঁড়িওয়ালা এক দারোগা হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে স্টলে স্টলে গিয়ে কিছু বলছেন। জিম্বাবুয়ে হালফিল মঙ্গা যাচ্ছে, এ ঘোরতর খাদ্য-সংকটের সময় এ পুলিশ অফিসার কীভাবে নোয়াপাতি ভুঁড়ি মেইনটেইন করছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ক্রিস্টিনা আগ বাড়িয়ে তাঁর সঙ্গে চিসোওনা ভাষায় কথা বলে। মেলায় বই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি প্রকাশ হতে থাকুক, এসবে তাঁর আপত্তি নেই, তবে কোনো পত্রপত্রিকায় রবার্ট মুগাবে বা জানুপিএফের ধ্বংসের কথা থাকলে আছোলা বংশ নিয়ে তাঁর পুলিশ ট্রুপ তৈরি আছে। সভ্য সমাজে শিল্প-সংস্কৃতিতে সয়লাব হোক, অসুবিধা কিছু নেই, তবে সাহিত্যের নামে বিরুদ্ধবাদী রাজনীতির বেলেল্লাপনা... নো ওয়ে। অবশ্যই এসব বন্ধ রাখতে হবে।
একটি বুক স্টলের সামনে হ্যাট পরা তিন টিনএজার চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে শিশুতোষ কোনো পুস্তকের দিকে। কোমরে ডুগডুগি বেঁধে মরা ঘাসে তাল ঠুকেন টেনডাই হুচু। এ তরুণ কবি মাকড়সা জাল গ্রুপের পালের গোদাবিশেষ। তাঁর পা বেয়ে বুঝি উঠছে আমপিঁপড়া, এ রকম ভঙ্গিতে প্যান্ট গুটিয়ে খুব ছেরাবেরা করে নাচতে নাচতে টেনডাই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হেল্লো হারারে নামের পর্যটক-পছন্দ ম্যাগাজিন। যারা বোঝার, তারা ঠিকই বুঝতে পারে—জনপ্রিয় এ ম্যাগাজিনের ভেতরে আসল মাল কী? কয়েকজন খরিদদারের সঙ্গে হুড়াহুড়ি করে আমিও একখানা হেল্লো হারারে কিনি। মাকড়সার জাল লেখকদের একটি গুপ্ত নেটওয়ার্কবিশেষ। এ দেশে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে ‘চেমুরেঙ্গা’ বা মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু কোনো লেখক নির্দিষ্টভাবে লেখেননি বলে উপাত্তের অভাবে সে আমল নিয়ে ভালো কিছু লেখা মুশকিল। সুতরাং, এ যুগে যে বিরুদ্ধবাদী আন্দোলন চলছে বা সামাজিক দ্বন্দ্ব ও মানুষের ভোগান্তির কথা মাকড়সার জালের লেখকেরা এমনভাবে লিখেছেন, যাতে ভবিষ্যতে সাহিত্য সৃষ্টির জন্য উপাত্তের অনটন না হয়। দেশে মিডিয়া সাপরেসড হয়ে আছে বটে, তবে যেখানে যা ঘটছে, মাকড়সার জালে আটকানো পোকার মতো তা ধরা পড়ছে এ নেটওয়ার্কের ঊর্ণনাভে।
হেল্লো হারারের পয়লা পৃষ্ঠা কয়েকে পর্যটকদের জন্য, কীভাবে ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে, ভাস্করপল্লিতে যাওয়ার উপায় কী, আর ডলার-ইউরো ভাঙানো যায় কীভাবে—এসব তথ্যে ভরপুর। তারপর একটি পৃষ্ঠার কোণে মাকড়সার জালের নকশা দেখে আমি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তাজ্জব হয়ে দেখি, একটু আগে যে স্টাউনটন পরিবারের কাচিরে ফার্মের ট্রাকে করে আমরা হারারে গার্ডেনে এসেছি, তাদের তথা জেমস ও মার্গারেট স্টাউনটনকে তাদের তিন পুরুষের খামার থেকে মাত্র তিন দিন আগে উচ্ছেদের ঘটনা এখানে বিবৃত হয়েছে। ফার্ম থেকে ৭০-৭৫ বছরের বৃদ্ধ এ যুগলকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের কনিষ্ঠ স্ত্রী, তাঁর এককালের রূপসী সেক্রেটারি মিসেস গ্রেইস মুগাবে। তিনি কালো চশমা পরে এসইউভিতে চড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ান যব, সয়াবিন, গম ও আলুর খেতে। তারপর যে বিশাল গ্রিনহাউস থেকে আমস্টারডামে রপ্তানি হয় গোলাপ, তাতে ঢুকে নিজ হাতে চয়ন করেন প্রেসিডেন্টের জন্য তাজা ফুল। স্টাউনটন পরিবারের দুই পুরুষের কবরে হাতুড়ি দিয়ে টোম্ব স্টোনের নামফলক ভাঙার ভেতর দিয়ে শুরু হয় অ্যাকশন। প্রতিবাদরত বৃদ্ধ স্টাউনটন দম্পতিকে মুখে কাপড় গুঁজে হাত পেছনে বেঁধে ট্রাক্টরে চড়িয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের দিকে। ’৫৭ সালে তৈরি একটি লাল অকেজো অ্যান্টিক ক্যাডিলাক গাড়ি গ্রেইস মুগাবের পছন্দ হলে তা দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নেওয়া হয়।
গ্রেইস প্রেসিডেনসিয়াল ভিলায় ফিরে গেলে তাঁর অনুসারীরা স্টাউনটন পরিবারের ককটেল লাউঞ্জে ঢুকে সেলার থেকে বের করে আনে ওয়াইন, স্পিরিট ও লিক্যার। পান করতে করতে কয়েকজন ঢুকে পড়ে অর্কিড হাউসের লাগোয়া পাথরে তৈরি ছনের চারচালা ছোট কটেজে। ওখানকার বাষ্পস্নানের বাথরুম থেকে তারা বের করে আনে স্টাউনটন দম্পতির নাতির তরুণী স্ত্রীকে। প্রেগন্যান্ট এ নারীকে পাঙ্গা দিয়ে খুঁচিয়ে, জখম করে বিবস্ত্র করা হয়। তারপর তাঁকে স্টিরিও বাজিয়ে অনবরত নাচতে বাধ্য করলে তাঁর মিসক্যারেজ হয়।
যারা শ্বেতাঙ্গ স্টাউনটন পরিবারকে ফার্ম থেকে উৎখাতের ক্রিয়াকর্মে শরিক হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে অনামা লেখক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। বৃদ্ধ স্টাউনটন দম্পতি এখন কোথায় আছেন? ভ্রূণহারা রক্তাক্ত মেয়েটি বেঁচে আছে কি না, এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
মাকড়সার জালের লেখকেরা ঢাল হাতে ঘাসে পা ঠুকে এখন কঙ্গোনিয়া নৃত্যে মাতোয়ারা হয়েছেন। তাঁদের ফালাফালি তীব্র হতেই আওয়াজ ওঠে—পাসি নে জানুপিএফ, পাসি নে রবার্ট মুগাবে বা নিপাত যাক জানুপিএফ ও রবার্ট মুগাবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের হুইসেল বাজলে, আমরা সাজিয়ে রাখা কয়েকটি বোল্ডার টপকে বেরিয়ে আসি জুলিয়াস নায়ারে রোডে। চলমান স্ট্রিটের আপেক্ষিক নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে আমরা আবার ফিরে তাকাই হারারে গার্ডেনের দিকে। ছনের চালাঘরে সাজানো বইয়ের স্তূপের ওপর হাওয়ায় দুলে জিরাফের দীর্ঘ গ্রিবার মতো রঙিন ফুলে ভরা একটি বৃক্ষশাখা।
Mainussultan@hotmail.com
টায়ারের খাঁজে পা দিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠতে গেলে কতগুলো কাক রীতিমতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ শুরু করে। জিম্বাবুয়ের কাকগুলো সম্পূর্ণ কালো নয়, এদের পালকে সাদার মিশ্রণ আছে। গাড়িতে রাখা হাঁড়ি হাঁড়ি মধু। তার সৌরভে কাকগুলো আপাতত মাতোয়ারা। সূর্যস্নানের ইজি চেয়ারে শুয়ে রোদচশমার ভেতর দিয়ে প্লেবয় ম্যাগাজিনের নগ্নচিত্রে চোখ রেখেছে বেজায় দশাসই সুরতের এক কৃষ্ণাঙ্গ। আমরা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ট্রাকের খোলে দাঁড় করানো দুটি নাদুসনুদুস বলদের দিকে তাকাই। আতঙ্ক হয়, যদি তারা পদাঘাত করে, তা হলে এ যাত্রায় কুপোকাত হতে বাকি কিছু থাকবে না। ক্রিস্টিনার সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রসন্তানের চিসোওনা ভাষায় টুকটাক আলাপ হয়। ট্রাকটি এ মুহূর্তে কৃষ্ণাঙ্গদের করতলগত হলেও, তা নিয়ে আসা হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ স্টাউনটন পরিবারের কাচিরে ফার্ম থেকে। মধুর হাঁড়িগুলো জানুপিএফ ক্যাডারদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, বলদদের কসাইখানায় নামিয়ে তবে বিকেল নাগাদ আমাদের অবশ্যই তাঁরা পৌঁছে দেবেন হারারে গার্ডেনে। বেশ কিছু সচিত্র প্লেবয় ম্যাগাজিনের সঙ্গে একটি সেক্সটয়ও জোগাড় করেছেন তিনি বৃদ্ধ ফার্মার জেমস ও মার্গারেট দম্পতির নাতির অর্কিড হাউস থেকে। বড়শিতে লাগা মাছের মতো তুলে টয়টি তিনি ক্রিস্টিনাকে দেখান।
একজন তরুণীকে কীভাবে সেক্সটয় ব্যবহার করতে হয়, তা ব্যাখ্যা করা রুচিসম্মত নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা নাচার। জানুপিএফ পার্টি করণেওয়ালাদের ক্ষমতা প্রবল। তাদের কোনো আচরণের বিরুদ্ধাচরণ করা ঠিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। তাই নীরব থেকে আমি ক্রিস্টিনার রিঅ্যাকশন বুঝতে চেষ্টা করি। সে কালো গগলসে চোখ ঢেকে আছে বলে বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝাও যায় না। ‘কোয়াচিরেরে’ বা ‘জিম্বাবুয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ হালফিল ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। ছোট এক দল চাকরিবাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রবার্ট মুগাবের জানুপিএফকে সমর্থন দিচ্ছে। জার্মান ফান্ডিং সংস্থা যারা পিসওয়ার্কে টাকা ঢালছে, তাদের লিংক হচ্ছে ক্রিস্টিনা। হারারের ব্যাংকগুলোয় লেনদেন একদম হচ্ছে না। তাই ক্রিস্টিনা ক্যাশ ইউরো ক্যারি করছে। অল্টারনেটিভ টু ভায়োলেন্স সে ক্যাশ দিয়ে ফান্ড করে। পিস পোয়েট্রি প্রজেক্ট বলে আরও কিছু ক্ষুদ্র প্রকল্পের নামে সে নির্বাচিত কবিদের হাতে তুলে দিয়েছে কিছু টাকা। এ কড়িতে ২৩ জন লেখকের লেখা নিয়ে আজ গ্রন্থমেলায় বের হবে রাইটিং স্টিল বলে একটি সংকলন।
মাত্র তিন দিন আগে লোডশেডিংয়ের রাতে এভেনডেইল এলাকায় ক্রিস্টিনা হাঁটছিল একাকী। মুখোশধারীরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় নির্জন এক পার্কে। সেলফোন ও ল্যাপটপের সঙ্গে তারা ছিনিয়ে নেয় ফান্ডিংয়ের এক তাড়া ইউরো। না, ধর্ষিতা সে হয়নি, তবে টর্চের আলোয় তারা যখন তার স্তনযুগলে জানুপিএফ পার্টির স্টিকারের সঙ্গে রবার্ট মুগাবের ছবি সাঁটছিল, তখন অত্যন্ত দীর্ঘকায় এক কৃষ্ণাঙ্গ পাঁচ ব্যাটারি টর্চ জ্বেলে এসে তাদের চাপা স্বরে ধমক দিলে, তারা তার শরীর ছেড়ে ত্রস্তে ছুটে পালায়। টর্চওয়ালা তাকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছাকাছি নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘নাডিনোয়েমরমবো’ বা ‘সরি’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি জিম্বাবুয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুগাবের সমর্থক গ্রুপ সে যে বিরুদ্ধবাদী লেখকদের প্রকল্পে ফান্ড করছে, এ জন্য বদলা নিল? সে যে ইদানীং ক্যাশ নিয়ে চলাফেরা করে, তা মুগাবেবিরোধী বেশ কয়েকজন কবি-লেখক জানেন। তার তো এ গোত্রের লেখকদের সঙ্গে বেশ জানাশোনা—দীর্ঘদেহের টর্চওয়ালা কৃষ্ণাঙ্গ কে? তাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার পেছনে তাঁর মোটিভই বা কী?
ছিনতাই হওয়ার পর পর জার্মান ফান্ডাররা ক্রিস্টিনাকে একটি দামি সেলফোন দিয়েছে। এতে লম্বাচওড়া সব ই-মেইল ও নানা কিসিমের ডকুমেন্ট অনায়াসে ডাউনলোড করা যায়। ট্রাক রেলিংয়ে বসা সাদা-কালো কাক নিয়ে মাউন্ট প্লেজেন্ট এলাকা পাড়ি দিলে তার সেলফোনে পর পর টেক্সট আসতে শুরু করে। সরকার দেশের ইনডিপেনডেন্ট নিউজপেপার বলে খ্যাতিমান ডেইলি নিউজকে ব্যান্ড করেছে। একটু আগে জানুপিএফের ক্যাডাররা তার দপ্তরে ঢুকে বোমাবাজি করে। তার চেয়েও বড় খবর হচ্ছে, বেরি বিয়েরাক বলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতাকে হাজতে পোরা হয়েছে। একসময় পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া এ জার্নালিস্ট কয়েদখানায় ইঁদুর ও তেলাপোকায় উপদ্রুত হয়েও কীভাবে যেন বাইরে একটি প্রতিবেদন পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তা ইন্টারনেটে এখন চাউর হচ্ছে।
ট্রাক আমাদের হারারে গার্ডেনে নামিয়ে দিলে দেখি, গ্রন্থমেলায় লোকসমাগম একেবারেই হয়নি। বাগিচায় পাথরের যুগল ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে বেহদ নির্জনে পরস্পরের শরীর স্পর্শ করে খুব অন্তরঙ্গভাবে। শুধু জিম্বাবুয়ে নয়, এ গ্রন্থমেলাকে সাবসাহারান আফ্রিকার প্রকাশনাশিল্পের লিডিং শোকেস মনে করা হয়। অন্যান্য বছরে যেখানে এ মেলায় দুই শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়ে থাকে, এবারে বুকস্টলের সংখ্যা কুল্লে ৪০। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রকাশনী এসেছে আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে। মেলায় পাঠক, ক্রেতা ও দর্শকদের তালাশ না পেয়ে এইডস রোগে মৃত কোনো ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানের ইমেজ মনে আসে। কবরের পাশে অনুষ্ঠানের ইন্তেজাম হয়েছে, কফিনে রাখা হয়েছে ফুলের ডালি, কিন্তু অজানা কোনো ভীতির কারণে প্রতিবেশীদের কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি গোর দিতে। আর স্টলে স্টলে বিক্রেতারা গোর খনকের মতো দাঁড়িয়ে আছে নেহাত দায়সারাভাবে।
দেখতে দেখতে বেশ ড্রামাটিক কায়দায় গ্রন্থমেলার পাঠক ও খরিদদারেরা বেরিয়ে আসেন বাগিচার ছন, বাঁশ, পাথর ও কাঠের তৈরি কটেজের পেছন থেকে। বেশ কিছু পাঠক চলে গিয়েছিলেন ঝোপঝাড় জাকারান্দা গাছের সারির আবডালে। তারাও গতর থেকে ঘাসপাতা ও ধুলাবালু মুছে ঢুকে পড়ছেন বুকস্টলে। ঠিক তখনই আমরা কবি কাইজিতো মুচিমওয়াকে দেখতে পাই। জিম্বাবুয়ে ওপেন ইউনিভার্সিটির রিজিওন্যাল ডিরেক্টর যশস্বী এ লেখককে রক্তাক্ত দেখে তাজ্জব লাগে। ক্রিস্টিনা তাঁর দিকে ছুটে যায়। তাঁকে ঘিরে মুখচেনা আরও দুজন কবি। তাঁর মাথা ফেটে চুইয়ে চুইয়ে খুন ঝরছে। এক নারী সংস্কৃতিকর্মী রুমাল দিয়ে চেপে তা মুছিয়ে দিচ্ছেন। ক্রিস্টিনার সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারি, রাইটিং স্টিল নামের সংকলনটির মোড়ক ঘণ্টা খানেক আগে উন্মোচিত হলে গোলযোগের সূত্রপাত হয়। গ্রন্থটি দ্রুত বিক্রি হতে থাকলে পুলিশের আস্ত এক ট্রুপ মেলার প্রাঙ্গণে ঢুকে তা বাজেয়াপ্ত করে। স্টল থেকে ছিনিয়ে নিতে গেলে কবি কাইজিতো মুচিমওয়া প্রতিবাদ করেন। বইয়ের বান্ডিল নিয়ে তাঁর সঙ্গে দারোগার ঠেলাধাক্কা হলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। তারপর যেসব পাঠক ওপেনলি এ বই হাতে মেলায় ঘুরপাক খাচ্ছেন, তাঁদের জনে জনে ধাওয়া করে লাঠির দুই-চার ঘা দিয়ে পুলিশ বইটি ছিনিয়ে নেয়। এ বইয়ের ফান্ডিংয়ের সূত্রও ক্রিস্টিনা, তাই একটু টেনশন লাগে।
ঝরা পাতা মড়মড় করে বাগিচার প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ান হরিণের চামড়ার ঢাল হাতে কয়েকজন তরুণ-তরুণী। এ ঢালওয়ালারা মাকড়সার জাল বলে এক গুপ্ত লেখক সংঘের সদস্য। পুলিশি তুলতবিলের সময় তাঁরা ‘পাসি নে জানুপিএফ, পাসি নে রবার্ট মুগাবে’ বা ‘নিপাত যাক জানুপিএফ ও রবার্ট মুগাবে’ আওয়াজ দিলে ষান্ডা গোছের কিছু পুলিশ তাঁদের ধরে ধরে ডান্ডাপেটা করে। তাঁরা এখন প্রতিরোধের প্রতীক ঢাল হতে মাঠে অবতরণ করেছেন। ব্যূহ রচনা করে খুব রোয়াবের সঙ্গে র্যাপ গানের ছন্দমিল দিয়ে তাঁরা পায়ের তালে ঝরাপাতা ছত্রখান করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ছড়াগান পরিবেশন করেন। তাঁদের অনেকেই পিসওয়ার্কের নানাবিধ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। আন্দাজ করি, শান্তিবাদীরা আত্মরক্ষার জন্য ঢাল ব্যবহার করতে পারেন বটে, তবে তলোয়ার আক্রমণাত্মক অস্ত্রবিশেষ, সুতরাং তা ইস্তেমাল করা হবে শক্ত গোনাহর শামিল। তবে এখানে অন্তত একটি তলোয়ার বা বর্শার উপস্থিতি থাকলে বিষয়টি জমিয়ে লোমহর্ষক কায়দায় বর্ণনা করা যেত।
ক্রিস্টিনা স্টলে স্টলে ঘুরে পাঠকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে রাইটিং স্টিল-এর অন্তত একটি কপি জোগাড়ের চেষ্টা চালায়। ফান্ডারদের দেখানোর জন্য তার একটি কপি চাই-ই। জলে ভেজা একখানা রাইটিং স্টিল পাওয়া যায় খিলখিলানো এক অল্পবয়সী পাঠিকার কাছে। তার সঙ্গী-সাথী অন্য সেহেলিদের গা-গতরও সম্পূর্ণরূপে ভেজা। ধাওয়ার সময় এক তাগড়া পুলিশ ডান্ডা হাতে প্রকৃত পাঠার প্রজননী আচরণের ইশারা করে কিশোরীদের দিকে তেড়ে গেলে তারা বাগিচার ‘চিসিপিটে’ বা ফোয়ারা উথলানো চৌবাচ্চায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতঃপর সলিল স্নানে সিক্ত হলে লেপটানো, ভেজা পরিচ্ছদের অন্তরালে অসমতল নিসর্গের মতো তাদের দেহরেখা খানিক প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাদের অস্বস্তি দেখে মনে হয়, ভবিষ্যতে গ্রন্থমেলায় যাওয়ার সময় কাঁধে ছালায় করে কিছু গামছা নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে।
বেজায় ভুঁড়িওয়ালা এক দারোগা হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে স্টলে স্টলে গিয়ে কিছু বলছেন। জিম্বাবুয়ে হালফিল মঙ্গা যাচ্ছে, এ ঘোরতর খাদ্য-সংকটের সময় এ পুলিশ অফিসার কীভাবে নোয়াপাতি ভুঁড়ি মেইনটেইন করছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ক্রিস্টিনা আগ বাড়িয়ে তাঁর সঙ্গে চিসোওনা ভাষায় কথা বলে। মেলায় বই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি প্রকাশ হতে থাকুক, এসবে তাঁর আপত্তি নেই, তবে কোনো পত্রপত্রিকায় রবার্ট মুগাবে বা জানুপিএফের ধ্বংসের কথা থাকলে আছোলা বংশ নিয়ে তাঁর পুলিশ ট্রুপ তৈরি আছে। সভ্য সমাজে শিল্প-সংস্কৃতিতে সয়লাব হোক, অসুবিধা কিছু নেই, তবে সাহিত্যের নামে বিরুদ্ধবাদী রাজনীতির বেলেল্লাপনা... নো ওয়ে। অবশ্যই এসব বন্ধ রাখতে হবে।
একটি বুক স্টলের সামনে হ্যাট পরা তিন টিনএজার চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে শিশুতোষ কোনো পুস্তকের দিকে। কোমরে ডুগডুগি বেঁধে মরা ঘাসে তাল ঠুকেন টেনডাই হুচু। এ তরুণ কবি মাকড়সা জাল গ্রুপের পালের গোদাবিশেষ। তাঁর পা বেয়ে বুঝি উঠছে আমপিঁপড়া, এ রকম ভঙ্গিতে প্যান্ট গুটিয়ে খুব ছেরাবেরা করে নাচতে নাচতে টেনডাই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হেল্লো হারারে নামের পর্যটক-পছন্দ ম্যাগাজিন। যারা বোঝার, তারা ঠিকই বুঝতে পারে—জনপ্রিয় এ ম্যাগাজিনের ভেতরে আসল মাল কী? কয়েকজন খরিদদারের সঙ্গে হুড়াহুড়ি করে আমিও একখানা হেল্লো হারারে কিনি। মাকড়সার জাল লেখকদের একটি গুপ্ত নেটওয়ার্কবিশেষ। এ দেশে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে ‘চেমুরেঙ্গা’ বা মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু কোনো লেখক নির্দিষ্টভাবে লেখেননি বলে উপাত্তের অভাবে সে আমল নিয়ে ভালো কিছু লেখা মুশকিল। সুতরাং, এ যুগে যে বিরুদ্ধবাদী আন্দোলন চলছে বা সামাজিক দ্বন্দ্ব ও মানুষের ভোগান্তির কথা মাকড়সার জালের লেখকেরা এমনভাবে লিখেছেন, যাতে ভবিষ্যতে সাহিত্য সৃষ্টির জন্য উপাত্তের অনটন না হয়। দেশে মিডিয়া সাপরেসড হয়ে আছে বটে, তবে যেখানে যা ঘটছে, মাকড়সার জালে আটকানো পোকার মতো তা ধরা পড়ছে এ নেটওয়ার্কের ঊর্ণনাভে।
হেল্লো হারারের পয়লা পৃষ্ঠা কয়েকে পর্যটকদের জন্য, কীভাবে ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে, ভাস্করপল্লিতে যাওয়ার উপায় কী, আর ডলার-ইউরো ভাঙানো যায় কীভাবে—এসব তথ্যে ভরপুর। তারপর একটি পৃষ্ঠার কোণে মাকড়সার জালের নকশা দেখে আমি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তাজ্জব হয়ে দেখি, একটু আগে যে স্টাউনটন পরিবারের কাচিরে ফার্মের ট্রাকে করে আমরা হারারে গার্ডেনে এসেছি, তাদের তথা জেমস ও মার্গারেট স্টাউনটনকে তাদের তিন পুরুষের খামার থেকে মাত্র তিন দিন আগে উচ্ছেদের ঘটনা এখানে বিবৃত হয়েছে। ফার্ম থেকে ৭০-৭৫ বছরের বৃদ্ধ এ যুগলকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের কনিষ্ঠ স্ত্রী, তাঁর এককালের রূপসী সেক্রেটারি মিসেস গ্রেইস মুগাবে। তিনি কালো চশমা পরে এসইউভিতে চড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ান যব, সয়াবিন, গম ও আলুর খেতে। তারপর যে বিশাল গ্রিনহাউস থেকে আমস্টারডামে রপ্তানি হয় গোলাপ, তাতে ঢুকে নিজ হাতে চয়ন করেন প্রেসিডেন্টের জন্য তাজা ফুল। স্টাউনটন পরিবারের দুই পুরুষের কবরে হাতুড়ি দিয়ে টোম্ব স্টোনের নামফলক ভাঙার ভেতর দিয়ে শুরু হয় অ্যাকশন। প্রতিবাদরত বৃদ্ধ স্টাউনটন দম্পতিকে মুখে কাপড় গুঁজে হাত পেছনে বেঁধে ট্রাক্টরে চড়িয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের দিকে। ’৫৭ সালে তৈরি একটি লাল অকেজো অ্যান্টিক ক্যাডিলাক গাড়ি গ্রেইস মুগাবের পছন্দ হলে তা দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নেওয়া হয়।
গ্রেইস প্রেসিডেনসিয়াল ভিলায় ফিরে গেলে তাঁর অনুসারীরা স্টাউনটন পরিবারের ককটেল লাউঞ্জে ঢুকে সেলার থেকে বের করে আনে ওয়াইন, স্পিরিট ও লিক্যার। পান করতে করতে কয়েকজন ঢুকে পড়ে অর্কিড হাউসের লাগোয়া পাথরে তৈরি ছনের চারচালা ছোট কটেজে। ওখানকার বাষ্পস্নানের বাথরুম থেকে তারা বের করে আনে স্টাউনটন দম্পতির নাতির তরুণী স্ত্রীকে। প্রেগন্যান্ট এ নারীকে পাঙ্গা দিয়ে খুঁচিয়ে, জখম করে বিবস্ত্র করা হয়। তারপর তাঁকে স্টিরিও বাজিয়ে অনবরত নাচতে বাধ্য করলে তাঁর মিসক্যারেজ হয়।
যারা শ্বেতাঙ্গ স্টাউনটন পরিবারকে ফার্ম থেকে উৎখাতের ক্রিয়াকর্মে শরিক হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে অনামা লেখক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। বৃদ্ধ স্টাউনটন দম্পতি এখন কোথায় আছেন? ভ্রূণহারা রক্তাক্ত মেয়েটি বেঁচে আছে কি না, এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
মাকড়সার জালের লেখকেরা ঢাল হাতে ঘাসে পা ঠুকে এখন কঙ্গোনিয়া নৃত্যে মাতোয়ারা হয়েছেন। তাঁদের ফালাফালি তীব্র হতেই আওয়াজ ওঠে—পাসি নে জানুপিএফ, পাসি নে রবার্ট মুগাবে বা নিপাত যাক জানুপিএফ ও রবার্ট মুগাবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় পুলিশের হুইসেল বাজলে, আমরা সাজিয়ে রাখা কয়েকটি বোল্ডার টপকে বেরিয়ে আসি জুলিয়াস নায়ারে রোডে। চলমান স্ট্রিটের আপেক্ষিক নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে আমরা আবার ফিরে তাকাই হারারে গার্ডেনের দিকে। ছনের চালাঘরে সাজানো বইয়ের স্তূপের ওপর হাওয়ায় দুলে জিরাফের দীর্ঘ গ্রিবার মতো রঙিন ফুলে ভরা একটি বৃক্ষশাখা।
Mainussultan@hotmail.com
No comments