শেকড়ের ডাক-আহত বোধের সীমাহীন যন্ত্রণা by ফরহাদ মাহমুদ

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'মাথার ভেতরে স্বপ্ন নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে।' সেই বোধ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। যন্ত্রণা দিচ্ছিল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছিল। তিনি সেই বোধকে এড়াতে চাইতেন; কিন্তু পারতেন না।


সজোরে নিক্ষেপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। তেমনি বোধ কি আমাদের পীড়িত করে না? অবশ্যই করে। কিছু বোধ, কিছু ভাবনা, কিছু প্রশ্ন বরাবরই আমাদের পীড়িত করে। আমরা সেসব থেকে নিষ্কৃতি চাই। সহজে-স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু পারি না। সেই বোধ, সেই যন্ত্রণা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বাধ্য হয়ে 'মড়ার খুলির মতো ধরে আছাড় মারিতে চাই।' কিন্তু কী নির্মম পরিহাস! 'জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে, তবু সে মাথার চারিপাশে, তবু সে বুকের চারিপাশে।' হাতের কাছে না থাকায়, স্মৃতি থেকেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্‌ত্তিগুলো উদ্ধৃত করেছি। কোথাও ভুল হয়ে থাকলে পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
জীবনানন্দ দাশের সেই বোধ, সেই উপলব্ধি আজ যেন বড় বেশি সত্য, আরো বেশি বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের জীবনে। ১৯৭১ সালে এ জাতি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল। কেন? যেই স্বপ্ন নিয়ে, যেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা সেদিন শত্রুর বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, সেই স্বপ্ন, সেই আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ হয়েছে? স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরই আমরা দেখেছি, কিছু লোক সম্পদের উদগ্র বাসনা থেকে লুটপাটে ব্যাপৃত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরারা কেউই বাদ যাননি। এমনকি বর্ণচোরা স্বাধীনতাবিরোধীরাও আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় এসে এই লুটপাটে শরিক হয়। এদের কর্মকাণ্ড দেখে বঙ্গবন্ধু অসহায়ের মতো যে আক্ষেপ করেছিলেন, তার মোদ্দাকথা হলো- 'আমি কী করব, আমার চারপাশে সব চাটার দল। চেয়েচিন্তে আনি, আর ওরা সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলে।' আর এই চাটার দলের লোভ-লালসা স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাকে যেমন পর্যুদস্ত করেছিল, তেমনি পরাজিত শক্তিদের পুনরায় ক্ষমতা দখলে সহায়তা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পথও এরাই তৈরি করে দিয়েছিল। ২০১২ সালে এসেও সেই একই ধারা, সেই একই চাটার দল আমাদের কেন দেখতে হচ্ছে? কেন মন্ত্রী, এমপি, দলীয় হোমরা-চোমরারা তাঁদের লোভ-লালসা সংবরণ করতে পারেন না। বরং তাঁদের লোভ-লালসার জিভটা ক্রমেই যেন আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়া, শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি, ভর্তি-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, নদী দখল, অন্যের সম্পত্তি দখল- কোনটা থেকে তাঁরা দূরে আছেন? এর চেয়ে গ্লানির, এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? তাঁরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি দাবি করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কোন স্বপ্ন, কোন চেতনা, কোন আদর্শ তাঁরা ধারণ করেছেন? কিভাবে তাঁরা পক্ষশক্তি হন। বরং তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন ক্রমাগত ভূলুণ্ঠিত করে চলেছেন। এসব সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানী দিনে-রাতে কখনো কি নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখেন না? তাঁদের দেখলে যে সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণা জন্মায়, তা কি তাঁরা বুঝতে পারেন? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে বিষয়গুলো বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে সেই সময় বেশি দূরে নয়, যখন তাঁরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। ইতিহাসে এ রকম ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সেই ইতিহাস একটু নেড়েচেড়ে দেখার অনুরোধ করছি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও তারা কেন শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিল? পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল দলের ভেতরে থাকা লুটপাটকারীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। তখন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রাইভেট বাহিনীর অত্যাচারে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ফলে জনগণ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। জনগণ এই দুঃসহ অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল। নেতিবাচক সমর্থন দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটকে তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। জোট সরকার অত্যাচার-নির্যাতন-লুটপাটের ধারাকেই আঁকড়ে ধরেছিল এবং আরো বেগবান করেছিল। আবারও মানুষ হতাশ হয়েছিল। নতুন আশায় পুনরায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। কিন্তু মহাজোটের সরকার জনগণের সেই প্রত্যাশার মূল্য দিয়েছে কি? শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, মন্ত্রীর দুর্নীতি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রশাসনের দলীয়করণ- কোথাও লাগাম টানা হলো না। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের ক্ষমা করে দিয়ে অপরাধকেই উৎসাহিত করা হলো। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি-লুটপাটের কিছু যৌক্তিক কারণ ছিল। সদ্যস্বাধীন দেশে এসব নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট প্রশাসনিক শক্তি ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পর এসেও একই চিত্র দেখার পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে না। দেশের মানুষের প্রধান যে আকাঙ্ক্ষা- শান্তিতে বসবাস করা, সুশাসন পাওয়া- সেটি না পাওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে না। এর জন্য যেটি দায়ী তা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। স্বাধীনতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ভূমিকাই প্রধান থাকার কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাদের সেই দায়িত্ব পালনে এ পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়েছে।
স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে হলেও ব্যাপক জনদাবির মুখে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের একটি প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু এখানেও কি আমরা সরকারের যথার্থ আন্তরিকতার পরিচয় পাচ্ছি? ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু করতেই সরকার তিন বছর পার করে দিয়েছে। তদন্তের ধীরগতি অনেকের কাছেই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তদন্তের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যেসব বর্ণচোরা যুদ্ধাপরাধী পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে মিশে গিয়েছে, তাদের ব্যাপারে এখনো সরকারের কোনো স্পষ্ট অবস্থান আমরা দেখতে পাইনি। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করেছিল। জামায়াতের সদস্যরা শান্তিবাহিনী, রাজাকার, আলবদর বাহিনী তৈরি এবং গণহত্যায় বড় ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল। '৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে পরাজিত শক্তি ক্ষমতায় আসার পর সেই সংবিধান কাটাছেঁড়া করে জামায়াতকে পুনরায় রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করা হলেও কৌশলে এবং ভাষার মারপ্যাঁচে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বহাল রাখা হলো এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করার অধিকার বহাল থাকল। এমনি অনেক কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এক ধরনে দোদুল্যমানতাই লক্ষ করি।
এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চায়। কিন্তু একই সঙ্গে তারা শাসক দলের লাগামহীন দুর্নীতি, অপকৌশল ও দোদুল্যমানতাকে ঘৃণা করে। তাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো একটি অতিকঠিন কাজ হাতে নেয়, তখন তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। আবার যখন তারা সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়, দুর্নীতি ও লুটপাটে মত্ত হয়, অবান্তর ও অযাচিত আচরণ করে- তখন মানুষ তাদের পেছনে দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত হয়। এই প্যারাডক্স থেকে দেশের মানুষকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তা না হলে কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোহাই দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসার চেষ্টা মাঠে মারা যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে। আমাদের বোধ, বিশ্বাস ও উপলব্ধি আজ বড় বেশি আহত। আমরা চাই, যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হিসেবে দাবি করে, তারা আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও বুকে ধারণ করুক।
লেখক : সাংবাদিক
fmahmud53@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.