একের পর এক মৃত্যুদণ্ড মওকুফ-অপরাধীকেই কার্যত প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে

রাজনৈতিক দলগুলোতে চিহ্নিত অপরাধীচক্র আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে। গত কয়েক দশকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মুখচেনা অপরাধীচক্রকে রাজনৈতিক দলগুলো পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে।


অনেক সময় এ পৃষ্ঠপোষকতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও এসেছে। রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাসী লালন করে, অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, আইনি প্রক্রিয়ায় দণ্ডিত অপরাধীকে মার্জনা করে, তখন অপরাধীচক্র নিরাপদ আশ্রয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অপরাধ সংঘটনে উৎসাহী ও তৎপর হয়। দেশ হয়ে ওঠে অপরাধীদের অভয়ারণ্য। রাজনীতি রূপ নেয় অনাচারে । বর্তমানে তাই চলছে।
আদালত অপরাধ বিবেচনা করে অপরাধীর শাস্তির বিধান করেন। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা চলার পর আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধী শাস্তি পায়। কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে আমরা দেখছি, অপরাধীর শাস্তি কমে যাচ্ছে, অনেককে মামলা থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মামলা চলা অবস্থায় সরকার পক্ষ বা রাষ্ট্র সন্দেহভাজনদের অব্যাহতি দিলে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। আবার বাংলাদেশে, যেখানে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির শিকার হতে হয়, সেখানে মামলা দায়েরে রাজনৈতিক বিবেচনার অবকাশ শতভাগই থাকে। এমন হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় সাজা হওয়ার অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে, এমনকি স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই এমনটি চলে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশে হরহামেশা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে। এটাও আইনের শাসনের পরিপন্থী। আবার যখন দেখা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মামলা একের পর এক খারিজ হয়ে যায়, তখন ধরেই নিতে হবে এর পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কাজ করছে। উচ্চ আদালতে দণ্ডিত কারো শাস্তি যখন মওকুফ করে দেওয়া হয়, তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় নীতি ও নৈতিকতা। রাজনৈতিক আনুগত্য শাস্তি মওকুফের মানদণ্ড হতে পারে না। তেমনটি হলে 'বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে' কেঁদে ফিরবে, যা এখন সাধারণ চিত্র।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে রাজনৈতিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড মওকুফের যে পরিসংখ্যান জানিয়েছেন, তা আঁতকে ওঠার মতো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২৫ জন রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছে। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের আমলেই ক্ষমা পেয়েছে ২১ জন। এ সরকারের বাকি মেয়াদে রাজনৈতিক বিবেচনায় আর কতজন দণ্ড মওকুফের সুবিধা পাবেন সে তথ্য অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেননি। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা এভাবে সাজা থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেলে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাবে। অন্যদিকে সুযোগসন্ধানী অপরাধীচক্র যেকোনো অপরাধ সংঘটনের পর রাজনৈতিক দলে আশ্রয় খুঁজবে। আবার এমনও হতে পারে, সুসংগঠিত অপরাধীরা রাজনৈতিক দলের ছায়ায় এসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করবে। আমরা মনে করি যেকোনো অপরাধীর দণ্ড মওকুফের আগে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করা উচিত। সংবেদনশীল এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই সমাজে এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে একটি অপরাধমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। মনে রাখতে হবে, অপরাধীর দণ্ড মওকুফের কারণে সমাজে যেন অপরাধপ্রবণতা নতুন মাত্রা না পায়।

No comments

Powered by Blogger.