দুই গীতাঞ্জলি শতবর্ষ পরে by পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি দুই ভাষায় প্রকাশিত হয়। একটি শুধুই গীতাঞ্জলি, বাংলায়; আরেকটি ইংরেজিতেগীতাঞ্জলি: সং অফারিংস। বাংলা গীতাঞ্জলি বেরোয় ৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭ সালে, ইংরেজি ১৯১০-এর আগস্টের মাঝামাঝি।
আর ইংরেজি গীতাঞ্জলি মুদ্রিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে, ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর। বাংলা গীতাঞ্জলির শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে আগেই, এ মাসে শতবর্ষ পূর্ণ করল ইংরেজি গীতাঞ্জলিও
দুটি আলাদা বই
দুটি বই। একটি বাংলা, একটি ইংরেজি। একটি আরেকটির হুবহু অনুবাদ নয়, তবু নাম অংশত এক। একটি শুধুই গীতাঞ্জলি আরেকটি ইংরেজিতেওগীতাঞ্জলি, কিন্তু তার একটি উপনামও ছিল, প্রায় অনুবাদই সেটা—সং অফারিংস । বাংলা গীতাঞ্জলি বেরোয় ১৩১৭ সালের শ্রাবণ মাসের শেষে (৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭), ইংরেজি ১৯১০-এর আগস্টের মাঝামাঝি। আর ইংরেজি গীতাঞ্জলি মুদ্রিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে, ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর। দুটি বই শারীরিকভাবে আলাদা, ভাষা আলাদা, প্রকাশকালের মধ্যে দুই মাসের একটু বেশি ব্যবধান। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, বাঙালির চেতনায় এ দুটি বই যেন একই কক্ষে স্থান করে নিয়েছে। যে গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার পেল, তা বাংলা বইটি নয়, সেটি ইংরেজি গীতাঞ্জলি: সং অফারিংস। তা সত্ত্বেও বাঙালির প্রতিদিনকার বাক্যালাপে, শিশু ও ছাত্রপাঠ্য রচনা বইয়ে চটজলদি লিখে ফেলা সংবাদ নিবন্ধে, এই লোকশ্রুতি বারবার প্রচারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কোন গীতাঞ্জলি, তা নির্দিষ্ট করা হয় না, বড়জোর বলা হয় যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ করে ওই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কেন জানি না, এই আবেগবিন্দুতে পৌঁছে বাঙালির জিজ্ঞাসা সুনির্দিষ্ট তথ্যকে ছুঁতে চায় না, অপ্রাসঙ্গিকবোধে তুচ্ছ করে বা এড়িয়ে যেতে চায়।
অথচ বিশেষজ্ঞরা জানেন, দুটি বই নানা দিক থেকে পৃথক। কতগুলো মামুলি তুলনার প্রসঙ্গ এনে জানানো যায়, প্রথমটির ভাষা বাংলা, দ্বিতীয়টির ইংরেজি। প্রথমটিতে ছন্দমিলযুক্ত কবিতা, দ্বিতীয়টিতে গদ্যছন্দের একমাত্রিক প্রয়োগ। প্রথমটিতে ১৫৮টি কবিতা বা গান, যার মাত্র ৫৩টির অনুবাদ দ্বিতীয়টিতে আছে। দ্বিতীয়টিতে কবিতা সুরহীন, তার সংখ্যা ১০৩। তাতে আর যেসব বই থেকে অনুবাদ স্থান পেয়েছে তার মধ্যে আছে নৈবেদ্য থেকে ১৭টি (এ বইয়ের ৮৯-৯০ সংখ্যক দুটি কবিতাকে একটি কবিতা হিসেবে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ), গীতিমাল্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে তিনটি, অচলায়তন, চৈতালি, কল্পনা, উৎসর্গ থেকে একটি করে। এ ছাড়া আরও দুটি পরবর্তী রচনা জুড়ে দেন অনুবাদে। ও দুটি ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর রচিত হয়েছিল।
আলাদা, তবুও এক
দুটি বই আলাদা, তবু দুটি বই এক। এর কারণ শুধু গণিতের হিসাব নয়, অর্থাৎ বাংলা গীতাঞ্জলির মোট ৫৩টি গান ইংরেজিতে স্থান পেয়েছে বলে নয়। দুটিরই মূল কথা এক ধরনের পূজা ও আত্মনিবেদন। কাকে পূজা, কার কাছে আত্মনিবেদন? একজন ‘ঈশ্বর’কে, একজন ঈশ্বরের কাছে। কে রবীন্দ্রনাথের এই ঈশ্বর।
এ নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্য ও ভাবুকতাপূর্ণ গবেষণা হয়েছে, আমরা আর সে পথে অগ্রসর হব না। আমরা যে অনুমান করব, তা না মানার স্বাধীনতা সব পাঠকেরই অধিকারে থাকবে। আমাদের মতে, এই ঈশ্বর ‘জীবন’ নামক বিশাল অভিজ্ঞতারই একটি রূপকায়িত মূর্তি। যে জীবন পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট থেকে সব মানুষ পেয়েছে, অথচ যে জীবনের অনেক কিছুই সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বরং এই বিপুল, অন্তহীন, অনির্দিষ্ট, অবোধ্য জীবনের অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা তার কারণ বুঝতে পারি না। তার শক্তির কাছে আমরা তুচ্ছ, তার উদাসীন ক্রিয়াকলাপে আমরা স্তম্ভিত থাকি। এই জীবনের প্রবল অভিঘাত কখনো কখনো আমাদের বাধ্য করে তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। মৃত্যুও এই জীবনেরই আরেক রূপ, সে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পিতামাতা, নাথ, প্রভু, রাজা, বন্ধু—সব রকম রূপে-রূপকেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ভাষা হয়তো ধর্মগ্রন্থের স্মৃতি বহন করে, কিন্তু বৃহৎ জীবনের কাছে নিজেকে সমর্পণই বাংলা আর ইংরেজি গীতাঞ্জলির মূল আখ্যান। এর আগে আমাদের মতে, ‘জীবনদেবতা’ বলতে তিনি এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন। জীবনদেবতা ‘জীবনের দেবতা’ নন, যা জীবন সেই দেবতা, রূপক কর্মধারয়, ‘জীবনরূপী দেবতা’।
কেন এই ঈশ্বরের কথা সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠল ওই সময়ে
আমাদের ধারণা, উপনিষদীয় ধর্মবোধ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনার মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে নিহিত হয়েছিল। কারণ, তাঁর দেশপ্রেমের একটা মূল কথা আত্মশক্তির উদ্বোধন, আর এই আত্মশক্তির একটি উৎস নিশ্চয়ই ঈশ্বর। ১৮৯১ নাগাদ চিত্রা পর্বে তিনি ওই একজন ‘জীবনদেবতা’কে পেয়েছেন অবলম্বন হিসেবে, হয়তো তাঁর ওই সময়ের অফুরন্ত সৃষ্টিপ্রেরণার ব্যাখ্যা হিসেবে।
কিন্তু গীতাঞ্জলিতে এসে যে ঈশ্বরের উপস্থিতি তাঁর কাছে অনেক বেশি জরুরি মনে হবে, তিনি আরেক ঈশ্বর, অনেক ব্যক্তিগত ঈশ্বর। নৈবেদ্য থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নৈবেদ্য থেকেই একটি প্রচ্ছন্ন মৃত্যুচেতনার আভাস লক্ষ করি তাঁর মধ্যে—মৃত্যু যখন মৃত্যুর রূপ ধরে (১৪) তখন তাঁর ঈশ্বর তা থেকে তাঁকে পরিত্রাণ এনে দেন। ‘নিন্দা ও ক্ষতি, মৃত্যু-বিরহ, কত বিষবাণ উড়ে অহরহ’ (১১), ‘পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত আমার ঘরের দ্বারে, তব আহ্বান করি সে বহন পার হয়ে এল পারে।’ (১৮)
কার মৃত্যুর কথা বলছেন কবি? এর মধ্যে তাঁর জীবনে অনেক নিকটজনের মৃত্যু ঘটে গেছে। ১৮৯৯-এ প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ চলে গেছেন নৈবেদ্য-এর কবিতাগুলো লেখার ঠিক আগে, ওই মৃত্যুই কি তাঁর অন্তর্যাত্রার সূত্রপাত করেছে? ১৯০২-এ স্ত্রী মৃণালিনী (সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি,/...একাকীর পথে চলিব জগতে/সেই ভালো মোর সেই ভালো’—স্মরণ), ১৯০৩-এ মেজো মেয়ে রানী, ওই বছরেই শান্তিনিকেতনের তরুণ শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়; পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ চলে গেলেন ১৯০৬-এ, অত্যন্ত প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ হঠাৎ মুঙ্গেরে গিয়ে কলেরায় মৃত্যুবরণ করলেন ১৯০৭-এ। কৃষ্ণ কৃপালনি বলেছেন, এটিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শোক। ১৯০৮-এ মৃত্যু হলো মেজ জামাই সত্যেন্দ্র ভট্টাচার্যের, মেজ মেয়ে রানীর মৃত্যুর পাঁচ বছর কাটতে না কাটতেই।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর শোককে বহন আর ধারণ করার ক্ষমতা। যে আঘাত আসছে তাকে গ্রহণ করছেন, ভেতরকার ভাঙচুর বাইরে কেউ টের পাচ্ছে না। এমনকি শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কথাও পরে জানাচ্ছেন মীরা দেবীকে চিঠিতে—
শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসেত আসেত দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়ছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, পড়েনি—সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে। সমস্তের জন্যে আমার কাজ বাকি রইল।
গত শতাব্দীর গোড়ায় তাঁর ব্যক্তিগত শোকের তালিকা তৈরি করি আমরা, কিন্তু সেই সঙ্গে এও তালিকা করতে হয় যে বঙ্গদর্শন-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিচ্ছেন ওই ১৯০১ সালেই, তাতে পর পর দুটি উপন্যাস প্রকাশ করবেন, চোখের বালি (১৯০৩) আর নৌকাডুবি (১৯০৬)। ১৯০০-তেই প্রকাশিত হচ্ছে চারটি কবিতার বই—কথা, কাহিনী, কল্পনা, ক্ষণিকা—এর মধ্যে শেষেরটির আপাত লঘুতা তো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সন্ধিক্ষণের কবিতার বই খেয়া প্রকাশিত হবে ১৯০৬-এ, পাঁচটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হবে ১৯০৭-এ—বিচিত্র প্রবন্ধ, চারিত্রপূজা, প্রাচীন সাহিত্য, লোকসাহিত্য, সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, তার বাইরেও প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হবে। ১৯০৭-এই প্রকাশিত হবে দুটি কৌতুকনাট্যের সংকলন, হাস্যকৌতুক আর ব্যঙ্গকৌতুক। ১৯১০-এর মধ্যে আরও বেরিয়ে যাবে উপন্যাস প্রজাপতির নির্বন্ধ, গোরা, প্রবন্ধ ‘পাবনা সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণ’, প্রবন্ধ গ্রন্থসম্ভার রাজা প্রজা, স্বদেশ, সমূয়, সমাজ, শিক্ষা, শব্দতত্ত্ব, ধর্ম, শান্তিনিকেতন ১-৮, ৯-১১, বিদ্যাসাগর-চরিত, নাটক ও নাটিকা শারদোৎসব, মুকুট, প্রায়শ্চিত্ত, কবিতাগ্রন্থ শিশু।
মনে রাখতে হবে, এরই মধ্যে ১৯০৫-এর অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে স্বচ্ছন্দে নেতৃত্ব দেবেন, অসংখ্য দেশাত্মবোধক সংগীত রচনা করবেন, বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে তাঁর দিকনির্দেশ করবেন, ১৯০৮-এ পাবনায় জাতীয় সম্মেলনীর সভাপতিত্ব করবেন, তাঁর বিকল্প দেশসাধনার কথা বলবেন সভাপতির অভিভাষণে, সন্তান রথীন্দ্রনাথ আর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য, ১৯০৭ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত প্রবাসীতে শত শোকের মধ্যেও গোরার কিস্তি নিয়মিত পাঠানোতে ব্যত্যয় ঘটবে না। তবু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উন্মাদনায় ক্লান্তি ও অবসাদের খবর পাই দু-একটি গানে (‘সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে?’) প্রয়োজন হলে নিজেকে নানা প্রকোষ্ঠে ভাগ করে, প্রতিটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে এই নিশ্ছিদ্র বিভাজন রক্ষা করা হয়তো একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তবু ভেতরকার বিষাদ ও অসহায়তা, কোনো একটা বড় অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা ধরা পড়েছে ১৯১০ থেকে ১৯১৪, এ চার বছরের মধ্যে। এর মধ্যে প্রকাশিত হবে আরও দুটি গানের বই—গীতিমাল্য আর গীতালি; অসাধারণ দুটি নাটক রাজা আর ডাকঘর; শান্তিনিকেতন-এর আরও দুটি প্রবন্ধ, যেগুলো তাঁর এই পর্বের বিশেষ লক্ষণের দ্বারা চিহ্নিত। এমন নয় যে তাঁর বহির্জীবনের কর্মকে তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন, কিংবা তাঁর সৃষ্টির বিপুল বৈচিত্র্য কোনোভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তবু প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের হিসাবমতো, ১৩১৬ সালের ১০ ভাদ্র থেকে ১৩১৭-র ২৯ শ্রাবণ পর্যন্ত গীতাঞ্জলির এই সৃষ্টিপর্বকে নিভৃত প্রাণের দেবতার সঙ্গে তাঁর বিচিত্র সাক্ষাৎকারও চলেছে এই সময়ে। এ পর্ব তিনি অতিক্রমও করে যাবেন ১৯১৪-তেই, বলাকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালিতে তিনি মুখোমুখি হবেন তাঁর ‘ঈশ্বর’-এর, যাঁকে তিনি নানা মানব-সম্বন্ধেই বাঁধতে চাইবেন, পিতা, মাতা, বন্ধু, প্রভু, নাথ, রাজা—কিছুটা বৈষ্ণব অনুষঙ্গ স্মরণ করে, কিছুটা এক অলীক সামন্ততন্ত্রের রাজাদর্শের উদ্ব্বোধনে, যার সূত্রপাত হবে শারদোৎসব থেকে। গীতাঞ্জলিতে এই একমুখী সংলাপের বাইরে, ‘ঈশ্বর’কে ছেড়ে এসে, পাঠকদের জন্য লেখা কিছু গান বা কবিতা নেই তা নয়, শরৎ ঋতুর গানগুলো তাই, ‘দুর্ভাগা দেশ’ বা ‘ভারত-তীর্থ’ নামে ছাপা কবিতাগুলোও তা-ই।
ইংরেজি গীতাঞ্জলি
সং অফারিংস মূলত তাঁর বাংলা কবিতার অনুবাদ এ কথা আমরা সবাই জানি। অনুবাদ কি না এবং কতটা, এ নিয়ে পরে একটু প্রশ্ন তুলব আমরা। কিন্তু অন্য ভাষায় তাঁর নিজের কবিতা অনুবাদ করার কথা মনে হলো কেন আদৌ? বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে বারবার বলেছেন, তিনি পৃথিবীর কবি, পৃথিবীর মানুষের তাঁর কথা আরও বেশি করে জানা উচিত। এর মধ্যে তিনি বিলেত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতও হয়েছিলেন, কিন্তু বিদায় নেওয়ার বহু বিস্তৃত সক্রিয়তায় অসুস্থ (মূর্ছিত) হয়ে পড়ায় চিকিৎসকের নির্দেশে ১৯১২-র ১৯ মার্চের সেই যাত্রা তাঁকে স্থগিত রাখতে হলো। মাদ্রাজ থেকে ফিরে এলেন তিনি। একটু সুস্থ হয়ে চলে গেলেন শিলাইদহে। সেখানে গীতিমাল্য-এর গান তৈরি হচ্ছে আর একটি-দুটি করে অনুবাদ হচ্ছে কবিতার। ইন্দিরা দেবীকে সেখান থেকে চিঠিতে লিখছেন যে শিলাইদহেই শুরু হয়েছিল তাঁর অনুবাদের কাজ। নিজের ইংরেজির দখল নিয়ে তাঁর সংকোচ ছিল। কৌতুক করে ইন্দিরাকে সে কথা বারবার বলেছেন। এ কথা আমরা কবির বিনয় বলেই মনে করব। ‘তখন চৈত্র মাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল।... তার আলো তার হাওয়া তার গন্ধ তার গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না—হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে চায়, ওটা আমার চিরকেলে অভ্যাস, জানিস তো। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মতো বল আমার ছিল না। সেইজন্যে ওই গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরেজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম।’ একটা ছোট খাতার পাতাগুলো আস্তে আস্তে ভরে এল। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছেন, সেখানেও অনুবাদের কাজ চলেছে। ১৯১২-র ২৭ মে ভেঙে যাওয়া যাত্রার সূত্র তুলে নিলেন, রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীকে নিয়ে মুম্বাই থেকে জাহাজে লন্ডন রওনা হলেন।
ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫) ভারতে এসেছিলেন ১৯১০-এ, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ও হয়েছিল। তিনি মূলত শিল্পী, প্রাচীন ভারতের শিল্প সম্বন্ধে তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা ছিল। শিল্পী হিসেবে মূলত অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গেই তাঁর আদান-প্রদান হয়েছে, কিন্তু তাঁদের আলাপের সময় তাঁদের এই সৌম্যদর্শন পিতৃব্যের উপস্থিতি ও বাক্যালাপ রোদেনস্টাইনকে বিশেষ মুগ্ধ করেছিল। লন্ডনে ফিরে তিনি দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় নিবেদিতার করা রবীন্দ্রনাথের গল্পের (সম্ভবত ‘কাবুলিওয়ালা’) ইংরেজি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আরও পড়তে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা। গল্প হয়তো পাননি, কিন্তু অজিতকুমার চক্রবর্তীর করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ তাঁর হাতে এল, তা পড়ে তিনি আরও বেশি করে মুগ্ধ হলেন, গভীর বিস্ময়ও জাগল তাঁর। এত বড় একজন অধ্যাত্মচেতনার কবি লোকলোচনের বাইরে, ইউরোপের কাছে অজ্ঞাত পড়ে থাকবেন, এ তাঁর অসংগত মনে হলো। তিনি লন্ডনে ব্রাহ্ম নেতা প্রমথলাল সেন আর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে অনুরোধ জানালেন রবীন্দ্রনাথকে যেন অবশ্যই লন্ডনে আসতে লিখে দেন তাঁরা। এলে তাঁকে তিনি সানন্দে অভ্যর্থনা করবেন, আতিথ্য দেবেন। একদিন তাঁর কাছে সেই আনন্দ-সন্দেশ পৌঁছাল যে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে আসছেন। নিশ্চয় তাঁর কবিতার তাগাদাও রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল।
রোদেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে অনুবাদের ছোট খাতাটি তুলে দিলেন। পড়ে রোদেনস্টাইন আপ্লুত, পড়ে সমগ্র পৃথিবী আপ্লুত হবে। সে ইতিহাস বহুচর্চিত। তবু ঘটনাক্রমের একটা তালিকা করা যায়...
১২ জুন, ১৯১২: লন্ডনে পৌঁছালেন।
১২ জুলাই, রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা হলো, ইয়েটসসহ বহু ইংরেজ কবি লেখক (প্রধানদের মধ্যে ইয়েট্স ছাড়া রবার্ট ব্রিজেস, আরনেস্ট রিজ, টমার্স স্টার্জ মুর, আর সি ট্রেভেলিয়ান আর এজরা পাউন্ড) তাঁর কবিতাপাঠ শুনে অভিভূত হলেন। সেখানেই স্থির হলো, কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
১ নভেম্বর, লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি সং অফারিংস প্রকাশ করলেন। পরে লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানি বইটি প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ রোটেনস্টাইনকেই বইটি উৎসর্গ করবেন।
এক বছর কয়েক দিন পরে (১২ নভেম্বর, ১৯১৩) শান্তিনিকেতনে খবরে এসে পৌঁছাল, প্রথম এশীয় কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন, সেখানে পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে তাঁকে একাধিক বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বাংলা আর ভারতের গণ্ডি উত্তীর্ণ হয়ে পৃথিবীর নাগরিক হতে চলেছেন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে সম্ভাষণ করছেন সমগ্র বিশ্বসমাজকে। ১৯১২-র এই পশ্চিমযাত্রা তাঁর বিশ্বনাগরিকত্বের ভূমিকা রচনা করেছে, নোবেল পুরস্কার তাঁকে পুরোপুরি পৃথিবীর মানুষ করে তুলবে, শুধু বাঙালিত্বে আবদ্ধ রাখবে না।
দুই গীতাঞ্জলি: মূল, অনুবাদ?
বাংলা গীতাঞ্জলিকে ইংরেজি সং অফারিংস খ্যাতির দৌড়ে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। বাংলা গীতাঞ্জলি প্রকাশের সময় বাঙালি পাঠক মহলে এ নিয়ে খুব তুমুল কিছু হইচই হয়নি, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জালি: সং অফারিংস -এর কথা একেবারেই আলাদা। শুধু লন্ডনের বিদ্বৎসমাজে নয়, তা সাহিত্যে সর্বোত্তম পুরস্কার লাভের পর সারা পৃথিবীর সমাদর লাভ করেছে, এক মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথকে ‘আমি পৃথিবীর কবি’ এই সংগত দাবি করার যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। এ কারণে বড়দিদি বাংলা গীতাঞ্জলি-র একটু অভিমান হতেই পারে। সে শুধু পড়ে রইল বাংলা ভাষার ছোট গণ্ডির মধ্যে, সারা পৃথিবী তার কথা জানলই না। ছোট বোনের ঠাঁই হলো বিশ্বসভায়।
ওপরের কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। যেসব বিদেশি বাংলা ভাষা লিখে বাংলা গীতাঞ্জলি পড়েছেন, তাঁরা অবশ্য বুঝেছেন, বাংলার মধ্যে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে এবং অনুবাদে তার কতটাই বা হারিয়ে গেছে। জার্মানভাষী মার্টিন কেম্পশেন বলেছেন এই রকম কথা, ইংরেজ কবি জো উইন্টার বাংলা গীতাঞ্জলিকে পুরো আবার অনুবাদ করেছেন ছন্দ ও মিলের কাব্যভাষায়। বহু দ্বিভাষী বাঙালিও, যেমন বুদ্ধদেব বসু, নবনীতা দেব সেন প্রভৃতি অনুযোগ করেছেন যে হায়, অধিকাংশ অনুবাদে মূলের অনেকটাই তো হারিয়ে গেছে। কেন রবীন্দ্রনাথ এমন করলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁদের এ নিয়ে অভিযোগ কম নয়। আমেরিকার মেরি লেগোও তাঁর ইংরেজি রবীন্দ্র-জীবনীতে ‘শ্রাবণঘন গহন মোহে’ গানটির আক্ষরিক আর রবীন্দ্রনাথকৃত অনুবাদ তুলে দিয়ে এই অভিযোগ থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিষ্কৃতি দেননি। এঁরা সবাই বাংলা আর ইংরেজি দুটো ভাষাই জানতেন বলে রবীন্দ্রনাথের এই বিপত্তি। কেউ কেউ আবার এমন অভিযোগ করেছেন যে, ঔপনিবেশিক এক কবি সাম্রাজ্যবাদের ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে কিছুটা খাতির করেছেন, তাঁর কী পছন্দ হতে পারে সেটা ভেবে নিয়ে নিজের কবিতাকে ছাঁটকাট করেছেন।
আমাদের বক্তব্য একটু অন্য রকম। আমরা বলি, সং অফারিংস -কে বাংলা উৎসের অনুবাদ হিসেবে ধরবেন না। তা ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা। হ্যাঁ, অনেক কবিতার ক্ষেত্রেই মূলের একটা কবিতাকে তিনি অনুসরণ করেছেন, কিন্তু কখনো কখনো তা যে করেননি, তার অধিকার কি তাঁর ছিল না? তাঁকে আমরা সাধারণ অনুবাদক হিসেবে দেখব কেন? সাধারণ পেশাদার অনুবাদকেরা ‘অন্যের’ লেখা অনুবাদ করেন, তাঁদের আমরা বেশি স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ভাবি না, কারণ তাঁরা মূলের স্রষ্টা নন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেখানে একই সঙ্গে স্রষ্টা আর অনুবাদক, সেখানে তাঁর স্বাধীনতা কি সাধারণ অনুবাদকের মতোই হবে, তার বেশি নয়? ইংরেজিতে এক আত্মস্বতন্ত্র কবি হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে আমাদের বাধা কোথায়?
ইংরেজি গীতাঞ্জালির সাফল্যকাহিনি বহু জ্ঞাত ও বহু প্রচারিত, তা নিয়ে এখানে নতুন করে বলার পরিসর নেই। কীভাবে ইয়েটস ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য বুধজন এর পাঠ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, কীভাবে ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই’-এর অনুবাদ প্রথম মহাযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে ইংরেজ কবি উইলফ্রেড আওয়েনকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, কীভাবে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা নিয়ৎ ১৯৬৪ সালে নিজের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে তাঁর ভাষায় বলে উঠেছিলেন, (কোনো গীতাঞ্জলির নয় এ গান, তবু) ‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে, ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে’—এসব বিচ্ছিন্ন আখ্যান বহু চর্চিত, আমরাও তা নানা লেখায় জানিয়েছি। ফলে সারা পৃথিবীর পাঠক ইংরেজিতে এবং ইংরেজি থেকে তাদের ভাষায় অনুবাদে, মূল বাংলার কতটা রইল আর কতটা রইল না এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি, যা পেয়েছে তাই তাদের জন্য যথেষ্ট ও অসামান্য বলে মনে করেছে। তাদের মনে কোনো অভাববোধ ছিল না ইংরেজি গীতাঞ্জালি নিয়ে, ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, রুশ, জাপানি, চীনা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি সুদূর আইসল্যান্ডিক ভাষায় তার গ্রহণের ইতিহাস আমাদের এই বিশ্বাসই উপহার দেয়।
কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনুবাদ আর অনুবাদের অনুবাদ সারা ইউরোপের ভাষায় সুলভ হয়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যেই ফরাসি অনুবাদটির ৩৫টির সংস্করণ হয়, অন্য ভাষার অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটে। এখনো পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথের মূল পরিচয় মূলত গীতাঞ্জলির রচয়িতা হিসেবে। ভাবুন তো একবার, যে অনুবাদের অসম্পূর্ণতা নিয়ে দেশের আর বিদেশের মস্ত মস্ত মাথা ঘর্মাক্ত হয়েছে, পৃথিবীর বৃহৎ জনমত তাকে গ্রাহ্যই করেনি।
এর একটি পার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণও আছে। ইংরেজি গীতাঞ্জলি পদ্য ছন্দে রচিত নয়, তা একটু পুরোনো বাইবেলি ঢংয়ের গদ্যে রচিত, তার মধ্যে একটি অসামান্য অন্তর্গত ছন্দ আছে। এই গদ্য কবিতার ছন্দ চীনা, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় নতুন কাব্যরীতির জন্ম দিয়েছে। এমনকি, আইসল্যান্ডিক ভাষার নোবেল পুরস্কার-জয়ী ঔপন্যাসিক হ্যালডার লাখনেস আমাদের জানিয়েছেন, এই আইসল্যান্ডিক ভাষায়ও নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে গীতাঞ্জলির প্রভাব কাজ করেছিল। স্প্যানিশে নোবেল-জয়ী কবি হূয়ান রামন হিমেনেথ ও তাঁর স্ত্রী সেনোবিয়া রবীন্দ্রনাথের প্রধান অনুবাদক, হিমেনেথের কাজের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পাশ্চাত্য সমালোচকদের চোখ এড়ায়নি। রবীন্দ্রচর্চার সূত্রেই এই দুটি তরুণ-তরুণী কাছাকাছি এসেছিলেন, দাম্পত্য বন্ধনে বদ্ধ হয়েছিলেন।
তবু আমরা বাঙালিরা, হয়তো আরও বেশ কিছু ভারতীয়, জানি যে বাংলা গীতাঞ্জলির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা ইংরেজি গীতাঞ্জালিতে নেই, তার তা অর্জন করার কোনো উপায়ই ছিল না। সে বই নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে কবিকে, বাংলা ভাষাকে, ভারত আর এশিয়াকে, কিন্তু সে বই এই একটি বিষয়ে বড় দিদি বাংলা গীতাঞ্জলির কাছে দরিদ্র হয়ে আছে। সেই জন্য তা বাঙালির প্রতিদিনকার সঙ্গী হতে পারেনি।
তা হলো, বাংলা গানগুলোর সুর। এই সুরের অভাব ইংরেজি কবিতাগুলোকে অন্তত ইংরেজি-জানা বাঙালিদের কাছেও একটু দূরবর্তী করে রেখেছে। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে’ থেকে শুরু করে ‘সার্থক জনম আমার’, কিংবা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ কিংবা ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ কিংবা ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’ কিংবা ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ ইত্যাদি গান (সব ‘গীত’-এর সুর দেননি রবীন্দ্রনাথ), রবীন্দ্র-আলোকপ্রাপ্ত বাঙালিদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীর উচ্চারণ হয়ে গেছেন। ইংরেজি গীতাঞ্জালির কবিতার বিশ্বব্যাপী মাহাত্ম্য বাঙালির কাছে সেগুলোকে এভাবে প্রাত্যহিকের সম্পদ করে তুলতে পারেনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে যত বাঙালি বাংলা গীতাঞ্জলির নানা গানের সঙ্গে দিন কাটায়, তার তুলনায় খুব কমসংখ্যক বাঙালিই এভাবে ইংরেজি গীতাঞ্জালির কাছে সঙ্গ চায়। বিদেশিরা আবার বাংলা গীতাঞ্জলির অভাবিত সংগীত সম্পদের খবর কমই রাখে, ইংরেজি বইটিই তাদের চিরপথের সঙ্গী।
দুটির প্রভাবের ক্ষেত্র আলাদা, গ্রহণের এলাকা ভিন্ন। দুটিই অসামান্য সম্পদ, বিশ্ব-সংস্কৃতির। দুয়ের মধ্যে খুনসুটির যে নাটক আমরা আরোপ করছি, তা নেহাতই ছেলেমানুষি। আশা করি, এই চপলতাটুকু মার্জনীয়।
দুটি আলাদা বই
দুটি বই। একটি বাংলা, একটি ইংরেজি। একটি আরেকটির হুবহু অনুবাদ নয়, তবু নাম অংশত এক। একটি শুধুই গীতাঞ্জলি আরেকটি ইংরেজিতেওগীতাঞ্জলি, কিন্তু তার একটি উপনামও ছিল, প্রায় অনুবাদই সেটা—সং অফারিংস । বাংলা গীতাঞ্জলি বেরোয় ১৩১৭ সালের শ্রাবণ মাসের শেষে (৩১ শ্রাবণ, ১৩১৭), ইংরেজি ১৯১০-এর আগস্টের মাঝামাঝি। আর ইংরেজি গীতাঞ্জলি মুদ্রিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে, ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর। দুটি বই শারীরিকভাবে আলাদা, ভাষা আলাদা, প্রকাশকালের মধ্যে দুই মাসের একটু বেশি ব্যবধান। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, বাঙালির চেতনায় এ দুটি বই যেন একই কক্ষে স্থান করে নিয়েছে। যে গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার পেল, তা বাংলা বইটি নয়, সেটি ইংরেজি গীতাঞ্জলি: সং অফারিংস। তা সত্ত্বেও বাঙালির প্রতিদিনকার বাক্যালাপে, শিশু ও ছাত্রপাঠ্য রচনা বইয়ে চটজলদি লিখে ফেলা সংবাদ নিবন্ধে, এই লোকশ্রুতি বারবার প্রচারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কোন গীতাঞ্জলি, তা নির্দিষ্ট করা হয় না, বড়জোর বলা হয় যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ করে ওই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কেন জানি না, এই আবেগবিন্দুতে পৌঁছে বাঙালির জিজ্ঞাসা সুনির্দিষ্ট তথ্যকে ছুঁতে চায় না, অপ্রাসঙ্গিকবোধে তুচ্ছ করে বা এড়িয়ে যেতে চায়।
অথচ বিশেষজ্ঞরা জানেন, দুটি বই নানা দিক থেকে পৃথক। কতগুলো মামুলি তুলনার প্রসঙ্গ এনে জানানো যায়, প্রথমটির ভাষা বাংলা, দ্বিতীয়টির ইংরেজি। প্রথমটিতে ছন্দমিলযুক্ত কবিতা, দ্বিতীয়টিতে গদ্যছন্দের একমাত্রিক প্রয়োগ। প্রথমটিতে ১৫৮টি কবিতা বা গান, যার মাত্র ৫৩টির অনুবাদ দ্বিতীয়টিতে আছে। দ্বিতীয়টিতে কবিতা সুরহীন, তার সংখ্যা ১০৩। তাতে আর যেসব বই থেকে অনুবাদ স্থান পেয়েছে তার মধ্যে আছে নৈবেদ্য থেকে ১৭টি (এ বইয়ের ৮৯-৯০ সংখ্যক দুটি কবিতাকে একটি কবিতা হিসেবে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ), গীতিমাল্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে তিনটি, অচলায়তন, চৈতালি, কল্পনা, উৎসর্গ থেকে একটি করে। এ ছাড়া আরও দুটি পরবর্তী রচনা জুড়ে দেন অনুবাদে। ও দুটি ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর রচিত হয়েছিল।
আলাদা, তবুও এক
দুটি বই আলাদা, তবু দুটি বই এক। এর কারণ শুধু গণিতের হিসাব নয়, অর্থাৎ বাংলা গীতাঞ্জলির মোট ৫৩টি গান ইংরেজিতে স্থান পেয়েছে বলে নয়। দুটিরই মূল কথা এক ধরনের পূজা ও আত্মনিবেদন। কাকে পূজা, কার কাছে আত্মনিবেদন? একজন ‘ঈশ্বর’কে, একজন ঈশ্বরের কাছে। কে রবীন্দ্রনাথের এই ঈশ্বর।
এ নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্য ও ভাবুকতাপূর্ণ গবেষণা হয়েছে, আমরা আর সে পথে অগ্রসর হব না। আমরা যে অনুমান করব, তা না মানার স্বাধীনতা সব পাঠকেরই অধিকারে থাকবে। আমাদের মতে, এই ঈশ্বর ‘জীবন’ নামক বিশাল অভিজ্ঞতারই একটি রূপকায়িত মূর্তি। যে জীবন পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট থেকে সব মানুষ পেয়েছে, অথচ যে জীবনের অনেক কিছুই সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বরং এই বিপুল, অন্তহীন, অনির্দিষ্ট, অবোধ্য জীবনের অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা তার কারণ বুঝতে পারি না। তার শক্তির কাছে আমরা তুচ্ছ, তার উদাসীন ক্রিয়াকলাপে আমরা স্তম্ভিত থাকি। এই জীবনের প্রবল অভিঘাত কখনো কখনো আমাদের বাধ্য করে তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। মৃত্যুও এই জীবনেরই আরেক রূপ, সে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পিতামাতা, নাথ, প্রভু, রাজা, বন্ধু—সব রকম রূপে-রূপকেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ভাষা হয়তো ধর্মগ্রন্থের স্মৃতি বহন করে, কিন্তু বৃহৎ জীবনের কাছে নিজেকে সমর্পণই বাংলা আর ইংরেজি গীতাঞ্জলির মূল আখ্যান। এর আগে আমাদের মতে, ‘জীবনদেবতা’ বলতে তিনি এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন। জীবনদেবতা ‘জীবনের দেবতা’ নন, যা জীবন সেই দেবতা, রূপক কর্মধারয়, ‘জীবনরূপী দেবতা’।
কেন এই ঈশ্বরের কথা সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠল ওই সময়ে
আমাদের ধারণা, উপনিষদীয় ধর্মবোধ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনার মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে নিহিত হয়েছিল। কারণ, তাঁর দেশপ্রেমের একটা মূল কথা আত্মশক্তির উদ্বোধন, আর এই আত্মশক্তির একটি উৎস নিশ্চয়ই ঈশ্বর। ১৮৯১ নাগাদ চিত্রা পর্বে তিনি ওই একজন ‘জীবনদেবতা’কে পেয়েছেন অবলম্বন হিসেবে, হয়তো তাঁর ওই সময়ের অফুরন্ত সৃষ্টিপ্রেরণার ব্যাখ্যা হিসেবে।
কিন্তু গীতাঞ্জলিতে এসে যে ঈশ্বরের উপস্থিতি তাঁর কাছে অনেক বেশি জরুরি মনে হবে, তিনি আরেক ঈশ্বর, অনেক ব্যক্তিগত ঈশ্বর। নৈবেদ্য থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নৈবেদ্য থেকেই একটি প্রচ্ছন্ন মৃত্যুচেতনার আভাস লক্ষ করি তাঁর মধ্যে—মৃত্যু যখন মৃত্যুর রূপ ধরে (১৪) তখন তাঁর ঈশ্বর তা থেকে তাঁকে পরিত্রাণ এনে দেন। ‘নিন্দা ও ক্ষতি, মৃত্যু-বিরহ, কত বিষবাণ উড়ে অহরহ’ (১১), ‘পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত আমার ঘরের দ্বারে, তব আহ্বান করি সে বহন পার হয়ে এল পারে।’ (১৮)
কার মৃত্যুর কথা বলছেন কবি? এর মধ্যে তাঁর জীবনে অনেক নিকটজনের মৃত্যু ঘটে গেছে। ১৮৯৯-এ প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ চলে গেছেন নৈবেদ্য-এর কবিতাগুলো লেখার ঠিক আগে, ওই মৃত্যুই কি তাঁর অন্তর্যাত্রার সূত্রপাত করেছে? ১৯০২-এ স্ত্রী মৃণালিনী (সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি,/...একাকীর পথে চলিব জগতে/সেই ভালো মোর সেই ভালো’—স্মরণ), ১৯০৩-এ মেজো মেয়ে রানী, ওই বছরেই শান্তিনিকেতনের তরুণ শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়; পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ চলে গেলেন ১৯০৬-এ, অত্যন্ত প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ হঠাৎ মুঙ্গেরে গিয়ে কলেরায় মৃত্যুবরণ করলেন ১৯০৭-এ। কৃষ্ণ কৃপালনি বলেছেন, এটিই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শোক। ১৯০৮-এ মৃত্যু হলো মেজ জামাই সত্যেন্দ্র ভট্টাচার্যের, মেজ মেয়ে রানীর মৃত্যুর পাঁচ বছর কাটতে না কাটতেই।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর শোককে বহন আর ধারণ করার ক্ষমতা। যে আঘাত আসছে তাকে গ্রহণ করছেন, ভেতরকার ভাঙচুর বাইরে কেউ টের পাচ্ছে না। এমনকি শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কথাও পরে জানাচ্ছেন মীরা দেবীকে চিঠিতে—
শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসেত আসেত দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়ছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, পড়েনি—সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে। সমস্তের জন্যে আমার কাজ বাকি রইল।
গত শতাব্দীর গোড়ায় তাঁর ব্যক্তিগত শোকের তালিকা তৈরি করি আমরা, কিন্তু সেই সঙ্গে এও তালিকা করতে হয় যে বঙ্গদর্শন-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিচ্ছেন ওই ১৯০১ সালেই, তাতে পর পর দুটি উপন্যাস প্রকাশ করবেন, চোখের বালি (১৯০৩) আর নৌকাডুবি (১৯০৬)। ১৯০০-তেই প্রকাশিত হচ্ছে চারটি কবিতার বই—কথা, কাহিনী, কল্পনা, ক্ষণিকা—এর মধ্যে শেষেরটির আপাত লঘুতা তো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সন্ধিক্ষণের কবিতার বই খেয়া প্রকাশিত হবে ১৯০৬-এ, পাঁচটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হবে ১৯০৭-এ—বিচিত্র প্রবন্ধ, চারিত্রপূজা, প্রাচীন সাহিত্য, লোকসাহিত্য, সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, তার বাইরেও প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হবে। ১৯০৭-এই প্রকাশিত হবে দুটি কৌতুকনাট্যের সংকলন, হাস্যকৌতুক আর ব্যঙ্গকৌতুক। ১৯১০-এর মধ্যে আরও বেরিয়ে যাবে উপন্যাস প্রজাপতির নির্বন্ধ, গোরা, প্রবন্ধ ‘পাবনা সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণ’, প্রবন্ধ গ্রন্থসম্ভার রাজা প্রজা, স্বদেশ, সমূয়, সমাজ, শিক্ষা, শব্দতত্ত্ব, ধর্ম, শান্তিনিকেতন ১-৮, ৯-১১, বিদ্যাসাগর-চরিত, নাটক ও নাটিকা শারদোৎসব, মুকুট, প্রায়শ্চিত্ত, কবিতাগ্রন্থ শিশু।
মনে রাখতে হবে, এরই মধ্যে ১৯০৫-এর অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে স্বচ্ছন্দে নেতৃত্ব দেবেন, অসংখ্য দেশাত্মবোধক সংগীত রচনা করবেন, বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে তাঁর দিকনির্দেশ করবেন, ১৯০৮-এ পাবনায় জাতীয় সম্মেলনীর সভাপতিত্ব করবেন, তাঁর বিকল্প দেশসাধনার কথা বলবেন সভাপতির অভিভাষণে, সন্তান রথীন্দ্রনাথ আর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য, ১৯০৭ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত প্রবাসীতে শত শোকের মধ্যেও গোরার কিস্তি নিয়মিত পাঠানোতে ব্যত্যয় ঘটবে না। তবু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উন্মাদনায় ক্লান্তি ও অবসাদের খবর পাই দু-একটি গানে (‘সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে?’) প্রয়োজন হলে নিজেকে নানা প্রকোষ্ঠে ভাগ করে, প্রতিটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে এই নিশ্ছিদ্র বিভাজন রক্ষা করা হয়তো একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তবু ভেতরকার বিষাদ ও অসহায়তা, কোনো একটা বড় অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা ধরা পড়েছে ১৯১০ থেকে ১৯১৪, এ চার বছরের মধ্যে। এর মধ্যে প্রকাশিত হবে আরও দুটি গানের বই—গীতিমাল্য আর গীতালি; অসাধারণ দুটি নাটক রাজা আর ডাকঘর; শান্তিনিকেতন-এর আরও দুটি প্রবন্ধ, যেগুলো তাঁর এই পর্বের বিশেষ লক্ষণের দ্বারা চিহ্নিত। এমন নয় যে তাঁর বহির্জীবনের কর্মকে তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন, কিংবা তাঁর সৃষ্টির বিপুল বৈচিত্র্য কোনোভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তবু প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের হিসাবমতো, ১৩১৬ সালের ১০ ভাদ্র থেকে ১৩১৭-র ২৯ শ্রাবণ পর্যন্ত গীতাঞ্জলির এই সৃষ্টিপর্বকে নিভৃত প্রাণের দেবতার সঙ্গে তাঁর বিচিত্র সাক্ষাৎকারও চলেছে এই সময়ে। এ পর্ব তিনি অতিক্রমও করে যাবেন ১৯১৪-তেই, বলাকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালিতে তিনি মুখোমুখি হবেন তাঁর ‘ঈশ্বর’-এর, যাঁকে তিনি নানা মানব-সম্বন্ধেই বাঁধতে চাইবেন, পিতা, মাতা, বন্ধু, প্রভু, নাথ, রাজা—কিছুটা বৈষ্ণব অনুষঙ্গ স্মরণ করে, কিছুটা এক অলীক সামন্ততন্ত্রের রাজাদর্শের উদ্ব্বোধনে, যার সূত্রপাত হবে শারদোৎসব থেকে। গীতাঞ্জলিতে এই একমুখী সংলাপের বাইরে, ‘ঈশ্বর’কে ছেড়ে এসে, পাঠকদের জন্য লেখা কিছু গান বা কবিতা নেই তা নয়, শরৎ ঋতুর গানগুলো তাই, ‘দুর্ভাগা দেশ’ বা ‘ভারত-তীর্থ’ নামে ছাপা কবিতাগুলোও তা-ই।
ইংরেজি গীতাঞ্জলি
সং অফারিংস মূলত তাঁর বাংলা কবিতার অনুবাদ এ কথা আমরা সবাই জানি। অনুবাদ কি না এবং কতটা, এ নিয়ে পরে একটু প্রশ্ন তুলব আমরা। কিন্তু অন্য ভাষায় তাঁর নিজের কবিতা অনুবাদ করার কথা মনে হলো কেন আদৌ? বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে বারবার বলেছেন, তিনি পৃথিবীর কবি, পৃথিবীর মানুষের তাঁর কথা আরও বেশি করে জানা উচিত। এর মধ্যে তিনি বিলেত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতও হয়েছিলেন, কিন্তু বিদায় নেওয়ার বহু বিস্তৃত সক্রিয়তায় অসুস্থ (মূর্ছিত) হয়ে পড়ায় চিকিৎসকের নির্দেশে ১৯১২-র ১৯ মার্চের সেই যাত্রা তাঁকে স্থগিত রাখতে হলো। মাদ্রাজ থেকে ফিরে এলেন তিনি। একটু সুস্থ হয়ে চলে গেলেন শিলাইদহে। সেখানে গীতিমাল্য-এর গান তৈরি হচ্ছে আর একটি-দুটি করে অনুবাদ হচ্ছে কবিতার। ইন্দিরা দেবীকে সেখান থেকে চিঠিতে লিখছেন যে শিলাইদহেই শুরু হয়েছিল তাঁর অনুবাদের কাজ। নিজের ইংরেজির দখল নিয়ে তাঁর সংকোচ ছিল। কৌতুক করে ইন্দিরাকে সে কথা বারবার বলেছেন। এ কথা আমরা কবির বিনয় বলেই মনে করব। ‘তখন চৈত্র মাসে আমের বোলের গন্ধে আকাশে আর কোথাও ফাঁক ছিল না এবং পাখির ডাকাডাকিতে দিনের বেলার সকল কটা প্রহর একেবারে মাতিয়ে রেখেছিল।... তার আলো তার হাওয়া তার গন্ধ তার গান একটুও আমার কাছে বাদ পড়ল না। কিন্তু এমন অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না—হাড়ে যখন হাওয়া লাগে তখন বেজে উঠতে চায়, ওটা আমার চিরকেলে অভ্যাস, জানিস তো। অথচ কোমর বেঁধে কিছু লেখবার মতো বল আমার ছিল না। সেইজন্যে ওই গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি নিয়ে একটি একটি করে ইংরেজিতে তর্জমা করতে বসে গেলুম।’ একটা ছোট খাতার পাতাগুলো আস্তে আস্তে ভরে এল। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেছেন, সেখানেও অনুবাদের কাজ চলেছে। ১৯১২-র ২৭ মে ভেঙে যাওয়া যাত্রার সূত্র তুলে নিলেন, রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীকে নিয়ে মুম্বাই থেকে জাহাজে লন্ডন রওনা হলেন।
ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫) ভারতে এসেছিলেন ১৯১০-এ, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ও হয়েছিল। তিনি মূলত শিল্পী, প্রাচীন ভারতের শিল্প সম্বন্ধে তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা ছিল। শিল্পী হিসেবে মূলত অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গেই তাঁর আদান-প্রদান হয়েছে, কিন্তু তাঁদের আলাপের সময় তাঁদের এই সৌম্যদর্শন পিতৃব্যের উপস্থিতি ও বাক্যালাপ রোদেনস্টাইনকে বিশেষ মুগ্ধ করেছিল। লন্ডনে ফিরে তিনি দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় নিবেদিতার করা রবীন্দ্রনাথের গল্পের (সম্ভবত ‘কাবুলিওয়ালা’) ইংরেজি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আরও পড়তে চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা। গল্প হয়তো পাননি, কিন্তু অজিতকুমার চক্রবর্তীর করা কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ তাঁর হাতে এল, তা পড়ে তিনি আরও বেশি করে মুগ্ধ হলেন, গভীর বিস্ময়ও জাগল তাঁর। এত বড় একজন অধ্যাত্মচেতনার কবি লোকলোচনের বাইরে, ইউরোপের কাছে অজ্ঞাত পড়ে থাকবেন, এ তাঁর অসংগত মনে হলো। তিনি লন্ডনে ব্রাহ্ম নেতা প্রমথলাল সেন আর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে অনুরোধ জানালেন রবীন্দ্রনাথকে যেন অবশ্যই লন্ডনে আসতে লিখে দেন তাঁরা। এলে তাঁকে তিনি সানন্দে অভ্যর্থনা করবেন, আতিথ্য দেবেন। একদিন তাঁর কাছে সেই আনন্দ-সন্দেশ পৌঁছাল যে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে আসছেন। নিশ্চয় তাঁর কবিতার তাগাদাও রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল।
রোদেনস্টাইনের সঙ্গে দেখা হতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে অনুবাদের ছোট খাতাটি তুলে দিলেন। পড়ে রোদেনস্টাইন আপ্লুত, পড়ে সমগ্র পৃথিবী আপ্লুত হবে। সে ইতিহাস বহুচর্চিত। তবু ঘটনাক্রমের একটা তালিকা করা যায়...
১২ জুন, ১৯১২: লন্ডনে পৌঁছালেন।
১২ জুলাই, রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা হলো, ইয়েটসসহ বহু ইংরেজ কবি লেখক (প্রধানদের মধ্যে ইয়েট্স ছাড়া রবার্ট ব্রিজেস, আরনেস্ট রিজ, টমার্স স্টার্জ মুর, আর সি ট্রেভেলিয়ান আর এজরা পাউন্ড) তাঁর কবিতাপাঠ শুনে অভিভূত হলেন। সেখানেই স্থির হলো, কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
১ নভেম্বর, লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি সং অফারিংস প্রকাশ করলেন। পরে লন্ডনের ম্যাকমিলান কোম্পানি বইটি প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ রোটেনস্টাইনকেই বইটি উৎসর্গ করবেন।
এক বছর কয়েক দিন পরে (১২ নভেম্বর, ১৯১৩) শান্তিনিকেতনে খবরে এসে পৌঁছাল, প্রথম এশীয় কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন, সেখানে পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে তাঁকে একাধিক বক্তৃতা দিতে হয়েছে। বাংলা আর ভারতের গণ্ডি উত্তীর্ণ হয়ে পৃথিবীর নাগরিক হতে চলেছেন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে সম্ভাষণ করছেন সমগ্র বিশ্বসমাজকে। ১৯১২-র এই পশ্চিমযাত্রা তাঁর বিশ্বনাগরিকত্বের ভূমিকা রচনা করেছে, নোবেল পুরস্কার তাঁকে পুরোপুরি পৃথিবীর মানুষ করে তুলবে, শুধু বাঙালিত্বে আবদ্ধ রাখবে না।
দুই গীতাঞ্জলি: মূল, অনুবাদ?
বাংলা গীতাঞ্জলিকে ইংরেজি সং অফারিংস খ্যাতির দৌড়ে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। বাংলা গীতাঞ্জলি প্রকাশের সময় বাঙালি পাঠক মহলে এ নিয়ে খুব তুমুল কিছু হইচই হয়নি, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু ইংরেজি গীতাঞ্জালি: সং অফারিংস -এর কথা একেবারেই আলাদা। শুধু লন্ডনের বিদ্বৎসমাজে নয়, তা সাহিত্যে সর্বোত্তম পুরস্কার লাভের পর সারা পৃথিবীর সমাদর লাভ করেছে, এক মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথকে ‘আমি পৃথিবীর কবি’ এই সংগত দাবি করার যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। এ কারণে বড়দিদি বাংলা গীতাঞ্জলি-র একটু অভিমান হতেই পারে। সে শুধু পড়ে রইল বাংলা ভাষার ছোট গণ্ডির মধ্যে, সারা পৃথিবী তার কথা জানলই না। ছোট বোনের ঠাঁই হলো বিশ্বসভায়।
ওপরের কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। যেসব বিদেশি বাংলা ভাষা লিখে বাংলা গীতাঞ্জলি পড়েছেন, তাঁরা অবশ্য বুঝেছেন, বাংলার মধ্যে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে এবং অনুবাদে তার কতটাই বা হারিয়ে গেছে। জার্মানভাষী মার্টিন কেম্পশেন বলেছেন এই রকম কথা, ইংরেজ কবি জো উইন্টার বাংলা গীতাঞ্জলিকে পুরো আবার অনুবাদ করেছেন ছন্দ ও মিলের কাব্যভাষায়। বহু দ্বিভাষী বাঙালিও, যেমন বুদ্ধদেব বসু, নবনীতা দেব সেন প্রভৃতি অনুযোগ করেছেন যে হায়, অধিকাংশ অনুবাদে মূলের অনেকটাই তো হারিয়ে গেছে। কেন রবীন্দ্রনাথ এমন করলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁদের এ নিয়ে অভিযোগ কম নয়। আমেরিকার মেরি লেগোও তাঁর ইংরেজি রবীন্দ্র-জীবনীতে ‘শ্রাবণঘন গহন মোহে’ গানটির আক্ষরিক আর রবীন্দ্রনাথকৃত অনুবাদ তুলে দিয়ে এই অভিযোগ থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিষ্কৃতি দেননি। এঁরা সবাই বাংলা আর ইংরেজি দুটো ভাষাই জানতেন বলে রবীন্দ্রনাথের এই বিপত্তি। কেউ কেউ আবার এমন অভিযোগ করেছেন যে, ঔপনিবেশিক এক কবি সাম্রাজ্যবাদের ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে কিছুটা খাতির করেছেন, তাঁর কী পছন্দ হতে পারে সেটা ভেবে নিয়ে নিজের কবিতাকে ছাঁটকাট করেছেন।
আমাদের বক্তব্য একটু অন্য রকম। আমরা বলি, সং অফারিংস -কে বাংলা উৎসের অনুবাদ হিসেবে ধরবেন না। তা ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা। হ্যাঁ, অনেক কবিতার ক্ষেত্রেই মূলের একটা কবিতাকে তিনি অনুসরণ করেছেন, কিন্তু কখনো কখনো তা যে করেননি, তার অধিকার কি তাঁর ছিল না? তাঁকে আমরা সাধারণ অনুবাদক হিসেবে দেখব কেন? সাধারণ পেশাদার অনুবাদকেরা ‘অন্যের’ লেখা অনুবাদ করেন, তাঁদের আমরা বেশি স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ভাবি না, কারণ তাঁরা মূলের স্রষ্টা নন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেখানে একই সঙ্গে স্রষ্টা আর অনুবাদক, সেখানে তাঁর স্বাধীনতা কি সাধারণ অনুবাদকের মতোই হবে, তার বেশি নয়? ইংরেজিতে এক আত্মস্বতন্ত্র কবি হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে আমাদের বাধা কোথায়?
ইংরেজি গীতাঞ্জালির সাফল্যকাহিনি বহু জ্ঞাত ও বহু প্রচারিত, তা নিয়ে এখানে নতুন করে বলার পরিসর নেই। কীভাবে ইয়েটস ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য বুধজন এর পাঠ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, কীভাবে ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই’-এর অনুবাদ প্রথম মহাযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে ইংরেজ কবি উইলফ্রেড আওয়েনকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, কীভাবে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা নিয়ৎ ১৯৬৪ সালে নিজের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে তাঁর ভাষায় বলে উঠেছিলেন, (কোনো গীতাঞ্জলির নয় এ গান, তবু) ‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে, ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে’—এসব বিচ্ছিন্ন আখ্যান বহু চর্চিত, আমরাও তা নানা লেখায় জানিয়েছি। ফলে সারা পৃথিবীর পাঠক ইংরেজিতে এবং ইংরেজি থেকে তাদের ভাষায় অনুবাদে, মূল বাংলার কতটা রইল আর কতটা রইল না এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়নি, যা পেয়েছে তাই তাদের জন্য যথেষ্ট ও অসামান্য বলে মনে করেছে। তাদের মনে কোনো অভাববোধ ছিল না ইংরেজি গীতাঞ্জালি নিয়ে, ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, রুশ, জাপানি, চীনা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি সুদূর আইসল্যান্ডিক ভাষায় তার গ্রহণের ইতিহাস আমাদের এই বিশ্বাসই উপহার দেয়।
কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনুবাদ আর অনুবাদের অনুবাদ সারা ইউরোপের ভাষায় সুলভ হয়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যেই ফরাসি অনুবাদটির ৩৫টির সংস্করণ হয়, অন্য ভাষার অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটে। এখনো পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথের মূল পরিচয় মূলত গীতাঞ্জলির রচয়িতা হিসেবে। ভাবুন তো একবার, যে অনুবাদের অসম্পূর্ণতা নিয়ে দেশের আর বিদেশের মস্ত মস্ত মাথা ঘর্মাক্ত হয়েছে, পৃথিবীর বৃহৎ জনমত তাকে গ্রাহ্যই করেনি।
এর একটি পার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণও আছে। ইংরেজি গীতাঞ্জলি পদ্য ছন্দে রচিত নয়, তা একটু পুরোনো বাইবেলি ঢংয়ের গদ্যে রচিত, তার মধ্যে একটি অসামান্য অন্তর্গত ছন্দ আছে। এই গদ্য কবিতার ছন্দ চীনা, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় নতুন কাব্যরীতির জন্ম দিয়েছে। এমনকি, আইসল্যান্ডিক ভাষার নোবেল পুরস্কার-জয়ী ঔপন্যাসিক হ্যালডার লাখনেস আমাদের জানিয়েছেন, এই আইসল্যান্ডিক ভাষায়ও নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে গীতাঞ্জলির প্রভাব কাজ করেছিল। স্প্যানিশে নোবেল-জয়ী কবি হূয়ান রামন হিমেনেথ ও তাঁর স্ত্রী সেনোবিয়া রবীন্দ্রনাথের প্রধান অনুবাদক, হিমেনেথের কাজের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পাশ্চাত্য সমালোচকদের চোখ এড়ায়নি। রবীন্দ্রচর্চার সূত্রেই এই দুটি তরুণ-তরুণী কাছাকাছি এসেছিলেন, দাম্পত্য বন্ধনে বদ্ধ হয়েছিলেন।
তবু আমরা বাঙালিরা, হয়তো আরও বেশ কিছু ভারতীয়, জানি যে বাংলা গীতাঞ্জলির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা ইংরেজি গীতাঞ্জালিতে নেই, তার তা অর্জন করার কোনো উপায়ই ছিল না। সে বই নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে কবিকে, বাংলা ভাষাকে, ভারত আর এশিয়াকে, কিন্তু সে বই এই একটি বিষয়ে বড় দিদি বাংলা গীতাঞ্জলির কাছে দরিদ্র হয়ে আছে। সেই জন্য তা বাঙালির প্রতিদিনকার সঙ্গী হতে পারেনি।
তা হলো, বাংলা গানগুলোর সুর। এই সুরের অভাব ইংরেজি কবিতাগুলোকে অন্তত ইংরেজি-জানা বাঙালিদের কাছেও একটু দূরবর্তী করে রেখেছে। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে’ থেকে শুরু করে ‘সার্থক জনম আমার’, কিংবা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ কিংবা ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ কিংবা ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’ কিংবা ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ ইত্যাদি গান (সব ‘গীত’-এর সুর দেননি রবীন্দ্রনাথ), রবীন্দ্র-আলোকপ্রাপ্ত বাঙালিদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীর উচ্চারণ হয়ে গেছেন। ইংরেজি গীতাঞ্জালির কবিতার বিশ্বব্যাপী মাহাত্ম্য বাঙালির কাছে সেগুলোকে এভাবে প্রাত্যহিকের সম্পদ করে তুলতে পারেনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে যত বাঙালি বাংলা গীতাঞ্জলির নানা গানের সঙ্গে দিন কাটায়, তার তুলনায় খুব কমসংখ্যক বাঙালিই এভাবে ইংরেজি গীতাঞ্জালির কাছে সঙ্গ চায়। বিদেশিরা আবার বাংলা গীতাঞ্জলির অভাবিত সংগীত সম্পদের খবর কমই রাখে, ইংরেজি বইটিই তাদের চিরপথের সঙ্গী।
দুটির প্রভাবের ক্ষেত্র আলাদা, গ্রহণের এলাকা ভিন্ন। দুটিই অসামান্য সম্পদ, বিশ্ব-সংস্কৃতির। দুয়ের মধ্যে খুনসুটির যে নাটক আমরা আরোপ করছি, তা নেহাতই ছেলেমানুষি। আশা করি, এই চপলতাটুকু মার্জনীয়।
No comments