৬ যুবকের স্বীকারোক্তি- মূল ‘অপহরণকারী’ এখনো ধরা পড়েনি

শিশু পরাগ মণ্ডলকে অপহরণের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গত বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ ও জুরাইন এলাকা থেকে তাঁদের আটক করা হয়। তবে কথিত মূল অপহরণকারী আমিরসহ তিনজন এখনো পলাতক।


র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, পরাগকে অপহরণের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আমিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তার হলে টাকা লেনদেনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, শিশুটির বাবা বিমল মণ্ডলের জমি দখল করার জন্য ভয় দেখাতে শিশুটিকে অপহরণ করা হয়েছে। এর পেছনে প্রভাবশালী এক নেতার হাত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত রোববার (১১ নভেম্বর) সকালে কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ী বিমল মণ্ডলের স্ত্রী, মেয়ে ও গাড়িচালককে গুলি করে তাঁর ছেলে পরাগকে তুলে নিয়ে যান অপহরণকারীরা। এর তিন দিন পর মঙ্গলবার রাতে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরাগকে তার বাবা ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন বলে র‌্যাব জানালেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, তারা অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে।
পরাগ অপহরণের ঘটনায় প্রথমে আমিরের প্রথম স্ত্রীর ভাই ব্যবসায়ী মামুন হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর রাতে রাজধানীর জুরাইন এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। মামুনকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে (হেফাজতে) নেওয়া হয়। মামুনের প্রথম স্ত্রী ইতি ও তাঁর এক সন্তানকেও পুলিশ আটক করেছে।
ছয়জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় গতকাল দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় ছয় ব্যক্তির সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন: মোহাম্মদ আলী রিফাত (১৯), জাহিদুল হাসান (১৮), কালাচান (৩৫), রিজভী আহমেদ অনিক (১৮), আলফাজ হোসেন (১৮) ও আবুল কাশেম (৩৩)। কাশেম অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী আমিরের ভগ্নিপতি। অপহরণের পর আমিরের সহযোগীরা কাশেমের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ছাড়া পরাগকে অপহরণ করার সময় দুর্বৃত্তদের ব্যবহূত দুটি মোটরসাইকেলের একটি উদ্ধার করা হয়।
কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, র‌্যাব-১০-এর একটি দল অভিযান চালিয়ে গতকাল রাত দেড়টার দিকে অনিকের জুরাইনের বাড়ি থেকে রিফাত, জাহিদুল ও কালাচানকে আটক করে। আলফাজকেও ওই এলাকা থেকে আটক করা হয়।
‘অপহরণকারী’দের মুখে ঘটনার বর্ণনা: সংবাদ সম্মেলনে অপহরণকারীদের সবাইকে হাজির করে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। সাংবাদিকেরা তাঁদের নানা প্রশ্ন করেন। এসব প্রশ্নের জবাবে অটোরিকশাচালক কালাচান বলেন, বিমল মণ্ডলের পরিবারের লোকজনের আসা-যাওয়ার তথ্য না জানালে তাঁকে গুলি করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন আমির। এক সপ্তাহ আগে থেকে তাঁরা এসব তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। আর তথ্য জানালে তাঁকে একটি নতুন অটোরিকশা কিনে দেওয়া হবে বলে লোভ দেখানো হয়। লোভে পড়ে তিনি কয়েক দিন ধরে ওই পরিবারের সদস্যদের ওপর নজর রাখছিলেন। আর প্রতিদিনই এসব খবর আমিরকে জানাতেন। এ জন্য তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন আমির। তবে পরাগকে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, তা তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
অপহরণে সরাসরি অংশ নেওয়া জাহিদুল ও রিফাত সাংবাদিকদের জানান, অপহরণের বিষয়ে তাঁরা আগে থেকে কিছু জানতেন না। কেরানীগঞ্জের একটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী জাহিদুল হাসান জানান, অপহরণের দিন তিনি ও রিফাত ঘটনাস্থলে ছিলেন। তবে তাঁরা অপহরণে অংশ নেননি। ঘটনার কয়েক দিন আগে আমির তাঁকে একটি ফোন কিনে দিয়ে সেটি ব্যবহার করতে বলেন। জাহিদ দাবি করেন, জমি কেনাবেচার টাকা উদ্ধারের জন্য আমির মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন। তাঁর কথায় রিফাতকে নিয়ে সেখানে যান তিনি। সেখানে বালু রাখা একটি জায়গায় থেমে তিনি দেখতে পান, আমির গুলি করে একটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমির মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ছিলেন। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন আলামিন। তাঁরা বাচ্চাটাকে মাঝখানে বসিয়ে কেরানীগঞ্জের কোনাখোলার দিকে চলে যান। এরপর তাঁরা আমিরের সঙ্গে কিছু পথ গিয়ে সেতুর নিচে কদমতলীর রাস্তা ধরে বাসায় ফিরে যান বলে দাবি করেন জাহিদ। তিনি বলেন, ওই সময় দুটি মোটরসাইকেলে চারজন ছিলেন, তাঁদের হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। গুলি করেছেন আমির একাই। আমিরের পিছু পিছু কিছু সময় যাওয়ার পর তাঁরা নিজ নিজ বাসায় চলে যান বলে দাবি করেন।
জাহিদ বলেন, ‘পরদিন আমার পরীক্ষা ছিল। কিন্তু এত বড় একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। এ কারণে মঙ্গলবার রাতে আমিরের ভগ্নিপতির বাসায় আশ্রয় নিই। পরদিন সেখান থেকে জুরাইনে চলে যাই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ জানান, তিনি আমিরকে চেনেন কয়েক বছর আগে থেকে। আমির এর আগে জেল খেটেছেন।
জাহিদের সঙ্গে থাকা রিফাত জানান, তিনি বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেসরকারি একটি বিমান সংস্থায় পড়াশোনা করছেন। প্রতি মাসে তাঁর ১৮ হাজার টাকা করে লাগে। তাঁর বাবা এ টাকা দিতে পারেন না। আমির প্রতি মাসে এই খরচ দেওয়ার কথা বলে তাঁকে দলে ভেড়ান। ঘটনার দিন জাহিদের সঙ্গে থাকার কথা উল্লেখ করে রিফাত বলেন, ঘটনার সময় আমির ও জাহিদ দুজনেই গুলি ছোড়েন। শিশুটিকে তুলে নেওয়ার পর থেকে আমিরের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। তবে তিনি ফোনে শুনেছেন, ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার পর বাচ্চাটাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কোন সময় এবং কীভাবে বাচ্চাটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
আমির মূল ‘পরিকল্পনাকারী’: এঁদের কথায় বোঝা যায়, আবুল কাশেমের শ্যালক আমিরই এই অপহরণকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। জাহিদসহ তিনজন ঘটনার দিন রাতে কাশেমের বাসায় গিয়েছিলেন। তবে সংবাদ সম্মেলনে কাশেম দাবি করেন, অপহরণের ঘটনা তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, ‘জাহিদ আগেও কয়েকবার আমিরের সঙ্গে বাসায় এসেছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে জাহিদসহ তিনজন আমার বাসায় আসে। বুধবার সকালে নাশতা খেয়ে আবার চলে যায়।’ আমিরের ভগ্নিপতি জানান, আমির জেলে ছিলেন। এক মাস আগে জেল থেকে বের হয়ে তিনি কী করতেন, তা তাঁর জানা নেই। অপহরণের ব্যাপারে তিনি কিছু জানতেন না। মঙ্গলবার রাতে জাহিদুল, রিফাত ও কালাচান তাঁর বাসায় গিয়ে আমিরের খোঁজ করেন।
বিমল নিজেই দর-কষাকষি করেন: র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, এ ঘটনার পর পরাগের বাবা বিমল মণ্ডল কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। তিনি নিজেই অপহরণকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষি করেন। একপর্যায়ে অপহরণকারীদের কথামতো তিনি নিজেই এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে যান। এরপর অপহরণকারীরা শিশুটিকে ছেড়ে দেন। তিনি বলেন, আমির, জাহিদ, রিফাত, আলামিন, আকাশ ও কালাচান এই দলে ছিলেন। এঁদের মধ্যে তিনজনেক গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমির, আলামিন ও আকাশ এখনো পলাতক। তাঁরা জানিয়েছেন, ঘটনার সময় দুটি মোটরসাইকেলের একটিতে আমির ও আলামিন ছিলেন, আরেকটিতে ছিলেন জাহিদ ও রিফাত। ঘটনার পর এঁরা সবাই প্রথম দিন নিজ নিজ বাসায় রাত কাটান। এরপর ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তাঁরা প্রথম দিন আমিরের দুলাভাই আবুল কাশেমের বাসায় চলে আসেন। পরদিন সবাই মিলে জুরাইনে অনিকের বাসায় চলে যান। সেই বাসা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। তবে অপহরণের পর বাচ্চাটিকে কোথায় রাখা হয়েছিল, তা এঁরা বলতে পারেননি। ধারণা করা হচ্ছে, এই চক্রের গোপন কোনো আস্তানা আছে, যেখানে বাচ্চাটিকে রাখা হয়েছিল।
র‌্যাবের পরিচালক বলেন, মুক্তিপণের টাকা আমিরের হাতে আছে। টাকা ভাগাভাগি করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। এখন আমিরকে খোঁজা হচ্ছে। তাঁকে পাওয়া গেলেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।

No comments

Powered by Blogger.