চরাচর-পথের শিল্পী by পাভেল রহমান

মধ্যদুপুরে হাইকোর্ট মাজার গেটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল গানের সুরে। কিছু মানুষের জটলা, দূর থেকে ভেসে আসছে কোনো এক বিরহিনী নারী হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বেদনার সুর।


একটু কাছে যেতে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল গানের কথাগুলো। জটলার মাঝখানে একটি মেয়েশিল্পী গলা ছেড়ে গাইছে- আমি যখন রান্তে বসি/ বন্ধু আমার বাজায় বাঁশি/ বাঁশি বাজাইয়ারে বন্ধু করলাই রে দেওয়ানা/ ঘরে থাকতে দিলা না রে বন্ধু/ ঘরে থাকতে দিলা না...। গান শেষ হতেই মুগ্ধ শ্রোতাদের হাততালি। এবার দর্শকদের অনুরোধ আরেকটা গান গাওয়ার। ততক্ষণে যিনি হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন তিনি উঠে দর্শকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন এবং বর্ণনা করতে শুরু করলেন 'আপনাদের আরো গান শুনাব, তবে সবাই আমাদের সাহায্য করবেন। এই মেয়েটা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইয়া পাঁচ ভাইবোনের সংসার চালায়, নিজেও পড়াশোনা করে'- এ কথা শোনার পর অনেকেই পকেট থেকে টাকা বের করে তুলে দিচ্ছে মেয়েটির হাতে। আবার শুরু হলো গান- 'ঘুমাইয়া ছিলাম ছিলাম ভালো/ জেগে দেখি বেলা নাই/ কোন-বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই'- মেয়েটির কণ্ঠে এ গানটি যখন শুনছিলাম, তখন আমি যেন কল্পলোকে দেখছি এই হাইকোর্ট মাজারে দাঁড়িয়ে গান গাইছেন আমাদের বিখ্যাত বাউল গানের শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া। শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়াকে তো একদিন এই হাইকোর্ট মাজার থেকেই আবিষ্কার করা হয়েছিল। গান শেষ হতেই আবার একইভাবে টাকা চাওয়া হয় দর্শকের কাছে। টাকা চাওয়ার এই প্রক্রিয়াটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সংগীতবিষয়ক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোর শিল্পীদের এসএমএস চাওয়ার মতোই। 'দর্শক আমার গান যদি আপনাদের ভালো লাগে, তবে এসএমএস করুন আর হাইকোর্ট মাজারের এই দরিদ্র শিল্পীদের চাওয়া, গানের বিনিময়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। গানের ফাঁকে কথা বলে জানতে পারি, মেয়ে শিল্পীটির নাম আমেনা। গান শিখেছ কোথায়, জানতে চাইলে হাত উঠিয়ে দেখিয়ে দেন 'আমার বাবার কাছে।' আমেনার বাবাকে জিজ্ঞাসা করি গান গেয়ে কত টাকা আসে প্রতিদিন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছেন না দেখে আবার প্রশ্ন করি, আপনি গান শিখেছেন কোথায়? আমেনার বাবা বলেন- 'আমি গান শিখছি আমার উস্তাদ জব্বার দেওয়ানের কাছে। তিনি মাজারে ঘুইরা ঘুইরা গান করেন।' শিল্পী আমেনা ও তাঁর সঙ্গীরা ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছেন লালনের গান 'ধন্য ধন্য বলি তাঁরে- আমি তখন বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি আর মনে মনে ভাবছি, আউল-বাউলের এই দেশে কত প্রতিভাবান শিল্পী প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। আমরা যদি আমাদের পথশিল্পীদের সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারতাম, তাহলে যে কত প্রতিভা বেরিয়ে আসত। পথশিল্পীদের দারুণ একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তাঁরা একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। আবার বেশির ভাগ শিল্পীই তাৎক্ষণিক গান রচনা করেন এবং সংরক্ষণ করেন মুখে মুখে। ফলে অনেক ভালো ভালো গান প্রতিদিন তৈরি হয় এবং প্রতিদিন হারিয়ে যায়। তাঁদের এ গান যদি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে বাংলা সংগীতের ভাণ্ডার আরো অনেক সমৃদ্ধ হয়ে উঠত।
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.