আমিরের নেতৃত্বে পরাগ অপহরণ-যুবলীগের জুয়েলসহ মূল হোতা চারজন by এস এম আজাদ
শিশু পরাগকে অপহরণ ও গুলি চালানোর ঘটনায় সন্ত্রাসী আমির প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিলেও রয়েছে আরো তিন পরিকল্পনাকারী। তাদের পেছনেও থাকতে পারে নাটের গুরু। পরাগের বাবা বিমল মণ্ডলকে ভয় দেখাতে এবং টাকা
আদায়ের উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয় ওই নৃশংসতা। ঘটনার এক মাস আগে আমির ওরফে ল্যাংড়া আমির, নাজির ও আরো একজনকে জেল থেকে জামিনে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা আমিনুল ইসলাম জুয়েল মোল্লা। সম্প্রতি পরাগের বাবা বিমলের সঙ্গে একটি জমি নিয়ে বিরোধ বাধে জুয়েলের। গত রবিবার পরাগ অপহৃত হওয়ার পর আড়ালে চলে গেছেন জুয়েল। অপহরণ পরিকল্পনার পর তা বাস্তবায়নে মাঠে নামে আমির। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে এসব ক্লু ধরে এগোতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এই অপহরণ ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে জুয়েল মোল্লা ও আমিরসহ চারজনের নাম উঠে এসেছে। অন্য দুজন হচ্ছে, নাজির ও ফারুক (আঙুল কাটা ফারুক)। সন্ত্রাসী আমির, নাজির ও আঙুল কাটা ফারুকের সঙ্গে সখ্য ছিল যুবলীগ নেতা জুয়েলের। এ তিন সন্ত্রাসীকে সঙ্গে নিয়েই অপহরণ ও ভয়ভীতি দেখানোর পরিকল্পনা করেন জুয়েল। এ গ্রুপের সঙ্গে সঞ্জয় ও নূর ইসলাম নামে আরো দুজন থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তাদের কথায়ও নেপথ্যে আরো কেউ থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তাঁরা বলেন, আমিরকে গ্রেপ্তার করা গেলে এ অপহরণ ঘটনার নেপথ্যে আরো কারা জড়িত তা বেরিয়ে আসবে। যে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে তারা কেউ এ পরিকল্পনায় ছিল না।
নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, পরাগকে অপহরণ করার পর তার বাবা বিমলের মোবাইল ফোনে অপহরণকারীরা কয়েকবার যোগাযোগ করে। এ যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার রাতে আমিনবাজার এলাকায় অপহরণকারীদের হাতে ৫০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে এবং তাদের শর্ত মেনেই ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন বিমল মণ্ডল। এই টাকা কে বা কারা নিয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এক মাস আগে পরিকল্পনা : আটককৃতদের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তারা গতকাল বলেন, এক মাস আগে বিমলের সন্তান অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাসখানেক আগে কারাগার থেকে আমিরসহ তিনজনকে ছাড়িয়ে আনেন জুয়েল। এই এক মাসের মধ্যেই পূর্বপাড়ার বাতান বাড়ির নিতাই মণ্ডলের জমি নিয়ে বিমলের সঙ্গে জুয়েলের বিরোধ হয়। এরপর ফারুক, নাজির, আমির ও জুয়েলের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। জুয়েলকে ৭০ লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে জমির বিরোধ মেটান বিমল। জুয়েল শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। সন্ত্রাসী মামলায় জেলে যাওয়ার পর যুবলীগের ওই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর আর নতুন কমিটি করা হয়নি। তবে জুয়েল নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবেই পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। থানা সূত্র জানা গেছে, জুয়েলের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও শ্যামপুর থানায় তিনটি হত্যা মামলাসহ আটটি মামলা আছে।
বিমলের পরিবারের যাতায়াত সম্পর্কে তথ্য জানতে অপহরণ পরিকল্পনাকারীদের নিয়োগ করা সোর্স কালাচান এক মাস ধরে বিমলের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দেয়। কালাচান একসময় বিমলের ব্যাটারির কারখানায় কাজ করত। এই কালাচানের সঙ্গেও জুয়েলের যোগাযোগ আছে। কালাচান গতকাল র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানায়, শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্যই তাকে পাঁচ লাখ টাকার সিএনজি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু গোয়েন্দাদের ধারণা, বড় টাকার কোনো লেনদেন না থাকলে এত টাকা দেওয়ার প্রস্তাব আসতে পারে না।
৫০ লাখ টাকায় রফা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাতে অপহরণকারী চক্রকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে নিজের ছেলেকে ফেরত পান বিমল। এ ব্যাপারে তিনি র্যাব বা ডিবি পুলিশকে কিছুই জানাননি। তবে নজরদারির মাধ্যমে গোয়েন্দা সদস্যরা বিমলের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁর পিছু নেন। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের নির্দেশ ও শিশুর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে র্যাব বা পুলিশ অভিযানে যায়নি বলে তাঁরা বলছেন। গোয়েন্দাদের অনেকটা চোখের সামনেই ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হাতবদল হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে অপহরণকারীদের ফোনে বসিলা ব্রিজ, আমিনবাজারের তুরাগ ব্রিজ, মুক্তার ব্রিজ, আউয়াল মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় যান বিমল। অপহরণকারীরা বিমলকে অনুসরণ করা সিএনজি অটোরিকশা দেখে বলে, 'আপনার পেছনে সিএনজি কেন?' তারা ফোনে বলতে থাকে, 'আপনার ছেলেকে একটা খোঁচাও দেওয়া হয়নি। ছেলেকে ফেরত দেওয়ার জন্যই ৫০ লাখ টাকায় রাজি হয়েছি।' আমিনবাজারের আউয়াল মার্কেটের অদূরে গ্রামের এক স্থানে অপহরণকারী মোবাইল ফোনে বিমলকে বলে, 'পারলে আপনার জামাকাপড় রেখে আসেন। একা আসেন। তবে মালটা (টাকা) নিয়া আসেন।' আবার বলে, 'কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাঁ দিকে যান।' এসব কথাবার্তার সূত্রে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে, ওই এলাকায়ই ৫০ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে। টাকা দেওয়ার সময় বিমল একা থাকলেও তাঁর কিছুটা পেছনে ছিলেন তাঁর বন্ধু ও স্ত্রী লিপির ভাই অনিন্দ সরকার বিদ্যুৎ। গতকাল পর্যন্ত টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বিমল ও বিদ্যুৎ কালের কণ্ঠকে কিছুই জানাননি।
সূত্র জানায়, ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে শিশু পরাগকে ফেরত দেওয়ার পেছনে অপহরণকারীদের সঙ্গে প্রভাবশালী চক্র জড়িত থাকতে পারে। কারণ, সমঝোতার পর্যায় ছিল খুবই গোপনীয়। এ ছাড়া বিমল জীবন বিপন্ন জেনেও র্যাব-পুলিশকে ব্যাপারটি জানাতে চাননি। র্যাবের হাতে আটক হওয়া কেউই টাকার ব্যাপারে জানে না বলে দাবি করছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিমলের দেওয়া মুক্তিপণের টাকা কার পকেটে গেল?
জুয়েলের সঙ্গে ফোনালাপ : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পরাগ অপহরণ হওয়ার তিন দিন পর জুয়েল মোল্লার একটি মোবাইল ফোনে বিমলের সঙ্গে কথা হয়। ওই আলাপে সংক্ষেপে সাংকেতিকভাবে মুক্তিপণের কথা বলা হয়। জুয়েলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অপহরণ মিশনের প্রধান আমিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার বিমলের সঙ্গে কথা হয়। গোয়েন্দারা এখন মুক্তিপণ দেওয়ার রাতে বিমলের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের বিস্তারিত উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
কে এই আমির : কেরানীগঞ্জের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আমির বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে ছিল। স্থানীয় ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আমিরের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় তিনটি হত্যাসহ ছয়টি মামলা আছে। এর মধ্যে পুলিশের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের মামলাও আছে। ২০০০ সালের ওই ঘটনায় আমিরের পা ভেঙে যায়। এরপর তার নাম হয় ল্যাংড়া আমির।
আমিরের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার কাঠপট্টি গোপালপুর গ্রামে। বাবার নাম আব্বাস উদ্দিন। মায়ের নাম হাসু বেগম। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে থাকে আমির। কয়েক বছর আগে বিয়ে করা তার স্ত্রীর নাম ইতি। বছরখানেক আগে ইকুরিয়া এলাকায় সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। প্রথমপক্ষে তার একটি ছেলে আছে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মামুন আমিরের প্রথম স্ত্রী ইতির ভাই। সূত্র জানায়, আমির মামুনের সঙ্গে চীনা পণ্য আমদানির ব্যবসা করত। এ ব্যবসার আড়ালে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হয়ে কাজ করাই ছিল তার প্রধান পেশা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন : শিশু পরাগ অপহরণের ঘটনা তদন্তে জুয়েলসহ পরিকল্পনাকারীদের নাম আসা এবং গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'তদন্ত চলছে। এখনো পরিকল্পনাকারী হিসেবে কারো নাম পাওয়া যায়নি।'
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, 'এখন পর্যন্ত যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের এবং আমিরের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানা গেছে। নেপথ্যে যারা আছে তাদের নামও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। জুয়েলের ব্যাপারে কেউ এখনো কিছু বলেনি।'
ঘটনার পর থেকেই ছায়া তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঘটনার পরিকল্পনাকারী শনাক্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির সহকারী কমিশনার সানোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা থানা পুলিশের তদন্তে সহায়তা করছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন স্থানীয় সন্দেহভাজন ১০ জনের তালিকা করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে।'
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তাদের কথায়ও নেপথ্যে আরো কেউ থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তাঁরা বলেন, আমিরকে গ্রেপ্তার করা গেলে এ অপহরণ ঘটনার নেপথ্যে আরো কারা জড়িত তা বেরিয়ে আসবে। যে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে তারা কেউ এ পরিকল্পনায় ছিল না।
নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, পরাগকে অপহরণ করার পর তার বাবা বিমলের মোবাইল ফোনে অপহরণকারীরা কয়েকবার যোগাযোগ করে। এ যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার রাতে আমিনবাজার এলাকায় অপহরণকারীদের হাতে ৫০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে এবং তাদের শর্ত মেনেই ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন বিমল মণ্ডল। এই টাকা কে বা কারা নিয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এক মাস আগে পরিকল্পনা : আটককৃতদের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তারা গতকাল বলেন, এক মাস আগে বিমলের সন্তান অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাসখানেক আগে কারাগার থেকে আমিরসহ তিনজনকে ছাড়িয়ে আনেন জুয়েল। এই এক মাসের মধ্যেই পূর্বপাড়ার বাতান বাড়ির নিতাই মণ্ডলের জমি নিয়ে বিমলের সঙ্গে জুয়েলের বিরোধ হয়। এরপর ফারুক, নাজির, আমির ও জুয়েলের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। জুয়েলকে ৭০ লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে জমির বিরোধ মেটান বিমল। জুয়েল শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। সন্ত্রাসী মামলায় জেলে যাওয়ার পর যুবলীগের ওই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর আর নতুন কমিটি করা হয়নি। তবে জুয়েল নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবেই পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। থানা সূত্র জানা গেছে, জুয়েলের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও শ্যামপুর থানায় তিনটি হত্যা মামলাসহ আটটি মামলা আছে।
বিমলের পরিবারের যাতায়াত সম্পর্কে তথ্য জানতে অপহরণ পরিকল্পনাকারীদের নিয়োগ করা সোর্স কালাচান এক মাস ধরে বিমলের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দেয়। কালাচান একসময় বিমলের ব্যাটারির কারখানায় কাজ করত। এই কালাচানের সঙ্গেও জুয়েলের যোগাযোগ আছে। কালাচান গতকাল র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানায়, শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্যই তাকে পাঁচ লাখ টাকার সিএনজি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু গোয়েন্দাদের ধারণা, বড় টাকার কোনো লেনদেন না থাকলে এত টাকা দেওয়ার প্রস্তাব আসতে পারে না।
৫০ লাখ টাকায় রফা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাতে অপহরণকারী চক্রকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে নিজের ছেলেকে ফেরত পান বিমল। এ ব্যাপারে তিনি র্যাব বা ডিবি পুলিশকে কিছুই জানাননি। তবে নজরদারির মাধ্যমে গোয়েন্দা সদস্যরা বিমলের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁর পিছু নেন। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের নির্দেশ ও শিশুর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে র্যাব বা পুলিশ অভিযানে যায়নি বলে তাঁরা বলছেন। গোয়েন্দাদের অনেকটা চোখের সামনেই ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হাতবদল হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে অপহরণকারীদের ফোনে বসিলা ব্রিজ, আমিনবাজারের তুরাগ ব্রিজ, মুক্তার ব্রিজ, আউয়াল মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় যান বিমল। অপহরণকারীরা বিমলকে অনুসরণ করা সিএনজি অটোরিকশা দেখে বলে, 'আপনার পেছনে সিএনজি কেন?' তারা ফোনে বলতে থাকে, 'আপনার ছেলেকে একটা খোঁচাও দেওয়া হয়নি। ছেলেকে ফেরত দেওয়ার জন্যই ৫০ লাখ টাকায় রাজি হয়েছি।' আমিনবাজারের আউয়াল মার্কেটের অদূরে গ্রামের এক স্থানে অপহরণকারী মোবাইল ফোনে বিমলকে বলে, 'পারলে আপনার জামাকাপড় রেখে আসেন। একা আসেন। তবে মালটা (টাকা) নিয়া আসেন।' আবার বলে, 'কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাঁ দিকে যান।' এসব কথাবার্তার সূত্রে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে, ওই এলাকায়ই ৫০ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে। টাকা দেওয়ার সময় বিমল একা থাকলেও তাঁর কিছুটা পেছনে ছিলেন তাঁর বন্ধু ও স্ত্রী লিপির ভাই অনিন্দ সরকার বিদ্যুৎ। গতকাল পর্যন্ত টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বিমল ও বিদ্যুৎ কালের কণ্ঠকে কিছুই জানাননি।
সূত্র জানায়, ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে শিশু পরাগকে ফেরত দেওয়ার পেছনে অপহরণকারীদের সঙ্গে প্রভাবশালী চক্র জড়িত থাকতে পারে। কারণ, সমঝোতার পর্যায় ছিল খুবই গোপনীয়। এ ছাড়া বিমল জীবন বিপন্ন জেনেও র্যাব-পুলিশকে ব্যাপারটি জানাতে চাননি। র্যাবের হাতে আটক হওয়া কেউই টাকার ব্যাপারে জানে না বলে দাবি করছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিমলের দেওয়া মুক্তিপণের টাকা কার পকেটে গেল?
জুয়েলের সঙ্গে ফোনালাপ : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পরাগ অপহরণ হওয়ার তিন দিন পর জুয়েল মোল্লার একটি মোবাইল ফোনে বিমলের সঙ্গে কথা হয়। ওই আলাপে সংক্ষেপে সাংকেতিকভাবে মুক্তিপণের কথা বলা হয়। জুয়েলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অপহরণ মিশনের প্রধান আমিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার বিমলের সঙ্গে কথা হয়। গোয়েন্দারা এখন মুক্তিপণ দেওয়ার রাতে বিমলের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের বিস্তারিত উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
কে এই আমির : কেরানীগঞ্জের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আমির বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে ছিল। স্থানীয় ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আমিরের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় তিনটি হত্যাসহ ছয়টি মামলা আছে। এর মধ্যে পুলিশের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের মামলাও আছে। ২০০০ সালের ওই ঘটনায় আমিরের পা ভেঙে যায়। এরপর তার নাম হয় ল্যাংড়া আমির।
আমিরের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার কাঠপট্টি গোপালপুর গ্রামে। বাবার নাম আব্বাস উদ্দিন। মায়ের নাম হাসু বেগম। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে থাকে আমির। কয়েক বছর আগে বিয়ে করা তার স্ত্রীর নাম ইতি। বছরখানেক আগে ইকুরিয়া এলাকায় সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। প্রথমপক্ষে তার একটি ছেলে আছে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মামুন আমিরের প্রথম স্ত্রী ইতির ভাই। সূত্র জানায়, আমির মামুনের সঙ্গে চীনা পণ্য আমদানির ব্যবসা করত। এ ব্যবসার আড়ালে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হয়ে কাজ করাই ছিল তার প্রধান পেশা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন : শিশু পরাগ অপহরণের ঘটনা তদন্তে জুয়েলসহ পরিকল্পনাকারীদের নাম আসা এবং গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'তদন্ত চলছে। এখনো পরিকল্পনাকারী হিসেবে কারো নাম পাওয়া যায়নি।'
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, 'এখন পর্যন্ত যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের এবং আমিরের পরিকল্পনার ব্যাপারে জানা গেছে। নেপথ্যে যারা আছে তাদের নামও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। জুয়েলের ব্যাপারে কেউ এখনো কিছু বলেনি।'
ঘটনার পর থেকেই ছায়া তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঘটনার পরিকল্পনাকারী শনাক্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির সহকারী কমিশনার সানোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা থানা পুলিশের তদন্তে সহায়তা করছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন স্থানীয় সন্দেহভাজন ১০ জনের তালিকা করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চলছে।'
No comments