জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির প্রত্যাশা by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমাদের দেশের রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা দুটি; একটি জাতীয়তাবাদী, অন্যটি সমাজতন্ত্রী। এমনটি ব্রিটিশ আমলেও ছিল, পাকিস্তান আমলে রয়ে গেছে, বাংলাদেশেও তা অপরিবর্তিত।
জনগণ যা চাচ্ছিলেন এবং এখনো চান, তা হলো মুক্তি। মুক্তির প্রতিশ্রুতি জাতীয়তাবাদীরা দেন, সমাজতন্ত্রীরা তো দেবেনই। তবে দুয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন, মুক্তি আনবেন সমাজকে অপরিবর্তিত রেখেই, সমাজতন্ত্রীরা জানেন সেটা একেবারেই অসম্ভব। জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রের ভাঙাগড়ায় তবু আগ্রহ রাখেন, সমাজকে ভেঙে গড়বেন এটা তাঁরা চান না, উল্টো সমাজ-পরিবর্তনকে প্রতিহত করতে তাঁরা সচেষ্ট থাকেন। পুরনো রাষ্ট্রের পতনে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলে তাঁদের সুবিধা, কেননা ক্ষমতার হস্তান্তরে ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে। ব্রিটিশের রাষ্ট্র ভেঙেছে, ক্ষমতা পেয়েছেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা। সেই রাষ্ট্র ভেঙে আমরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করলাম, সুবিধা হলো বাঙালি-বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের। জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা বদলেছে, সেই বদলটা রাষ্ট্রের পতন-অভ্যুদয়ে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ক্ষমতা নির্ভুলভাবেই চলে গেছে নতুন জাতীয়তাবাদীদের হাতে। রাষ্ট্রের ভাঙাগড়ায় সমাজতন্ত্রীরা কম ভূমিকা রাখেননি, জনগণ রাষ্ট্রকে শাসনের যন্ত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছেন এবং ওই যন্ত্রটির ভাঙন কামনা করেছেন, সমাজতন্ত্রীরা সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই ছিলেন, যেমনটি তাঁদের থাকার কথা, কিন্তু তাঁরা নেতৃত্বে থাকতে পারেননি।
নেতৃত্বে অবিচল থেকেছেন জাতীয়তাবাদীরাই। ধন-সম্পত্তিতে তাঁরা বলবান, প্রচারমাধ্যম তাঁদের হাতে, তাঁদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মুরবি্ব। তাই আন্দোলনের সামনের সারিতে তাঁদেরই দেখা গেছে। সমাজতন্ত্রীরা সেভাবে দৃশ্যমান হননি। হওয়া সম্ভব ছিল না; তাঁরা ধন-সম্পত্তিতে বর্ষীয়ান নন, প্রচারমাধ্যম তাঁদের পছন্দ করে না, পুঁজিবাদী বিশ্ব তাঁদের বিরুদ্ধে থাকে; আর সবচেয়ে যেটা মর্মান্তিক ও কার্যকর সেটা হলো, জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের দেখেন বিদ্বেষের চোখে এবং পদে পদে তাঁদেরকে অপদস্থ করেন।
নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলে সমাজে উন্নতির লক্ষণ দেখা দেয়। অর্থাৎ ধনীরা আরো ধনী হন, কিন্তু সমাজের কাঠামো আগের মতোই রয়ে যায়। অর্থাৎ কিনা শ্রেণী বিভাজন থাকে এবং প্রবল যে শ্রেণী সেটি দুর্বল শ্রেণীর ওপর অত্যাচার ও শোষণ অব্যাহত রাখে। সংখ্যায় প্রবলেরা অল্প, দুর্বলেরা অধিক। অনেকের ওপর অল্প মানুষের এই শাসনকে কোনো দিক দিয়েই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। অথচ গুরুত্বের স্বার্থেই পুরনো রাষ্ট্রকে ভাঙা হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নতুন রাষ্ট্রের। গঠনতন্ত্রের আওয়াজ জাতীয়তাবাদীরা দিয়েছেন, সমাজতন্ত্রীরাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের নাম দেখা গেলেও কোনো নিশানা দৃশ্যমান হয়নি।
তার কারণ রাষ্ট্র বদলেছে, কিন্তু সমাজ বদলায়নি। সমাজের কাঠামো আগের মতোই আমাদের ওপর অল্পের শাসনকে নির্মমভাবে কায়েম করে রেখেছে। জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সমাজের মৌলিক রূপান্তর কখনোই কাম্য নয়। কেননা তাঁরা যে টিকে আছেন এবং স্ফীত হচ্ছেন তা শ্রেণীবিভাজনের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই; ওটা সরে গেলে যে জনতার সঙ্গে সমান হয়ে যেতে হবে, এটা তাঁরা জানেন এবং সেটা যাতে না ঘটে সে জন্যই সদা তৎপর থাকেন।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা মুক্তির। তাদের বোঝানো হয় যে রাষ্ট্র বদলালে তাঁদের মুক্তি আসবে, তাঁরা আর শোষিত হবেন না, বাঁচার মৌলিক অধিকারগুলো তাঁদের কাছে এসে যাবে। রাষ্ট্র বদলায়, কিন্তু মুক্তি আসে না, কেননা সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটে না। সেই পুরনো সমাজই টিকে থাকে, নতুন জাতীয়তাবাদীরা বরঞ্চ আগের তুলনায় শক্ত হয়ে আরো প্রবলভাবে শাসন ও শোষণ চালাতে থাকেন। রাষ্ট্র যে বদলায় সেটাও কিন্তু মূলত আয়তন ও নামে, নইলে ভেতরে তার যে চরিত্র, শাসকদের হাতে শাসনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া, সেটা কেবল আগের মতো নয়, আগের চেয়েও অধিক মাত্রায় কার্যকর থাকে।
বাংলাদেশে এখন এটাই বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধ যে কেবল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য ছিল না, এটা তো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। আর মুক্তির মূল কথাটাই ছিল, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। এক কথায়, অধিকার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বৈষম্যের অবসান ঘটানো। যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদীরা, কিন্তু চালিকাশক্তি ছিল জনসাধারণ। নেতৃত্বকে প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায়নি, বড় নেতারা লড়াইয়ের ময়দান থেকে বড় রকমের দূরত্ব বজায় রাখাটাই পছন্দ করেছেন। প্রাণ দিয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের মধ্যে কৃষক ছিলেন, ছিলেন শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ছিলেন, ছিলেন সেনাবাহিনী-ইপিআর-পুলিশের সদস্যরা। মিলন ঘটেছিল শত্রুর মোকাবিলায়। বিপদের মধ্য থেকে যেন একটা নতুন সমাজ গড়ে উঠেছে। অর্থ-বিত্ত-শিক্ষা-বংশ পরিচয়-ধর্মীয় বিভেদ- সব কিছুই প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীর বন্ধনে মনে হয়েছিল, যেন নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে যে বাধ্য হয়েছিলেন সেটা অন্য কোনো কারণে ঘটেনি, ঘটেছিল যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশাটা জেগে উঠেছিল তারই চাপে। নইলে সমাজতন্ত্র তো জাতীয়তাবাদীদের দুই চোখে বিষের মতো, তাঁরা যে রঙের জাতীয়তাবাদীই হোন না কেন। এ ক্ষেত্রে এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকেও যে তাঁদের অবস্থা অনেক দূরবর্তী, তা মোটেই নয়। যে জন্য দেখা গেল ক্ষমতা হাতে পেয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের জায়গায় অঞ্চলভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাকারীরা নির্বিকার চিত্তে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছাটাকে সংবিধান থেকে বিতাড়িত করলেন। তাঁদের পক্ষে এটা করা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের যাঁরা ধারক, ক্ষমতা পুনরায় পাওয়ার পর তাঁরাও কিন্তু সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিলেন না। বরং মনে হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা যে ঝামেলাটাকে মিটিয়ে দিয়েছেন এতে তাঁরা সন্তুষ্টই। কেননা নইলে দায়িত্বটা হয়তো তাঁদেরই নিতে হতো।
জাতীয়তাবাদীরা তো যা তাঁদের পক্ষে করা স্বাভাবিক সেটাই করলেন। রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করে সেই ক্ষমতার ভাগাভাগিটাকেই তাঁরা মূলধারার রাজনীতি করে তুললেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের খবর কী? তাঁরা কোথায়? তাঁরা ছিলেন এবং এখনো আছেন। কিন্তু মূলধারায় পরিণত হতে পারেননি। ওদিকে অস্পষ্ট করে হলেও মুক্তিকামী জনগণ চেয়েছেন সমাজতন্ত্রীরাই মূলধারা হবেন, হওয়া দরকার। হতে না পারার কারণ আছে। সেগুলো যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি বাস্তবিক। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরাই ছিলেন। প্রথমে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, পরে এসে যোগ দিল সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। ১৮৮১তে কংগ্রেস গঠনে উৎসাহটা জুগিয়েছিল ইংরেজরাই। উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন যাতে জাতীয়তাবাদীদের হাতেই থাকে সেটা নিশ্চিত করা। ইংরেজরা ১৮৫৭-এর অভ্যুত্থান দেখেছে এবং ভয় পেয়েছে সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থানকে। কিন্তু পরে দেখা গেল, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভেতর একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাদের একাংশ উগ্র হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় ও স্রোতে এই উগ্রতা বেশ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। ইংরেজরা তখন বুদ্ধি করল ভারতবর্ষের মানুষকে সরাসরি হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত করে দেওয়ার। সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তারা মুসলমান নেতাদের উৎসাহী করল পাল্টা একটা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল খাড়া করতে, যার নাম দাঁড়াল মুসলিম লীগ। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এই দুদলের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার দরুন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিভক্ত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদে। ভারতবর্ষের মূল সমস্যাটা ছিল শ্রেণী বিভাজনের, তাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে পরিণত করা হলো। ব্রিটিশের উস্কানিতে বিভাজন পরিণত হলো বিরোধে। বিরোধ রূপ নিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এবং দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে গেল। ব্রিটিশরা চলে গেল, কিন্তু ভাগ করে রেখে গেল ভারতবর্ষকে এবং স্বাধীনতার পরিবর্তে দিয়ে গেল ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস, যার অপর নাম হচ্ছে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন। ক্ষমতায় এলেন নতুন দুই রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী নেতারা।
কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা কী করলেন সেটাই হচ্ছে জরুরি প্রশ্ন। তাঁরা কিছুটা পরে এসেছেন। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে, কিছুটা পরে, ১৯২১ সালে। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেনি। জাতীয়তাবাদীরা অত্যন্ত প্রবল ছিলেন, থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। আগে ইংরেজকে তাড়াই, তারপর দেখা যাবে সমাজকে নিয়ে কী করা যায়- শিক্ষিত মহলে এটাই ছিল প্রতিষ্ঠিত মনোভাব। ওদিকে ছিল মানুষের ধর্মপ্রাণতা। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নিরীহ জাতীয়তাবাদীরাও বলতে ভালোবাসতেন; কমিউনিস্টরা ভালো মানুষ বটে, কিন্তু ওরা ধর্ম মানে না, ওদের অনেকেই নাস্তিক। কমিউনিস্টরাও জনগণের কাছে এই সত্য নিয়ে সঠিকভাবে উপস্থিত হতে পারেননি যে মানুষের জীবনে মূল সমস্যাটা হলো বাঁচার। আর বাঁচার ব্যাপারটা ধর্মের সঙ্গে জড়িত নয়, জড়িত অর্থনীতির সঙ্গে। এটা করা ছিল একটা কঠিন দায়িত্ব। এর চেয়ে বরঞ্চ সহজ ছিল এটা প্রতিষ্ঠিত করা যে কমিউনিস্টরা ধর্মবিরোধী নন, ধর্মকর্মে তাঁদের মোটেই আপত্তি নেই। ধর্ম তো আছেই, ব্যক্তিজীবনে রয়েছে, সমাজজীবনেও আছে; কিন্তু যখন ইংরেজকে বিতাড়ন করা এবং দেশি শাসন-শোষণের অবসান ঘটানোর আন্দোলনের ব্যাপারটা সামনে আসে, তখন একসঙ্গে লড়তে হবে, নইলে নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি লেগে যাবে। যেটা করলে মুক্তি আসবে না- এই বিষয়টা বোঝানো খুবই জরুরি ছিল।
কংগ্রেস ও লীগ- উভয় দলের জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন সমাজতন্ত্রবিরোধী। এখানে তাঁরা একাট্টা। ফলে সমাজতন্ত্রীদের উভয় পক্ষই চেষ্টা করত দমিয়ে রাখতে। ওদিকে ব্রিটিশের দৃষ্টিভঙ্গিটাও ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা জানত, জাতীয়তাবাদীরা যতই উগ্র হোক না কেন তাদের সঙ্গে একটা আপসরফায় আসা যাবে, যে ধারণাটা মোটেই অমূলক ছিল না। বিপরীত পক্ষে সমাজতন্ত্রীরা দল হিসেবে ছোট হলেও সম্ভাবনার দিক থেকে ছিলেন বিপজ্জনক। তাঁরা আপস করবেন না, পূর্ণ স্বাধীনতা চাইবেন এবং সমাজ বিপ্লব ঘটানোর দিকে মানুষকে নিয়ে যাবেন। সেই বিপ্লব ঘটলে ইংরেজকে কেবল যে ভারত ছাড়তে হবে তা নয়, তাদের তল্পিতল্পাও বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে বাজার তো নয়ই, এমনকি প্রভাববলয়টাও অক্ষুণ্ন থাকবে না। ইংরেজরা ১৮৫৭ দেখেছে, ১৯১৭-এর রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অবহিত হয়েছে; তাই কমিউনিস্টদের তৎপরতা শুরু হয়েছে দেখে মোটেই সময় নষ্ট করেনি, 'অঙ্কুরেই বিনাশ সাধন বুদ্ধিমানের কাজ' এই বিবেচনায় তারা সমাজতন্ত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের তারা মামলায় ফেলে কারাবন্দি করেছে, বছরের পর বছর আটকে রেখেছে। পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কমিউনিস্টদের পক্ষে প্রকাশ্যে পত্রিকা প্রকাশ করাও কঠিন ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম সমাজতন্ত্রী ছিলেন, সে জন্য তাঁর অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা 'ধূমকেতু'কে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং নজরুলকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণীগত, কিন্তু সামনে যে প্রশ্নটা ছিল সেটি হলো জাতির। ভারতবর্ষ মোটেই এক জাতির দেশ ছিল না, কমিউনিস্ট পার্টি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিল যে সেখানে জাতি ছিল ১৭টি, যাদের ভিত্তি ছিল ভাষা। কংগ্রেস বলল, এক জাতির কথা। কিন্তু তাদের সেই জাতীয়তার ভিত্তিটা কী, সেটা পরিষ্কার করে বলতে পারল না। মুসলিম লীগ বলল, ভারতবর্ষে জাতি রয়েছে দুটি এবং তাদের পক্ষে বলতে কোনো অসুবিধা ছিল না যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। মুসলিম লীগ ইঙ্গিত করল যে কংগ্রেস যে জাতীয়তাবাদের কথা বলছে, সেটা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। কংগ্রেস এ কথার প্রতিবাদ করল ঠিকই। কিন্তু তাদের আচার-আচরণেই মুসলমানদের মনে ধারণা তৈরি হলো যে কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুত্ব।
সমাজতন্ত্রীদের পক্ষেই সম্ভব ছিল ভারতবর্ষকে বহুজাতিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা। সেটা তাঁরা করেছিলেনও, কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের তৈরি করা সাম্প্রদায়িক ডামাডোলের ভেতর তাঁদের সে বক্তব্য জোরালোভাবে প্রকাশ পায়নি। কমিউনিস্ট পার্টির আরো একটি দুর্বলতা ছিল। সেটা হলো, তারা তাদের আত্মত্যাগ ও বিপুল কর্মোদ্যম সত্ত্বেও সমাজ বিপ্লবের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারেনি। জনগণের আবেগের ভাষা ও সাংস্কৃতিক মান দুটিই ছিল তাদের কাছে অনধিগম্য। নাস্তিকতার অভিযোগটাও কম অসুবিধার সৃষ্টি করেনি।
কমিউনিস্টরা কোন পথে অগ্রসর হবেন- সেটাও ঠিক করতে পারেননি। সমাজতন্ত্রীদের একাংশ ঠিক করেছিল কংগ্রেসের ভেতর থেকেই কাজ করবে। তারা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করল; কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তো কমিউনিস্টদের কংগ্রেস থেকে বের করেই দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব ছিল রক্ষণশীল; যে জন্য দু-দুবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েও সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসে থাকতে পারেননি এবং জওয়াহের লাল নেহরুকে থাকতে হয়েছিল রক্ষণশীলদের সঙ্গে আপস করে।
যে সমাজতন্ত্রীরা আলাদাভাবে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন, তাঁরাও পথ-বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এর বড় কারণ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কেন্দ্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভর করা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঢালাও কোনো পথ নেই। সমাজের আর্থ-সামাজিক বিকাশ, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য- এসবকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করেই রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করার কথা। ভারতীয় কমিউনিস্টরা সেটা করতে পারেননি। ফলে তাঁরা আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের নির্দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় একটি বিপর্যয় ঘটে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই যুদ্ধ যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ভেতর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল, এটা কমিউনিস্ট পার্টি বুঝতে ভুল করেনি। কিন্তু হিটলার যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসলেন, তখন কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে যুদ্ধের চরিত্রে একটি পরিবর্তন ঘটেছিল। এটি পরিণত হলো জনযুদ্ধে এবং সারা বিশ্বে কমিউনিস্টদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে দাঁড়ানো। পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্টরা দেখলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণকারী নাৎসি জার্মানির শক্র যে মিত্রবাহিনী, তারা তাঁদের মিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করার এই নীতি ভারতের কমিউনিস্টদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সংগ্রাম যখন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তাতে কমিউনিস্টরা যে আপসহীনভাবে অংশ নিতে পারছেন না, বরঞ্চ ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, সেই ঘটনা দেশবাসীর পক্ষে তো হতাশাব্যঞ্জক ছিলই; কমিউনিস্টদের নিজেদের কাছেও কম অস্বস্তিকর ঠেকেনি। ফল দাঁড়াল এই যে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্বের জায়গায় তো যেতে পারলেন না, বরঞ্চ পিছিয়ে গেলেন। কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। জয়জয়কার তখন কংগ্রেস ও লীগের। কমিউনিস্টরা তখন নিজের ভূমিকা থেকে সরে এসে কংগ্রেস ও লীগকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সমাজতন্ত্রীরা জাতীয়তাবাদীদের হিংসা ভুলে এক হতে বলছেন; কিন্তু সে ঐক্য যে সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে যাবে না, সেটা খেয়াল করার সুযোগ পাচ্ছেন না- অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল এ রকমেরই। প্রধান দ্বন্দ্বটা ছিল ব্রিটিশের সঙ্গে জনগণের। এই দ্বন্দ্বে কংগ্রেস ও লীগকে এক করা যাবে- এটা ছিল একটি অবাস্তব ধারণা। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্ররা যে প্রায় বিপ্লবী একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তি পার্টির ছিল না। পার্টি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে।
শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভারতবর্ষ দুই টুকরো হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষকে উৎপাটন, দুর্ভোগ পোহানো, প্রাণ হারানো, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার তুলনাবিহীন বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : শিক্ষাবিদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নেতৃত্বে অবিচল থেকেছেন জাতীয়তাবাদীরাই। ধন-সম্পত্তিতে তাঁরা বলবান, প্রচারমাধ্যম তাঁদের হাতে, তাঁদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মুরবি্ব। তাই আন্দোলনের সামনের সারিতে তাঁদেরই দেখা গেছে। সমাজতন্ত্রীরা সেভাবে দৃশ্যমান হননি। হওয়া সম্ভব ছিল না; তাঁরা ধন-সম্পত্তিতে বর্ষীয়ান নন, প্রচারমাধ্যম তাঁদের পছন্দ করে না, পুঁজিবাদী বিশ্ব তাঁদের বিরুদ্ধে থাকে; আর সবচেয়ে যেটা মর্মান্তিক ও কার্যকর সেটা হলো, জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের দেখেন বিদ্বেষের চোখে এবং পদে পদে তাঁদেরকে অপদস্থ করেন।
নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলে সমাজে উন্নতির লক্ষণ দেখা দেয়। অর্থাৎ ধনীরা আরো ধনী হন, কিন্তু সমাজের কাঠামো আগের মতোই রয়ে যায়। অর্থাৎ কিনা শ্রেণী বিভাজন থাকে এবং প্রবল যে শ্রেণী সেটি দুর্বল শ্রেণীর ওপর অত্যাচার ও শোষণ অব্যাহত রাখে। সংখ্যায় প্রবলেরা অল্প, দুর্বলেরা অধিক। অনেকের ওপর অল্প মানুষের এই শাসনকে কোনো দিক দিয়েই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। অথচ গুরুত্বের স্বার্থেই পুরনো রাষ্ট্রকে ভাঙা হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নতুন রাষ্ট্রের। গঠনতন্ত্রের আওয়াজ জাতীয়তাবাদীরা দিয়েছেন, সমাজতন্ত্রীরাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের নাম দেখা গেলেও কোনো নিশানা দৃশ্যমান হয়নি।
তার কারণ রাষ্ট্র বদলেছে, কিন্তু সমাজ বদলায়নি। সমাজের কাঠামো আগের মতোই আমাদের ওপর অল্পের শাসনকে নির্মমভাবে কায়েম করে রেখেছে। জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সমাজের মৌলিক রূপান্তর কখনোই কাম্য নয়। কেননা তাঁরা যে টিকে আছেন এবং স্ফীত হচ্ছেন তা শ্রেণীবিভাজনের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই; ওটা সরে গেলে যে জনতার সঙ্গে সমান হয়ে যেতে হবে, এটা তাঁরা জানেন এবং সেটা যাতে না ঘটে সে জন্যই সদা তৎপর থাকেন।
জনগণের আকাঙ্ক্ষা মুক্তির। তাদের বোঝানো হয় যে রাষ্ট্র বদলালে তাঁদের মুক্তি আসবে, তাঁরা আর শোষিত হবেন না, বাঁচার মৌলিক অধিকারগুলো তাঁদের কাছে এসে যাবে। রাষ্ট্র বদলায়, কিন্তু মুক্তি আসে না, কেননা সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটে না। সেই পুরনো সমাজই টিকে থাকে, নতুন জাতীয়তাবাদীরা বরঞ্চ আগের তুলনায় শক্ত হয়ে আরো প্রবলভাবে শাসন ও শোষণ চালাতে থাকেন। রাষ্ট্র যে বদলায় সেটাও কিন্তু মূলত আয়তন ও নামে, নইলে ভেতরে তার যে চরিত্র, শাসকদের হাতে শাসনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া, সেটা কেবল আগের মতো নয়, আগের চেয়েও অধিক মাত্রায় কার্যকর থাকে।
বাংলাদেশে এখন এটাই বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধ যে কেবল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য ছিল না, এটা তো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। আর মুক্তির মূল কথাটাই ছিল, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। এক কথায়, অধিকার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বৈষম্যের অবসান ঘটানো। যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদীরা, কিন্তু চালিকাশক্তি ছিল জনসাধারণ। নেতৃত্বকে প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায়নি, বড় নেতারা লড়াইয়ের ময়দান থেকে বড় রকমের দূরত্ব বজায় রাখাটাই পছন্দ করেছেন। প্রাণ দিয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের মধ্যে কৃষক ছিলেন, ছিলেন শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ছিলেন, ছিলেন সেনাবাহিনী-ইপিআর-পুলিশের সদস্যরা। মিলন ঘটেছিল শত্রুর মোকাবিলায়। বিপদের মধ্য থেকে যেন একটা নতুন সমাজ গড়ে উঠেছে। অর্থ-বিত্ত-শিক্ষা-বংশ পরিচয়-ধর্মীয় বিভেদ- সব কিছুই প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীর বন্ধনে মনে হয়েছিল, যেন নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে যে বাধ্য হয়েছিলেন সেটা অন্য কোনো কারণে ঘটেনি, ঘটেছিল যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশাটা জেগে উঠেছিল তারই চাপে। নইলে সমাজতন্ত্র তো জাতীয়তাবাদীদের দুই চোখে বিষের মতো, তাঁরা যে রঙের জাতীয়তাবাদীই হোন না কেন। এ ক্ষেত্রে এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকেও যে তাঁদের অবস্থা অনেক দূরবর্তী, তা মোটেই নয়। যে জন্য দেখা গেল ক্ষমতা হাতে পেয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের জায়গায় অঞ্চলভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাকারীরা নির্বিকার চিত্তে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছাটাকে সংবিধান থেকে বিতাড়িত করলেন। তাঁদের পক্ষে এটা করা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের যাঁরা ধারক, ক্ষমতা পুনরায় পাওয়ার পর তাঁরাও কিন্তু সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিলেন না। বরং মনে হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা যে ঝামেলাটাকে মিটিয়ে দিয়েছেন এতে তাঁরা সন্তুষ্টই। কেননা নইলে দায়িত্বটা হয়তো তাঁদেরই নিতে হতো।
জাতীয়তাবাদীরা তো যা তাঁদের পক্ষে করা স্বাভাবিক সেটাই করলেন। রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করে সেই ক্ষমতার ভাগাভাগিটাকেই তাঁরা মূলধারার রাজনীতি করে তুললেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের খবর কী? তাঁরা কোথায়? তাঁরা ছিলেন এবং এখনো আছেন। কিন্তু মূলধারায় পরিণত হতে পারেননি। ওদিকে অস্পষ্ট করে হলেও মুক্তিকামী জনগণ চেয়েছেন সমাজতন্ত্রীরাই মূলধারা হবেন, হওয়া দরকার। হতে না পারার কারণ আছে। সেগুলো যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি বাস্তবিক। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, তার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরাই ছিলেন। প্রথমে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, পরে এসে যোগ দিল সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। ১৮৮১তে কংগ্রেস গঠনে উৎসাহটা জুগিয়েছিল ইংরেজরাই। উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন যাতে জাতীয়তাবাদীদের হাতেই থাকে সেটা নিশ্চিত করা। ইংরেজরা ১৮৫৭-এর অভ্যুত্থান দেখেছে এবং ভয় পেয়েছে সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থানকে। কিন্তু পরে দেখা গেল, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভেতর একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাদের একাংশ উগ্র হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় ও স্রোতে এই উগ্রতা বেশ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। ইংরেজরা তখন বুদ্ধি করল ভারতবর্ষের মানুষকে সরাসরি হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত করে দেওয়ার। সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তারা মুসলমান নেতাদের উৎসাহী করল পাল্টা একটা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল খাড়া করতে, যার নাম দাঁড়াল মুসলিম লীগ। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এই দুদলের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার দরুন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিভক্ত হয়েছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদে। ভারতবর্ষের মূল সমস্যাটা ছিল শ্রেণী বিভাজনের, তাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে পরিণত করা হলো। ব্রিটিশের উস্কানিতে বিভাজন পরিণত হলো বিরোধে। বিরোধ রূপ নিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এবং দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে গেল। ব্রিটিশরা চলে গেল, কিন্তু ভাগ করে রেখে গেল ভারতবর্ষকে এবং স্বাধীনতার পরিবর্তে দিয়ে গেল ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস, যার অপর নাম হচ্ছে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন। ক্ষমতায় এলেন নতুন দুই রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী নেতারা।
কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা কী করলেন সেটাই হচ্ছে জরুরি প্রশ্ন। তাঁরা কিছুটা পরে এসেছেন। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে, কিছুটা পরে, ১৯২১ সালে। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেনি। জাতীয়তাবাদীরা অত্যন্ত প্রবল ছিলেন, থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। আগে ইংরেজকে তাড়াই, তারপর দেখা যাবে সমাজকে নিয়ে কী করা যায়- শিক্ষিত মহলে এটাই ছিল প্রতিষ্ঠিত মনোভাব। ওদিকে ছিল মানুষের ধর্মপ্রাণতা। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নিরীহ জাতীয়তাবাদীরাও বলতে ভালোবাসতেন; কমিউনিস্টরা ভালো মানুষ বটে, কিন্তু ওরা ধর্ম মানে না, ওদের অনেকেই নাস্তিক। কমিউনিস্টরাও জনগণের কাছে এই সত্য নিয়ে সঠিকভাবে উপস্থিত হতে পারেননি যে মানুষের জীবনে মূল সমস্যাটা হলো বাঁচার। আর বাঁচার ব্যাপারটা ধর্মের সঙ্গে জড়িত নয়, জড়িত অর্থনীতির সঙ্গে। এটা করা ছিল একটা কঠিন দায়িত্ব। এর চেয়ে বরঞ্চ সহজ ছিল এটা প্রতিষ্ঠিত করা যে কমিউনিস্টরা ধর্মবিরোধী নন, ধর্মকর্মে তাঁদের মোটেই আপত্তি নেই। ধর্ম তো আছেই, ব্যক্তিজীবনে রয়েছে, সমাজজীবনেও আছে; কিন্তু যখন ইংরেজকে বিতাড়ন করা এবং দেশি শাসন-শোষণের অবসান ঘটানোর আন্দোলনের ব্যাপারটা সামনে আসে, তখন একসঙ্গে লড়তে হবে, নইলে নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি লেগে যাবে। যেটা করলে মুক্তি আসবে না- এই বিষয়টা বোঝানো খুবই জরুরি ছিল।
কংগ্রেস ও লীগ- উভয় দলের জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন সমাজতন্ত্রবিরোধী। এখানে তাঁরা একাট্টা। ফলে সমাজতন্ত্রীদের উভয় পক্ষই চেষ্টা করত দমিয়ে রাখতে। ওদিকে ব্রিটিশের দৃষ্টিভঙ্গিটাও ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা জানত, জাতীয়তাবাদীরা যতই উগ্র হোক না কেন তাদের সঙ্গে একটা আপসরফায় আসা যাবে, যে ধারণাটা মোটেই অমূলক ছিল না। বিপরীত পক্ষে সমাজতন্ত্রীরা দল হিসেবে ছোট হলেও সম্ভাবনার দিক থেকে ছিলেন বিপজ্জনক। তাঁরা আপস করবেন না, পূর্ণ স্বাধীনতা চাইবেন এবং সমাজ বিপ্লব ঘটানোর দিকে মানুষকে নিয়ে যাবেন। সেই বিপ্লব ঘটলে ইংরেজকে কেবল যে ভারত ছাড়তে হবে তা নয়, তাদের তল্পিতল্পাও বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে বাজার তো নয়ই, এমনকি প্রভাববলয়টাও অক্ষুণ্ন থাকবে না। ইংরেজরা ১৮৫৭ দেখেছে, ১৯১৭-এর রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অবহিত হয়েছে; তাই কমিউনিস্টদের তৎপরতা শুরু হয়েছে দেখে মোটেই সময় নষ্ট করেনি, 'অঙ্কুরেই বিনাশ সাধন বুদ্ধিমানের কাজ' এই বিবেচনায় তারা সমাজতন্ত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের তারা মামলায় ফেলে কারাবন্দি করেছে, বছরের পর বছর আটকে রেখেছে। পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কমিউনিস্টদের পক্ষে প্রকাশ্যে পত্রিকা প্রকাশ করাও কঠিন ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম সমাজতন্ত্রী ছিলেন, সে জন্য তাঁর অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা 'ধূমকেতু'কে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং নজরুলকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণীগত, কিন্তু সামনে যে প্রশ্নটা ছিল সেটি হলো জাতির। ভারতবর্ষ মোটেই এক জাতির দেশ ছিল না, কমিউনিস্ট পার্টি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিল যে সেখানে জাতি ছিল ১৭টি, যাদের ভিত্তি ছিল ভাষা। কংগ্রেস বলল, এক জাতির কথা। কিন্তু তাদের সেই জাতীয়তার ভিত্তিটা কী, সেটা পরিষ্কার করে বলতে পারল না। মুসলিম লীগ বলল, ভারতবর্ষে জাতি রয়েছে দুটি এবং তাদের পক্ষে বলতে কোনো অসুবিধা ছিল না যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। মুসলিম লীগ ইঙ্গিত করল যে কংগ্রেস যে জাতীয়তাবাদের কথা বলছে, সেটা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। কংগ্রেস এ কথার প্রতিবাদ করল ঠিকই। কিন্তু তাদের আচার-আচরণেই মুসলমানদের মনে ধারণা তৈরি হলো যে কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুত্ব।
সমাজতন্ত্রীদের পক্ষেই সম্ভব ছিল ভারতবর্ষকে বহুজাতিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা। সেটা তাঁরা করেছিলেনও, কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের তৈরি করা সাম্প্রদায়িক ডামাডোলের ভেতর তাঁদের সে বক্তব্য জোরালোভাবে প্রকাশ পায়নি। কমিউনিস্ট পার্টির আরো একটি দুর্বলতা ছিল। সেটা হলো, তারা তাদের আত্মত্যাগ ও বিপুল কর্মোদ্যম সত্ত্বেও সমাজ বিপ্লবের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারেনি। জনগণের আবেগের ভাষা ও সাংস্কৃতিক মান দুটিই ছিল তাদের কাছে অনধিগম্য। নাস্তিকতার অভিযোগটাও কম অসুবিধার সৃষ্টি করেনি।
কমিউনিস্টরা কোন পথে অগ্রসর হবেন- সেটাও ঠিক করতে পারেননি। সমাজতন্ত্রীদের একাংশ ঠিক করেছিল কংগ্রেসের ভেতর থেকেই কাজ করবে। তারা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করল; কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তো কমিউনিস্টদের কংগ্রেস থেকে বের করেই দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব ছিল রক্ষণশীল; যে জন্য দু-দুবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েও সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসে থাকতে পারেননি এবং জওয়াহের লাল নেহরুকে থাকতে হয়েছিল রক্ষণশীলদের সঙ্গে আপস করে।
যে সমাজতন্ত্রীরা আলাদাভাবে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন, তাঁরাও পথ-বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এর বড় কারণ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কেন্দ্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভর করা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঢালাও কোনো পথ নেই। সমাজের আর্থ-সামাজিক বিকাশ, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য- এসবকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করেই রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করার কথা। ভারতীয় কমিউনিস্টরা সেটা করতে পারেননি। ফলে তাঁরা আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের নির্দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় একটি বিপর্যয় ঘটে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই যুদ্ধ যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ভেতর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল, এটা কমিউনিস্ট পার্টি বুঝতে ভুল করেনি। কিন্তু হিটলার যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসলেন, তখন কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে যুদ্ধের চরিত্রে একটি পরিবর্তন ঘটেছিল। এটি পরিণত হলো জনযুদ্ধে এবং সারা বিশ্বে কমিউনিস্টদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে দাঁড়ানো। পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্টরা দেখলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণকারী নাৎসি জার্মানির শক্র যে মিত্রবাহিনী, তারা তাঁদের মিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করার এই নীতি ভারতের কমিউনিস্টদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সংগ্রাম যখন একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তাতে কমিউনিস্টরা যে আপসহীনভাবে অংশ নিতে পারছেন না, বরঞ্চ ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, সেই ঘটনা দেশবাসীর পক্ষে তো হতাশাব্যঞ্জক ছিলই; কমিউনিস্টদের নিজেদের কাছেও কম অস্বস্তিকর ঠেকেনি। ফল দাঁড়াল এই যে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্বের জায়গায় তো যেতে পারলেন না, বরঞ্চ পিছিয়ে গেলেন। কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। জয়জয়কার তখন কংগ্রেস ও লীগের। কমিউনিস্টরা তখন নিজের ভূমিকা থেকে সরে এসে কংগ্রেস ও লীগকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সমাজতন্ত্রীরা জাতীয়তাবাদীদের হিংসা ভুলে এক হতে বলছেন; কিন্তু সে ঐক্য যে সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে যাবে না, সেটা খেয়াল করার সুযোগ পাচ্ছেন না- অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল এ রকমেরই। প্রধান দ্বন্দ্বটা ছিল ব্রিটিশের সঙ্গে জনগণের। এই দ্বন্দ্বে কংগ্রেস ও লীগকে এক করা যাবে- এটা ছিল একটি অবাস্তব ধারণা। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্ররা যে প্রায় বিপ্লবী একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার শক্তি পার্টির ছিল না। পার্টি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে।
শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভারতবর্ষ দুই টুকরো হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষকে উৎপাটন, দুর্ভোগ পোহানো, প্রাণ হারানো, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার তুলনাবিহীন বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : শিক্ষাবিদ, ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments