ঢাকা কলেজ কীর্তিত হোক নতুন গৌরবে by আয়েশা বেগম
ঢাকা কলেজ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংলিশ সেমিনারি স্কুল। এই স্কুলেরই কলেজ শাখা 'ঢাকা কলেজ'-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম কখন শুরু হয় সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমাদের অজানা।
১৮৪৮ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিল ২৮৯ জন। ১৮৫৮ সালে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৮৫৭-৫৮ বর্ষে চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি কোর্স, ১৮৬২ সালে দু'বছরের ফাইন আর্টস কোর্স এবং '৬৩ সালে এমএ কোর্স খোলা হয়। ঢাকা কলেজ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন দু'জন_ প্যারিমোহন বিশ্বাস (দ্বিতীয় শ্রেণী) ও হরিচৈতন্য ঘোষ (তৃতীয় শ্রেণী)।সময়ের প্রয়োজনে ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসের স্থান বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের এক পর্যায়ে ঢাকা কলেজকে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে (ছোট লাট ভবন) স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের পুনর্বাসনের জন্য কলেজ ভবনটি ছেড়ে দিতে হয়। কলেজটি লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান কবি নজরুল কলেজ) এবং তারও পরে সিদ্দিকবাজারে পুনঃস্থাপিত হয়। স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সর্বশেষ পর্যায়ে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে কলেজটি নিউ মার্কেট সংলগ্ন মিরপুর রোডের পশ্চিম প্রান্তে বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়।
বর্তমান ঢাকা কলেজ ১৮ একর জমির ওপর অবস্থিত। এর সম্মুখভাগে রয়েছে সুদৃশ্য বাগান, টেনিস ও বাস্কেটবল খেলার মাঠ। পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ৭টি ছাত্রাবাস ও মসজিদ। কলেজের মূল ভবনের পেছনে এবং ছাত্রাবাসের সামনে রয়েছে দুটি বিশাল খেলার মাঠ ও পুকুর। পুকুরের পাড়ে কলেজের ক্যান্টিন ও জিমনেসিয়াম। পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে, অর্থাৎ প্রধান গেটের সামনেই শহীদ মিনার, প্রশাসনিক ভবন ও উদ্ভিদবিদ্যা ভবন, অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকমণ্ডলীর বাসভবন। 'কলা ও সমাাজিক বিজ্ঞান', 'ব্যবসায় শিক্ষা' এবং 'বিজ্ঞান' অনুষদের অধীনে ২০টি বিভাগ রয়েছে। ১৯টি বিভাগেই স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্স আছে। ২০১০ সালের ১ আগস্ট নতুন বিভাগ হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ওঈঞ বিভাগ আত্মপ্রকাশ করে। শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের কৃতিত্বই সবচেয়ে বেশি। তাদের কেউ দেশের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, আইনবিদ, ব্যবসায়ী ইত্যাদি শীর্ষ পদ অধিকার করে আসছে। এ কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র ড. মামুন আবদুল গাইউম দীর্ঘ প্রায় ৩৩ বছর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ ছাড়া আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান, সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ভাষাসংগ্রামী ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদুজ্জামান, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস, শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা ও ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনসহ প্রথিতযশা অনেকেই ঢাকা কলেজের ছাত্র। শিক্ষার পাশাপাশি ঢাকা কলেজের ছাত্ররা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়েও অবদান রেখে আসছেন। ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬২ সালের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল আন্দোলনে, '৬৯ ও ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজির স্থাপন করেছে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা কলেজের ছাত্র নজরুল ইসলাম, আবদুস সবুর শিকদার, নজিব উদ্দিন খান খুররম, আলী আহসান, মোয়াজ্জেম হোসেন, নিজামুদ্দিন আজাদ, আজিজুল ইসলাম বাবুল ও এমএ কাইয়ুম শহীদ হন। তাদের আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার ছাত্র এই কলেজে অধ্যয়নরত। ছাত্রসংখ্যার এই বিপুলতাজনিত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা কলেজের শিক্ষার উচ্চমান ও গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে শিক্ষার আধুনিকায়ন ও মানোন্নয়নের বহুমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। গত দু'বছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অধ্যক্ষের কক্ষ, টিচার্স লাউঞ্জ ও অফিসকক্ষের আধুনিকায়ন ও সৌন্দর্যায়ন ঘটেছে। নন্দিত স্থাপত্যবিশিষ্ট নির্মীয়মাণ রয়েছে কলেজের ফটক; প্রক্রিয়াধীন একটি স্বতন্ত্র পরীক্ষা ভবন ও একটি ছাত্রাবাস। আগামী ২০ বছরের একটি উন্নয়ন-রূপকল্পও আমরা প্রস্তুত করেছি_ ছাত্র-শিক্ষক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, শ্রেণীকক্ষ আধুনিকায়ন, অফিসের কার্যক্রমকে প্রযুক্তির আওতায় আনয়ন, সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা, প্রত্যেক বিভাগে ঈড়সঢ়ঁঃবৎ খধন স্থাপন করা। রয়েছে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা, যেমন_ ডিজাইন ঠিক রেখে মূল ভবনের গ্যালারি ব্লক ভেঙে ৬ তলা করে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ; প্রশাসনিক ভবনের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নকরণ (চতুর্থ তলা থেকে দশম তলা পর্যন্ত); ক্যান্টিন এবং ক্রীড়া ভবন ভেঙে সেখানে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যান্টিন এবং ছাত্র সংসদের ৬ তলা ভবন নির্মাণ; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস ভেঙে ১২ তলা ছাত্রাবাস নির্মাণ; পুরনো হোস্টেলগুলো যেমন_ উত্তর, দক্ষিণ, আন্তর্জাতিক ও পশ্চিম ছাত্রাবাস পর্যায়ক্রমে মেরামত; শিক্ষক কোয়ার্টার ভেঙে ঊর্ধ্বমুখী ১৪ তলা টাওয়ার নির্মাণ; শহীদ মিনার সংস্কার; মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ ও ঐতিহ্য গ্যালারি নির্মাণ; কলেজ ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসের রাস্তাগুলো পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার এবং মূল ভবনের সঙ্গে অন্যান্য ভবনের লিংক স্থাপন, অডিটোরিয়াম কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার করা, লন টেনিস ও বাস্কেটবল মাঠ মেরামত।
ছাত্রদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের লক্ষ্যে মানসিক ও নৈতিক পরিচর্যার প্রয়োজনে গত এক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, বিতর্ক, বিজ্ঞান মেলা। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একটি আস্থা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক; ছাত্ররা ক্রমে হয়ে উঠছে শ্রেণীকক্ষমুখী; সাম্প্রতিক উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ফলে এসব প্রয়াসের প্রভাব স্পষ্ট পরিলক্ষিত। 'জাগুক প্রাণ উৎসবের গানে। জ্ঞান-গৌরবময় আগামীর আহ্বানে' এই প্রাণজ উচ্চারণে ঢাকা কলেজ পালন করছে ১৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আগামীর স্বপ্নে, ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণে সূচিত হোক প্রবীণ-নবীনের সহযাত্রা ও উন্নয়ন-উদ্যোগ। শিক্ষা, শৃঙ্খলাবোধ, মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ছাত্রদের কৃতিত্বে ঢাকা কলেজ কীর্তিত হোক নতুন গৌরবে।
প্রফেসর ড. আয়েশা বেগম : অধ্যক্ষ
ঢাকা কলেজ
No comments