ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওবামার ভাষণ- রোহিঙ্গাদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করুন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণে ওবামা মিয়ানমার সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানান।
ভাষণে ওবামা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদের ওপর উৎপীড়ন চালানোর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। যেকোনো মূল্যে সেখানে চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।এর আগে ওবামা প্রথমে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে এবং পরে সে দেশের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। দর্শকের সারিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশটির বহুসংখ্যক সাবেক রাজবন্দী উপস্থিত ছিলেন।
ওবামার ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যা বিশেষ গুরুত্ব পায়। এ ছাড়া দেশটিতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
রাখাইন রাজ্যের সহিংস পরিস্থিতির উল্লেখ করে ওবামা বলেন, ‘জাতীয় আপস সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের সাধারণ মনুষ্যত্বের দিকে চেয়ে এবং এ দেশের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় এনে এখনই সব ধরনের উসকানি ও সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।’
ওবামা আরও বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় যে হতাহত ও অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেদিকে এখন আমাদের দৃষ্টি রয়েছে এবং আমরা সেখানকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছি।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইন আদিবাসীসহ সব বাসিন্দা চরম দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্ট মোকাবিলা করে আসছে। কিন্তু নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো অজুহাত থাকতে পারে না। আপনার এবং আমার যে রকম আত্মসম্মান আছে; ঠিক একইভাবে রোহিঙ্গাদেরও আত্মসম্মান আছে।’ তিনি বলেন, মিয়ানমারের উচিত রোহিঙ্গাদের সামাজিকভাবে মেনে নেওয়া।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার সরকার সে দেশের নাগরিক হিসেবে মনে করে না।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কার প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, মিয়ানমারের সামনে গণতান্ত্রিক সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখা এবং ‘একটি নতুন যাত্রার শক্তি’ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে। সমাজের শীর্ষপর্যায়ে যে সংস্কারের উদ্যোগ এসেছে, তাতে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে। তিনি দেশটির সংস্কার কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতিও দেন।
এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে বারাক ওবামা গতকাল ছয় ঘণ্টার সফরে মিয়ানমারে যান। সকালে ওবামাকে বহনকারী এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানটি থাইল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে অবতরণ করে। সফরসঙ্গীদের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও ছিলেন। বিমানবন্দরে তাঁদের লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
বিমানবন্দর থেকে ওবামা মোটর শোভাযাত্রাসহকারে ইয়াঙ্গুনের কেন্দ্রস্থলে আঞ্চলিক পার্লামেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার লোক ওবামাকে স্বাগত জানায়।
থেইন সেইনের সঙ্গে বৈঠকের পর ওবামা সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমার কেবল যাত্রা শুরু করেছে। দেশটিকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন যে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা দেশটিতে অবিশ্বাস্য উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সাংবাদিকদের থেইন সেইন বলেন, উভয় পক্ষ মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক মানের মানবাধিকার জোরদারের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এ ছাড়া উভয় পক্ষ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
থেইন সেইনের সঙ্গে বৈঠকের পর ওবামা গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর লেকপাড়ের বাসভবনে যান। সু চি এই বাড়িতেই বছরের পর বছর গৃহবন্দী ছিলেন।
বৈঠকে সু চি তাঁর দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিতে সহযোগিতা করায় যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান। তবে তিনি মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে অতিরিক্ত আশা করা ঠিক হবে না বলে ওবামাকে সতর্ক করে দেন। বৈঠকে সু চি বলেন, ‘সাফল্যের মরীচিকায় প্রলুব্ধ হলে চলবে না; এ ব্যাপারে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে।’
ওবামা সু চিকে জানান, তাঁর এই সফরের লক্ষ্য মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ-প্রক্রিয়ার গতি অব্যাহত রাখা। তিনি বলেন, এ জন্য গ্রহণযোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং দেশের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সু চির সঙ্গে ওবামার বৈঠকে রোহিঙ্গা-সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের কিছু বলেননি।
পরে ওবামার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলটি ইয়াঙ্গুনে শদাগন প্যাগোডা পরিদর্শন করে।
গত জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত রাখাইনে দুই দফায় ঘটে যাওয়া জাতিগত দাঙ্গায় কমপক্ষে ১৮০ জন নিহত হয়েছে। ভিটেছাড়া হয়েছে এক লাখ ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান। ওবামাই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি মিয়ানমার সফর করেছেন। তাঁর সফরের সম্মানে গতকাল মিয়ানমার সরকার ৫০ জন রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। এসব কারণে ওবামার এই সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষকেরা।
ছয় ঘণ্টার মিয়ানমার সফর শেষে ওবামা কম্বোডিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে গিয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের সম্মেলনে যোগ দেন। বিবিসি ও এএফপি।
No comments