রাজনীতি- ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ হলে কী লাভ by শান্তনু মজুমদার
জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের মুখে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি নতুন করে জোরালো হয়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবারের পত্রপত্রিকায় ৩৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ দাবির পক্ষে মত রেখেছেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের ‘যে দাবি উঠেছে, এখনই তা সক্রিয়ভাবে বিবেচনার উপযুক্ত সময়’ বলে মত দিয়েছেন।
বিশিষ্ট নাগরিকদের দাবি প্রকাশের আগে থেকে কয়েক দিন ধরেই নাগরিক সমাজে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। আলোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদেও।প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা উচিত কি না? আর যদি বন্ধ করা হয়, তার ফলাফল কী হবে? এই কলামটির লেখকের উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বর্তমান বাস্তবতায় ঠিক হবে না। কেননা, এ ধরনের যেকোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে মৌলবাদীরা সোজাসুজি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা এই মিথ্যাচারে বহুলাংশে কামিয়াব হবে। কারণটা কী? কারণ হচ্ছে, সামরিক আমল থেকে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদীরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে পেয়ে সমাজদেহে এ ধরনের একটা ভাবনা ভালো রকমে প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে। ভালো ভালো মানুষকেও হঠাৎ হঠাৎ এই মিথ্যার ফাঁদে স্বেছায় বা অজ্ঞাতে আটকে থাকতে দেখা যায়। মৌলবাদীরা কয় ভোট পায়? এ রকমের ঘাড়ত্যাড়া হিসাব করে পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। রোগ যদি গুরুতর হয়, তাহলে চিকিৎসা সেভাবে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আধা-খেঁচড়া অপারেশন ক্যানসার নির্মূল করে না। মৌলবাদ নামক রোগের চিকিৎসা করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুস্থ করতে চাইলে উত্তেজনা ছড়িয়ে আচমকা সমর্থন তৈরি করে এক বা একাধিক দল নিষিদ্ধ করে আখেরে কোনো লাভ হবে না। বাংলাদেশের যা অবস্থা, তাতে করে সামনের দিনগুলোতে মৌলবাদের জন্য তেমন সুবিধা হবে না, এটা সত্য। কিন্তু দেশি-বিদেশি নানা কারণে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার দরুন এরা আরও কিছু ঝামেলা পাকাতে সক্ষম হবে।
নিষিদ্ধ করে আসলে লাভ হয় না। হোসনি মোবারকের আমলে মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরে নিষিদ্ধ ছিল। তো কী হয়েছে? এবার তারা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায়। এনাহাদা মুভমেন্ট তিউনিসিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল। আরব বসন্তের পর এনাহাদা এখন ভোটে জিতে ক্ষমতায়। গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়া এই এপ্রিলের শেষে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে; মে মাসের শুরুতে মৌলবাদীদের চাপের মুখে তা তুলে নেয়। মোবারক ও গাদ্দাফিরা মৌলবাদ মাথা তুলতে না দেওয়াসংক্রান্ত নানা গালগল্প করে ধর্মনিরপেক্ষদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করত। বাস্তবতা তা নয়। এসব জায়গায় মৌলবাদের প্রসার হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য অনেক জায়গার মতো। তথাকথিত নিষেধাজ্ঞায় মৌলবাদীদের প্রসার আটকে থাকেনি এসব জায়গায়। আসলে নিষিদ্ধ করে কাজ হয় না। বাংলাদেশেও হবে না। মৌলবাদ অঙ্কুরে বিনষ্ট করা যায়নি। এই বিষবৃক্ষকে এখন নিষেধাজ্ঞা নামক কুড়ালের এক ঘায়ে উপড়ানোর চেষ্টা নিষ্ফল হবে।
নিষেধাজ্ঞাপন্থীদের আরও মনে রাখতে হবে যে, ১৯৪৭ ও ’৭১-এ পরাজিত হলেও ’৭৫-এ নবজীবন পেয়ে ২০০১-এ এসে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। বাংলাদেশে ’৪৭-বিষয়ক ফয়সালা এখনো সম্পন্ন হয়নি। ’৭১ নিয়ে তেমন একটা প্রশ্ন না তুললেও ’৪৭-কে পাকে-প্রকারে মহীয়ান করার চেষ্টা মৌলবাদীদের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী অমৌলবাদীরাও ভালোভাবে করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মতো যৌক্তিক কাজকেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বলে প্রচার করে যাচ্ছে মৌলবাদী ও তাদের অমৌলবাদী ‘প্রগতিশীল’ বন্ধুরা। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক পর্যায়ে এসব শক্তিকে প্রতিরোধ করার আগে সংসদে আসনসংখ্যার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মৌলবাদ নিষিদ্ধ করা হলেও তা বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির পিচ্ছিল জমিনের পদে পদে কাঁটা বসানোর কাজ করতে থাকবে।
ধরা যাক, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলো, তাতে মৌলবাদের কার্যক্রম কি বন্ধ হয়ে যাবে? আদৌ না, এটা সামাজিক পর্যায়ে আরও ঘনীভূত হয়ে কাজ করতে শুরু করবে। অন্য একটা ঝুঁকিও আছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর এদের কোনো কোনোটি যদি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়? গোপনপন্থী হয়ে পড়লে এদের সামাল দেওয়ার জন্য অনেক বাড়তি শক্তি ব্যয় করতে হবে। মৌলবাদকে যদি সভ্যতার পথে বড় এক অন্তরায় মনে করা হয়, তাহলে আসল কাজ হবে এটিকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা, অপাঙেক্তয় করে তোলা। সমাজের মধ্যে মৌলবাদের আবেদন শূন্য করে দেওয়ার কঠিন কাজটি সামাজিক পর্যায়েই ভালোভাবে করা। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ, মৌলবাদের ভবিষ্যৎকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে আবদ্ধ রেখে ভাবলে কোনো ভালো রাস্তা দেখা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার সম্ভাবনা ও মৌলবাদের বিপদকে দেখতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে এবং অতি-অবশ্যই আঞ্চলিক পরিসরে; উপমহাদেশের পরিসরে। ভারতে মৌলবাদের প্রকোপ অব্যাহত থাকবে, কিন্তু বাংলাদেশে এ রোগ একেবারে উপশম হয়ে যাবে—এ রকম ভাবনাটাই অবান্তর। কিংবা পাকিস্তানে থাকবে, ভারতে থাকবে না কিংবা ভারতে থাকবে, পাকিস্তানে থাকবে না, এটা কখনো হবে না। আসলে এ রকম ভাবনা পরিত্যাজ্যও বটে। সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের বিস্তার কোনোভাবেই এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সীমানানির্ভর নয়। আর বড় শরিকের ঘরে এর বাড়বাড়ন্ত হলে ছোট শরিক মনেপ্রাণে যত চেষ্টাই করুক না কেন, পুরো নিস্তার পাবে না। মৌলবাদ ঠেকানোর কাজটা সে জন্য তৃণমূল থেকে শুরু হয়ে সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এসে আটকে গেলেও হবে না। এই আন্দোলন হতে হবে রাষ্ট্র নয়, নাগরিক সমাজের নেতৃত্বে; বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে একযোগে। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় একযোগে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। মৌলবাদীদের সহিংসতা দমন এক কথা আর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা আরেক কথা। মৌলবাদীদের চলমান সহিংসতা কঠোরভাবেই দমন করতে হবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু দমনের নামে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার মতো হঠকারিতা কোনোভাবেই নয়; বরং মৌলবাদ বিলোপে সামাজিক শক্তির নেতৃত্বকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে ভাবনায় ক্ষমতাসীনেরা মন দিলে ভালো হয় বলে মনে হয়।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবিষয়ক গবেষক।
No comments