টিআইবির বিরুদ্ধে এমপিদের তোপ নিষিদ্ধ করার দাবি
এবার সংসদ উত্তাল হলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নিয়ে। সংগঠনটির সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ থেকে তাদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান মহাজোটের সংসদ সদস্যরা। এমপিদের মতে, মাইনাস টু থিয়োরি ব্যর্থ হওয়ায় টিআইবির কর্মকর্তারা নতুন থিয়োরি নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
নিজেদের তাঁরা 'সুপারপাওয়ার' মনে করেন। তাঁরা রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ, গণতন্ত্র- কিছুই মানেন না। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে তাঁদের কোনো দাম থাকে না। অনির্বাচিত সরকারের সময় তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার অংশীদার ভাবেন।টিআইবি কর্মকর্তাদের অর্থের উৎসের খোঁজ নিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি তোলেন সংসদ সদস্যরা। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও তাঁদের সম্পদের খোঁজ নেওয়ার তাগিদ দেন তাঁরা। সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে টিআইবির রিপোর্টের কড়া সমালোচনা করে তাঁরা এর বিরুদ্ধে স্পিকারের রুলিং দাবি করেন। টিআইবি গত ১৪ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে ৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গতকাল জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে টিআইবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের কড়া সমালোচনা করে সংসদ সদস্যরা আরো বলেন, হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসত্য, কাল্পনিক, মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে সংসদ সদস্যদের প্রতি আঘাত হানা হয়েছে।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনার অবতারণা করেন। পরে একে একে সবাই বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য হাত তোলেন। স্পিকার বলেন, 'আমি হাউসের সেন্টিমেন্ট বুঝতে পেরেছি। তবে সময়ের অভাবে সবাইকে সুযোগ দিতে পারব না।' রুলিং প্রশ্নে স্পিকার বলেন, 'এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত দেওয়া আমার জন্য কঠিন। তাড়াহুড়ো না করে চিন্তাভাবনা করে পরে সিদ্ধান্ত দেব।'
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, 'টিআইবির রিপোর্টে ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩৩৯ জন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কাজে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে তাঁদের পছন্দমতো ৬০০ জন বাছাই করে এ রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা ঘৃণাভরে এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করি। সংসদ সদস্য কে ভালো, কে মন্দ সেই সার্টিফিকেট দেওয়ার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?'
তিনি অভিযোগ করেন, তাদের এ অপতৎপরতা নতুন নয়। ১/১১-এর আগে এই গোষ্ঠী রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র হনন করেছিল। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তারা তথাকথিত সৎ ও যোগ্য প্রার্থী খুঁজেছিল। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলও গঠন হয়েছিল। নির্বাচনের সময় তাদের সেই সৎ ও যোগ্যদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এখন আবার তারা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা মাইনাস টু থিয়োরিতে ব্যর্থ হয়ে নতুন থিয়োরি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা তৃতীয় শক্তির উত্থানের কথা বলে। এই তৃতীয় শক্তির উত্থান বাংলাদেশে আর হবে না।
তিনি বলেন, তথাকথিত এসব নীতিবান বুদ্ধিজীবী ১/১১-এর সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। তারাই এখন নৈতিকতার প্রতীক সেজেছে। তারা সভা-সেমিনারে নীতিবান সাজে। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। তারা বিলাসী জীবন কাটায়। তাদের আয়ের উৎস কী? অর্থমন্ত্রীকে বলব, 'এদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করুন।' দুর্নীতি দমন কমিশনকে বলব, 'এদের সম্পদের হিসাব নেন।'
তোফায়েল আহমেদ বলেন, টিআইবির এ রিপোর্ট দুঃখজনক; যেখানে বলা হয়েছে ৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। মাত্র ৬০০ জনের তথ্য নিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ আনা হয়েছে। স্পিকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'প্রিভিলেজ (বিশেষ অধিকার) কমিটির সভাপতি আপনি। আমিও ওই কমিটির একজন সদস্য। আপনি প্রিভিলেজ কমিটির সভা ডাকেন। টিআইবির যাঁরা এই রিপোর্ট করেছেন, তাঁদের ডাকেন। তাঁদের কাছে কী তথ্য আছে, জানতে চান।'
জাসদের শাহ জিকরুল আহমেদ বলেন, 'আমি তাঁদের চ্যালেঞ্জ করছি। তাঁদের আয়করগুলো আমার সামনে দেওয়া হোক। তাঁদের যে খরচ হয়েছে, আমি ওই ছয় শ লোকের আয়কর নথি দেখব। আমার আয়কর নথি তাঁদের সামনে উপস্থাপন করব। আমার কোনো ত্রুটি থাকলে আমি আপনার সামনে পদত্যাগ করব। জনগণের সমর্থন নিয়ে এই সংসদে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি তাঁদের মতো রাতের অন্ধকারে টক শো করার জন্য নয়।'
তারানা হালিম বলেন, 'ছয় শ লোক কারা? রিপোর্টে কোনো তথ্যসূত্র ছিল না। তাঁরা কারা। তাঁরা কি সুবিধাবঞ্চিত? তাঁরা কি এমপিদের কাছ থেকে টেন্ডার, চাকরি নিতে পারেননি? বিএনপি এই রিপোর্টটিকে স্বাগত জানিয়েছে। ওই রিপোর্টে বিএনপির ৯০ শতাংশ অপকর্মে জড়িত বলে উল্লেখ আছে। টিআইবি নিজেই এ রিপোর্টের দায় নেয়নি।'
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'সংসদ সদস্য হয়ে যেন কিছু লোকের সামনে অপরাধ করে ফেলেছি। বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্য এমপিদের বিরুদ্ধাচরণ। কিছু শিক্ষিত লোকের ফ্যাশন হয়ে গেছে এমপিদের বিরুদ্ধে কথা বলাটা।' তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের ৯ মাস আগে এ ধরনের রিপোর্ট অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সুবিদ আলী ভুইয়া বলেন, 'দুর্নীতি শব্দটা আমার জানামতে করিনি। এই অপবাদ নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। এ অভিযোগ সহ্য করব না। আমাদের গার্ডিয়ান হিসেবে, স্পিকার হিসেবে আপনি এ বিষয়ে একটা কিছু করুন।'
নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, 'এই রিপোর্ট দেশের জনগণের অপমান। ব্যক্তিগতভাবে কেউ অপরাধ করে থাকতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে অভিযোগ আনা অন্যায়।'
সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পরে স্পিকার আব্দুল হামিদ বলেন, 'রিপোর্টটি আমিও পড়েছি। মিডিয়ায় এ বিষয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছি। টিআইবি দেশের ৪৪ বা ৪৬টি জেলায় সার্ভে করে ৯৭ ভাগ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছে। ৯৭ ভাগ স্থানে তো তাঁরা যাননি। তাহলে কী করে ৯৭ ভাগের রিপোর্ট দেওয়া হলো?' তিনি আরো বলেন, 'মাত্র ছয় শ লোক, তাঁরা কারা? তাঁরা কি সাধারণ মানুষ, দলীয় লোক, নাকি তাঁদের (টিআইবির) বেতনভোগী কর্মচারী?' তিনি আরো বলেন, 'সরকার ও বিরোধী দল কেউ-ই যদি ভালো না হয়, তাহলে দেশটা কে পরিচালনা করবে? ইজ ইট টিআইবি? তাঁদের বলব, সামনে নির্বাচন আছে। অংশ নিয়ে আসেন। আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে। ঢালাওভাবে ৯৭ ভাগের কথা বলেছেন, তাহলে ভালো কে আছে? আমার অবস্থান কী, সেটাও জানি না। এভাবে আমাদের চরিত্র হনন করা ঠিক নয়।'
এ সময় অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই স্পিকার মিডিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'কেন জানি কিছু মিডিয়া সংসদ সদস্যদের চরিত্র হনন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এটা দুঃখজনক। এটা হওয়া উচিত নয়। নির্দিষ্টভাবে কোনো অপরাধ করলে বলেন, আমি এই অপরাধ করেছি। তাহলে আত্মপক্ষ সমর্থন করব।'
বিদ্যালয়ে ভর্তিতে সংসদ সদস্যদের কোটা প্রসঙ্গ তুলে আব্দুল হামিদ বলেন, 'সংসদ সদস্যদের ভর্তির জন্য কোটা আছে, এটা তারা কই পেল। আমি জিন্দেগিতে দুই ভাগের কথা শুনিনি। ভর্তির ক্ষেত্রে একটা সিরিয়াল ব্রেক করলেই তুলকালাম হয়ে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয় তাহলে মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারবে না। কিছু মিডিয়া এ ধরনের নিউজ করে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ইচ্ছাকৃতভাবে জনসাধারণের সামনে রাজনীতিকদের হেয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে।'
No comments