কূটনীতি- ওয়াশিংটনের দৃষ্টি দক্ষিণ চীন সমুদ্রের প্রতি by মিজানুর রহমান খান
একদিকে নতুন চীনা নেতা শি জিনপিং আর অন্যদিকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। নতুন নেতৃত্ব আর তাঁদের নতুন রণক্ষেত্র হলো দক্ষিণ চীন সমুদ্র। বহু দশক বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট।
তা থেকে দৃষ্টি সরে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায়। ইরাক-আফগানিস্তানও বহুকাল খবরের শিরোনাম হয়েছে। এবারে মনে হচ্ছে, নতুন শিরোনাম: দক্ষিণ চীন সমুদ্র তুমি কার? স্ট্যাচু অব লিবার্টির দেশ এবারে স্বাধীনতার ধারণা জনপ্রিয় করবে সমুদ্রে। এটা হলো সামুদ্রিক স্বাধীনতা, সমুদ্রে নৌ চালনার স্বাধীনতা।অবশ্য এরও রয়েছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। যুক্তরাষ্ট্র হুটহাট কিছু একটা শুরু করার দেশ নয়। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে তাদের ভাবনাচিন্তা বেশ পুরোনো। এমনকি বাংলাদেশের জন্মের আগে তারা ভেবে রেখেছে, আমাদের নৌবন্দরগুলো কীভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। যেমন, ওয়াশিংটনে পৌঁছে আমি জানতে পারি যে আমাদের বন্দরগুলোর ব্যবহার নিয়ে একজন হ্যারিংটন সত্তরের দশকেই সমীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। সদ্য হস্তগত হওয়া ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাসের প্রথম সচিব হেলেন ব্যাটজারের চিঠি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তিনি ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল রিচার্ড উইলসনকে লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সরকার বন্দর ব্যবহার-সংক্রান্ত ধারণাকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইছে। তবে হ্যারিংটন সমীক্ষা তারা ইতিবাচকভাবে নিলেও এখন অপেক্ষা করতে হবে।’ বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্মের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি মনে করি না যে এখানে কিংবা পূর্ব পাকিস্তানে উন্মুক্ত বন্দরের জন্য কাজ শুরু করতে পারি, যতক্ষণ না আমরা এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তাদের ঠিক কী পরিকল্পনা, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাই। হ্যারিংটন সমীক্ষার মুখ্য পরামর্শ হচ্ছে, এ বিষয়ে পাকিস্তান যেভাবে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে, সেভাবেই বিষয়টিকে হতে দেওয়া। আমিও দৃঢ়তার সঙ্গে মনে করি, আমাদের উচিত হবে পাকিস্তানকে তার মতো করে এ সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের গুঁতো ক্ষতিকর ফল বয়ে আনছে।’
৪১ বছর পরেও মনে হয় অবস্থাটি এখনো মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত তেরেসিতা শেফারের সঙ্গে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাগরমুখী ‘পিভোট’ (আবর্তনকীলক), চীন যাকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখে, তা নিয়ে কথা বলি। তেরেসিতা শীর্ষস্থানীয় দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ। তাঁর সাম্প্রতিক বই, হাউ পাকিস্তান নেগেশিয়েটস উইথ দি ইউনাইটেড স্টেটস, রাইডিং দ্য রোলার কোস্টার। উর্দু ও হিন্দিতে অনর্গল, বাংলাও ঈষৎ বলতে পারেন। তিনি বলছিলেন, ‘বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগ থেকে আমরা এ এলাকায় ছিলাম। এই যুদ্ধের পরে জাপান, ফিলিপাইন ও পূর্ব এশিয়ায় আমাদের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রণকৌশলগত নীতি হলো, অতীতের চেয়ে ভারত মহাসাগরে আমাদের অনেক বেশি স্বার্থসংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করা। ভারত মহাসাগরে আমাদের স্থায়ী ঘাঁটি নেই। কিন্তু এই রুটগুলো দিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো বেশ নিয়মিত যাতায়াত করে থাকে।’
আর এটাই আসলে এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় নতুন উত্তেজনা বয়ে আনবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন বয়ে এনেছে। আর সেই উত্তেজনা, যেখানে বেইজিং ও ওয়াশিংটন শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মুখোমুখি, সেখানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ ভারত মহাসাগরের সন্নিহিত দেশগুলোর ভূমিকা কী হবে। কারণ, যে পিভোট নীতিকে চীন অপছন্দ করে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেশীদের সেটাই পছন্দ করতে বলছে।
দক্ষিণ চীন সমুদ্রে জাপান, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন সরাসরি চীনের সঙ্গে ভূখণ্ডগত বিরোধে লিপ্ত। হিলারি ক্লিনটন অস্ট্রেলিয়ায় বলেছেন, ‘চীনকে অবশ্যই খেলার বিধিবিধান মানতে হবে।’ এর মানে হলো, দ্বীপের মালিকানা বিরোধের পটভূমিতে চীনা সামরিক প্রস্তুতির পাল্টা ব্যবস্থা নিতে ওই দেশগুলোর অধিকার তাকে মেনে নিতে হবে। এর আগে ভারতের টাইমস গ্রুপের টিভিতে সপ্তম নৌবহর-সংক্রান্ত ‘বানোয়াট গল্প’ ছাড়াও দি অস্ট্রেলিয়ান-এ রিপোর্ট দেখেছি, ‘বঙ্গোপসাগরের অদূরবর্তী কোকো আইল্যান্ডই হবে মার্কিন ড্রোনের দীর্ঘমেয়াদি নিবাস।’
বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া মার্কিন নৌমন্ত্রী রে মাবুজের কথায়, ‘ভারত মহাসাগরে আমাদের সক্রিয়তার মূলে যে এই অঞ্চলটি মার্কিন বাণিজ্যের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ, সেটাই নির্দেশ করছে।’ কিন্তু ক্লেয়ারমন্ট ম্যাকেকেন্না কলেজের সরকার বিভাগের অধ্যাপক মিনজিন পেই ১৩ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, ‘দুই দেশের দুই নতুন নেতা প্রকাশ্যে উঁচু স্বরে না হলেও ঘরোয়াভাবে স্বীকার করবেন যে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কে একটা গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। যদিও চীনা মুদ্রার মূল্যমান ও বাণিজ্য বিরোধটা গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যকার অবনতিশীল সম্পর্কের প্রকৃত কারণ অনেক গভীর ও তা ভয়ংকরও বটে। গত দুই বছরে পরস্পরের মধ্যকার কৌশলগত অবিশ্বাস আরও তীব্রতা পেয়েছে। এবং যদি তা দ্রুত বন্ধ না হয়, তাহলে দুই দেশই এমন ভয়ানক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবে, যা উভয়ের জন্য ক্ষতি ডেকে আনবে।’
এই বিরোধের মূল কারণ দক্ষিণ চীন সমুদ্রে ভূখণ্ডগত বিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৬ নভেম্বরে বলেছেন, তাঁরা মনে করেন সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করবে। এতে বাইরের কোনো দেশের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত নয়।
বারাক ওবামার পূর্ব এশিয়া সফর সম্পর্কে চীন বলেছে, ‘তারা উদ্বিগ্ন নয়। এ সফরকে তারা তাদের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে না।’ এ উক্তি করেন চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ফু ইয়ং। এর মানে হলো, ওবামার সফরকে ঘিরে এমন একটা কথা উঠেছে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির নেতৃত্বে একসঙ্গে পরিবর্তন দুই দশক অন্তর নাকি একবার ঘটে। তবে এবারে বহু দশকের নীরবতা ভেঙে বিশেষ করে পাশ্চাত্যের কাছে মিয়ানমারের দ্বারোদ্ঘাটন সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। এটাও সত্য যে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সংলাপে চীনা সংবেদনশীলতা একেবারেই অগ্রাহ্য করেছে, তা নয়। ২০০৭ সালেও দেখা গেছে, মিয়ানমার (বর্মি) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধির বৈঠক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রক হয়েছে বেইজিং। আর এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এমন দুজন নেতা নির্বাচিত করতে পেরেছে, যাঁরা তাঁদের সম্পর্কের টানাপোড়েন সত্ত্বেও বিশ্বকে নতুন করে উত্তেজনার মধ্যে না ফেলতে কুশলী হতে পারবেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments