যুক্তরাষ্ট্র- নাফিস: নিরাপত্তার নামে সন্ত্রাসী বানানো! by বিজয় প্রসাদ
সাংবাদিকের ঝাঁক বাণিজ্যিক এলাকা ম্যানহাটনের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে দৌড়াল। ভবনটি ওয়াল স্ট্রিট এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে। তারপর তারা ভিড় জমাল নিউইয়র্ক আদালতকক্ষে। সেখানে ২১ বছর বয়সী বাংলাদেশি ছাত্র কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শুনছিল।
সেখান থেকে একদল গেল নাফিসকে যেখানে আটক রাখা হয়েছে, সেই ব্রুকলিন ডিটেনশন সেন্টারে। কেউ দৌড়াল পাশের জ্যামাইকা এলাকায় নাফিসের বাসস্থানে। যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের নিয়তে যুক্তরাষ্ট্রে আসার অভিযোগ তুলেছে সরকার, তার বিষয়ে টুকরো টুকরো কাহিনি জোড়া লাগাতে ব্যতিব্যস্ত সবাই।সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের শিরোনামগুলো চিৎকার করে বলছে: ‘সন্ত্রাসী হামলা বানচাল’। সরকারের অভিযোগ, নাফিস আল-কায়েদার লোক। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকেই সে ইন্টারনেটে, মূলত ফেসবুকে জঙ্গি মনোভাব দেখিয়েছে। এফবিআই ও নিউইয়র্ক পুলিশ (এনওয়াইপিডি) ফেসবুকে তার লেখালেখি খুঁজে বের করেছে। তারপর এফবিআই-এনওয়াইপিডির এক এজেন্ট নাফিসের প্রতি দরদি জঙ্গি সেজে ফেসবুকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। দুজনে মিলে হামলার চিন্তাভাবনা করতে থাকে। ওই এজেন্টই তাকে এক হাজার পাউন্ডের বোমা ও ডেটোনেটর বলে কিছু জিনিস গছায়। নাফিস বোমাটা গাড়িতে ভরে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের পাশে নিয়ে আসে। এখান থেকেই ভুয়া বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টার সময় তাকে আটক করা হয়।
সরকারের অভিযোগপত্র ভাসা ভাসা। সন্ত্রাসী ঘটনাটি যেহেতু ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ চাদরে মোড়ানো, সেহেতু সরকার অনেক কিছুই গোপন রাখবে। এফবিআই-এনওয়াইপিডির এজেন্টের সঙ্গে দেখা করার সময় নাফিসের অবস্থা কী ছিল, তা জানা জরুরি—সে কি তখন কেবল অসন্তুষ্ট ছিল, নাকি ততক্ষণে সহিংস কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিল? নিউইয়র্ক পুলিশ কমিশনার রেমন্ড কেলি বলছেন, নাফিস ইতিমধ্যে সন্ত্রাসী হামলার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গী হাওয়ার্ড উইলি কার্টারকে শিশু পর্নোগ্রাফি রাখার অভিযোগে আটক করা হয়। বোমা ষড়যন্ত্র বিষয়ে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এক তরুণ, এক বিকারগ্রস্ত বৃদ্ধ, সরকারি এক গোয়েন্দা, ‘আমেরিকাকে ধ্বংস করার’ হঠকারী বুলি, বোমা হামলার বিপজ্জনক ইঙ্গিত—এই আউলা স্যুপ থেকে বের করা হলো হামলাচেষ্টার অভিযোগ। একজন আটক হলো, তারপর গণমাধ্যমে রটানো হলো, সঙ্গে সঙ্গে ৯/১১-এর এক দশক পরেও ভয়তাড়িত একটি সমাজের ভয়ের নেশা আরও বেড়ে গেল।
নাফিসকে কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরিবার ছটফট করছে, বাংলাদেশ সরকার মিনমিন করে কূটনৈতিক অধিকার প্রয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে, আর সে বসে আছে গারদের ভেতরে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার বিরাট ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নাফিসকে ছাড়ানোর আইনি চেষ্টা ঠেকাতে মজুদ করছে তথ্য-প্রমাণ। ঠিক এভাবেই জর্জ বুশের আমলে অজস্র উপায়ে শক্তিশালী করা আর ওবামার আমলে আরও জোরদার করা পদ্ধতিগুলো কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দারা নাফিসকে ফাঁদে ফেলেছিল। দুটি সরকারই মার্কিন সংবিধানের চেতনাকে অবশ করে নাগরিক অধিকারের ফাঁপা মূর্তি গরম হাওয়ায় ফুলিয়ে রাখায় ওস্তাদি দেখিয়েছে। আলোর মুখ দেখবে না তাদের সাক্ষ্য-প্রমাণ। কারণ, এফবিআই বিচারকদের বলেছে, সেগুলো যেন গোপন কক্ষে বদ্ধ করে রাখা হয়। আইনজীবীরা যখন সেসবে নজর বোলাবেন, তখন তাঁদের ওপর নজর রাখবে ভিডিও ক্যামেরা।
নাফিসের ব্যাপারটার বিচার শুরু হওয়ার আগেই ভুয়া দেখাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নাফিসের ঘটনাটা অন্যগুলোর মতো নয়। তাঁদের হয়তো মনে ছিল সাম্প্রতিক সময়ে সাড়া জাগানো এ রকম কিছু ঘটনার কথা, যেগুলো পরে মামুলি বলে গণ্য হয়েছে। নাফিস হচ্ছে আসল সন্ত্রাসী, যেন অন্যরা ছিল প্রতারণার শিকার অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ। রাইটস অ্যাট রিস্ক: লিমিটস অব লিবার্টি ইন মডার্ন আমেরিকা গ্রন্থের লেখক ডেভিড শিপলার লিখেছেন, ‘নাফিসের মতো যারা এফবিআইয়ের ড্রাগনেটে ধরা পড়েছে, তাদের মনে হয়েছে স্ববিরোধী, অসমর্থ, অনিয়ন্ত্রিত, কিছু একটা হতে চাওয়া পোলাপান। গোয়েন্দা তথ্যদাতা অথবা এজেন্টরা দক্ষতার সঙ্গে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে।’ শিপলার আরও লিখেছেন, ‘ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা (স্টিং) কাউকে নিশানা করে উচ্চারিত কথাবার্তা থেকে—মসজিদের বাইরে কোনো গোয়েন্দা তথ্যদাতার কাছে, ওয়েবসাইটে রাগী লেখালেখি থেকে, বিদেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে ই-মেইল চালাচালি থেকে। তারপর তাদের সঙ্গে ছল করে সম্পর্ক পাতা হয়। এসব তথ্যদাতা সাধারণত হয় কোনো দাগি আসামি, যাদেরকে এসব কাজে লাগানোর বিনিময়ে কয়েদ খাটা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে, অথবা তারা হয় আল-কায়েদা অথবা এ ধরনের কোনো গোষ্ঠীর সদস্য সাজা এফবিআই এজেন্ট।’ সাংবাদিক ও গবেষকেরা এ ধরনের বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা খতিয়ে দেখে বই লিখেছেন। অমিতাভ কুমারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, ‘কিছু একটা হতে চাওয়া’রাই বেশি এফবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে। এফবিআই তখন এসব ঘটনা দেখিয়ে ৯/১১-পরবর্তী অনিশ্চয়তার পরিবেশে নিজেদের অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জনকে জায়েজ করে। যত বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটবে বা ঘটানো হবে, তত বেশি জনগণের মধ্যে ভয়ের সংক্রমণ ঢুকবে; তত বেশি জনগণ বহু সংগ্রামে অর্জিত অধিকারগুলো স্বেচ্ছায় সরকারের কাছে সঁপে দেবে।
এসব কাহিনির ভুতুড়ে চরিত্রটি হলো সেই তথ্যদাতা, যে হয়তো মামুলি অপরাধে জড়িয়ে পড়া অথবা ছোটখাটো সমস্যায় হাবুডুবু খাওয়া অভিবাসী। বর্তমান ক্ষেত্রে যাদের বেশির ভাগই হয় মুসলিম পুরুষ। এফবিআই এদের টোপ দেয়, তোমরা তোমার এলাকার মুসলিম সমাজ নিয়ে খবরাখবর দাও, বিনিময়ে শাস্তি মওকুফ। এক বা একাধিক ব্যক্তিকে ফাঁসাতে পারলে তাদের টাকাও দেওয়া হয়। এ রকম কোনো কোনো গোয়েন্দা ফেউ এফবিআই জগতে বিখ্যাতও হয়ে ওঠে, যেমন হয়েছে পাকিস্তানি অভিবাসী শাহেদ হুসাইন। শাহেদ মিথ্যা কথা বলে দুজনকে ফাঁসানোর পরে কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করে অনুতাপ জানায়।
গত অক্টোবর মাসে বার্তা সংস্থা এপি জানায়: নিউইয়র্ক পুলিশের এক তথ্যদাতা শামিমুর রহমান বলেছে, পুলিশ মুসলমানদের টোপ দেওয়ার জন্য তাকে টাকা দিত। শামিমুরও নাফিসের মতোই বাংলাদেশি, বয়স ১৯। নেশাদ্রব্যসহ কয়েকবার সে পুলিশের হাতে আটক হয়। পুলিশের খাতা থেকে এর রেকর্ড মুছে ফেলার টোপ দিয়ে পুলিশ তাকে জন জে কলেজ ও সংলগ্ন মসজিদ এলাকায় মুসলমানদের ‘পেছনে লাগতে’ বলে। এনওয়াইপিডি ও সিআইএ মিলে তৈরি করা এ রকম সন্দেহভাজন ধরার পদ্ধতির নাম ‘পয়দা করো আর ধরো’ (ক্রিয়েট অ্যান্ড ক্যাপচার)।
শামিমুরও নাফিসের মতো বাংলাদেশি আমেরিকান। দুজনই তরুণ এবং দুজনই কলেজপড়ুয়া। একজন এনওয়াইপিডি-সিআইএর ফেউ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে, আরেকজন তাদের নিশানায় পড়েছে। ‘আমি ভুল করেছি’ ফেসবুকে বলেছে শামিমুর। নাফিসও ফেসবুকে মারাত্মক ভুলের বশে চিন্তাভাবনাহীন কথাবার্তা বলে সরকারের পাতা জালে পড়ে ‘পয়দা করা ও ধরার’ শিকার হয়েছে। তার মামলাটি চলবে এবং আগের মামলাগুলোর পরিণতি হিসাব করে বলা যায়, শিগগিরই তার গন্তব্য হবে কারাগার।
এ রকম আরেকটি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদ আস-সালামের সভাপতি, আর্টিফিশিয়াল টেররিস্ট অ্যান্ড মুসলিম এনট্র্যাপমেন্ট আফটার ৯/১১ গ্রন্থের লেখক শামসাদ আহমদ খ্রিষ্টান সংগঠন বেথলেহেম নেইবারস ফর পিস-এর জো লমবার্ডোর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে সরকারের দাপটে কোণঠাসা মুসলমান সমাজের পাশে বেথলেহেম নেইবার্সকে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন। লমবার্ডোকে আহমদ বলেন, ‘মুসলমানরা এখানে থাকছে, আমরা এই সমাজের অংশ। আমরা এই সমাজের আর সবার থেকে আলাদা কেউ নই। এফবিআই এখন আমাদের মন্দ লোক হিসেবে দেখানোর এবং সমাজের শত্রু বানানোর খেলা খেলছে। এ অবস্থায় আমরা আপনাদের মতো সাহসী মানুষের সাহায্য নিয়ে এর মোকাবিলা করতে চাই।’ মসজিদ সদস্য আর বেথলেহেম নেইবারসরা মিলে এরপর ২০০৬ সালে মুসলিম সলিডারিটি কমিটি (এমএসসি) গঠন করে। এমএসসির মতো গোষ্ঠীরা এখন এমন কিছু সামাজিক কর্মসূচিতে নিয়োজিত আছে, যার লক্ষ্য হলো বহু মার্কিনের মনে গেড়ে বসা ভয়কে সহজ আনন্দে রূপান্তর করা। এই ভয়কে পুঁজি করেই রাজনীতিবিদেরা এমন নীতি বানান, যার জোরে পুলিশ সন্ত্রাসী ‘পয়দা করে ও ধরে’। এই ভয়কে উসকে দিয়েই তারা ‘কিছু হতে চাওয়া’ তরুণদের ঘুঁটি বানিয়ে সাড়া জাগানো মামলা সাজায় আর বানায় ভয় ধরানো থমথমে কারাগার।
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
বিজয় প্রসাদ: মার্কিন অধ্যাপক এবং আরব স্প্রিং, লিবিয়ান উইন্টার গ্রন্থের রচয়িতা।
No comments