কূটনীতি-যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নীতি বদলাবে না by তারেক শামসুর রেহমান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন সামনে চলে এলো, তা হচ্ছে এই 'বিজয়' কি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না।
এর পরও হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা বলা সঙ্গত যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কিছুটা গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এবং চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে 'যে শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সেই 'শূন্যতা' পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান সরকারই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এই বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকের সম্মতি দেওয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে ভারতের তথাকথিত একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পাব আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, এই বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল, সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে 'ইউরোপের গণতন্ত্রকে' রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে 'ঝুঁকি' নিতে চাইছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এই 'প্রক্রিয়ায়' বাংলাদেশেও জড়িত হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে, বাংলাদেশ সরকার 'ভারতের এই ভূমিকাকে', যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে, সম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগি্ন-৫) সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এই কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই আর তা হচ্ছে, চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বেশ ক'টি ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সফর করার আগে হিলারি ক্লিনটন বেইজিংও সফর করেছিলেন। সেখানে চীনা নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনা সফল হয়নি। চীনের সমরসজ্জা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ-শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করছে। এটি বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি কিংবা শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে গড়ে ওঠা ÔContaintment theoryÕ-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সু চি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি 'বেসামরিক অবয়ব' দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে গেল ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও'ব্লেক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক) এবং ওয়েন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। গত ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু'দেশ আলোচনা করল, কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনেই রাখা হলো। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এটি নিয়ে বাংলাদেশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, 'তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার' জন্য(?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটি আইনি কাঠামো দেওয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এক সময় আশ্রয় দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। খালেদা জিয়ার নয়াদিলি্ল সফর ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার প্রত্যয় নিঃসন্দেহে মার্কিন নীতিনির্ধারণদেরও খুশি করবে। বাংলাদেশ-ভারত ভালো সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য। বাংলাদেশ এখন 'টিফা' চুক্তির বদলে 'টিকফা' (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তি করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। একই সঙ্গে 'আকসা' (অ্যাকুইজিশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এখন বারাক ওবামা আবার নির্বাচিত হওয়ার পর এসব নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট' থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন সৃষ্টি হলো। সব মিলিয়ে যা বলা যায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.