সমকালীন প্রসঙ্গ-আওয়ামী লীগের ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির স্বরূপ by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী। এমনকি দায়িত্বশীল ব্যক্তি, এটা আওয়ামী লীগের কিছু খাস লোক এবং অন্ধ সমর্থক ছাড়া অন্য কেউ আর বিশ্বাস করে না। কোনো বিরোধী দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির দ্বারা এই ধারণার সৃষ্টি হয়নি। শেখ হাসিনার নিজের জিহ্বা সঞ্চালনের দ্বারাই সকলের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
তার জিহ্বার যে কোনো লাগাম নেই, নিজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের যে কোনো উপলব্ধি তার নেই, এর প্রমাণ প্রায় প্রত্যেক দিনই তিনি নিজের বাক্য বিস্তারের দ্বারা দিয়ে থাকেন। এ ধরনের কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী অন্য কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। প্রত্যেক মানুষের জিহ্বা তার সংস্কৃতির দ্বারাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এটা কোনো ব্যতিক্রম নয়।
সাধারণভাবে বাংলাদেশে এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, আওয়ামী লীগ একটি ধর্মবিযুক্ত (secular) দল এবং আওয়ামী লীগাররা ধর্মবিযুক্ত ব্যক্তি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আওয়ামী লীগ তার বিভিন্ন নীতি ও কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে এই ধারণার অসারত্ব বারবার প্রমাণ করে এলেও আওয়ামী লীগ একটি ধর্মবিযুক্ত দল হিসেবেই কথিত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক মহলের লোকজন ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির দৈন্য ও যুক্তি বিচারের অক্ষমতার একটা পরিচয় এর মধ্যে পাওয়া যায়। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের এসব লোকের উচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যে ধারণা প্রচলিত আছে তার কোনোই ভিত্তি নেই।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সময় এর নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীকালে এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সংকটাপন্ন ও তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে দলটির নাম থেকে বাস্তব কারণেই মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে একে ধর্মবিযুক্ত (secular) করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর নেতাকর্মীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার রেশ থেকেই যায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সর্দার বল্লভ ভাই পেটেল, পুরুষোত্তম দাস টেন্ডন, আচার্য কৃপালিনীর মতো হিন্দু মহাসভাপন্থি লোকের যেমন অভাব ছিল না, তেমনি আওয়ামী লীগের উচ্চতম থেকে নিম্নতর পর্যায়ের লোকদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক লোকের অভাব ছিল না এবং এখনও নেই। সাম্প্রদায়িকতার এই অবশেষ যদি তাদের মধ্যে না থাকত তাহলে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক, এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদী নীতি যেভাবে অনেক সময় খোলাখুলি ঘোষণা ও কার্যকর করে এসেছে সেভাবে এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
অন্য কথা বাদ দিয়েও এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হলো ইসলাম! আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এই আইন সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সময় করা হয়েছিল। ঠিক, খুব ঠিক। কিন্তু তারা যে কাজ করেছিল সেটা যদি আপত্তিজনক হয় তাহলে তা বহাল রাখা হচ্ছে কী কারণে? বিশেষত যদি আমরা বিবেচনায় রাখি যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ জোট সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি, তাহলে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট হবে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাদের জোট সরকারে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, তাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট ইত্যাদি নামে পরিচয়দানকারী দলগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম আইন বাতিল না করে তাকে বহাল রেখেছে। সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা বাংলাদেশের রাজনীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এর থেকে তার বড় পরিচয় আর কোথায় আছে? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযোজন করেছিলেন। এর সমালোচনায় আওয়ামী লীগ খুব সোচ্চার ছিল এবং ধর্মবিযুক্ততা গেল গেল আওয়াজ তুলে বাজিমাত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সংযোজিত সেই বিসমিল্লাহ আজও সংবিধানে একইভাবে আছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য আরও এ কারণে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে। এ সংশোধনী পাস করে তারা নাকি বাংলাদেশের সংবিধানকে তার বিশুদ্ধরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সংবিধানের মুখবন্ধে বিসমিল্লাহ বহাল রেখে কীভাবে তারা এ দাবি করতে পারে ভাবলে শুধু অবাক নয়, হতবুদ্ধি হতে হয়! তাদের জোটের অন্তর্ভুক্ত তথাকথিত সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট প্রভৃতির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কতখানি ন্যক্কারজনক সেটাও এর থেকে বোঝা যায়।
সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হিসেবে এখানকার শাসকশ্রেণীর দলগুলোকে বিশেষত সরকারি দল আওয়ামী লীগকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন! এটা এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। আমাদের বর্তমান আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই পরামর্শের প্রতিবাদে সংসদের ভেতরে-বাইরে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ত্রুক্রদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় দলের সঙ্গে তাদের মতো অসাম্প্রদায়িক দলকে আলোচনায় বসতে বলা এক অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব। বেশ, এটা তো বোঝা গেল। কিন্তু এহেন ধর্মীয় দলের সঙ্গে ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনের পর বৈঠকে বসে সমঝোতার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারা ক্ষমতায় বসেছিলেন কীভাবে? জামায়াতে ইসলামী খুব খারাপ ধর্মীয় জঙ্গিবাদী দল, এই হিসাব তখন তাদের কোথায় ছিল? মতলবি কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং আখের গোছানের ব্যবস্থা করলে তাতে বুঝি কোনো দোষ নেই? এ তো গেল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপার। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সামনে রেখে খেলাফত মজলিসের মতো একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় দলের সঙ্গে শুধু আলোচনায় বসা নয়, একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল! সেই চুক্তি অনুযায়ী নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারা বাংলাদেশে 'ব্লাসফেমি আইন' পর্যন্ত জারি করতে অর্থাৎ ইসলামবিরোধী কোনো কথা কেউ বললে তাকে চরম দণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল! এই দুষ্টু চুক্তির সঙ্গে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির কী সম্পর্ক? এর মধ্যে কি দেশের সর্বপ্রধান ও সব থেকে পুরনো রাজনৈতিক দলটির ক্রিমিনাল সুবিধাবাদিতার পরিচয় নেই?
আওয়ামী লীগের এ ধরনের 'ধর্মবিযুক্ত' নীতির আরও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য তার প্রয়োজন নেই। এ মুহূর্তে এখানে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই আমাদের এখনকার আলোচনার বিষয়। এ আলোচনায় আসার জন্য এতক্ষণ আওয়ামী লীগের 'ধর্মবিযুক্ত রাজনীতি'র ইতিহাস থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো। মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ জোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গি ও ভাষায় হুমকি দিয়ে বলেছেন যে, পুলিশের ওপর জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের লোকদের আক্রমণের বিচার তিনি শরিয়া আইন অনুযায়ী করবেন! এ কথার অর্থ কী? প্রথমত যে আইনে তিনি এভাবে বিচার করবেন বলেছেন সে আইন কি এ দেশে বলবৎ আছে, না বলবৎ আছে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড মেকলের তৈরি আইন? যদি দেশে সে রকম কোনো আইন না থাকে তাহলে সে আইনে বিচার করার হুমকি প্রদান কি মানসিকভাবে সুস্থ লোকের পক্ষে সম্ভব? এ কথা কেউ বললে তার যে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন এটা কোনো বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক কি অস্বীকার করতে পারেন? কেউ কি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন যে, এ ধরনের কোনো অসুস্থ লোকের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করা সম্ভব নয়? দেশ আজ সবদিক দিয়ে যেভাবে নৈরাজ্যে ছেয়ে গেছে তার সঙ্গে যে এই ধরনের নেতৃত্ব সম্পর্কবিহীন এটাও কি কেউ মনে করতে পারেন?
এবার আসা যেতে পারে শেখ হাসিনার হুমকির অন্য দিকটিতে। দেশে শরিয়া আইন না থাকলেও তার কথা মেনে বোঝা যায় যে, তার চিন্তায় শরিয়া আইনের গ্রাহ্যতা (Validity) আছে এবং বর্তমানে প্রচলিত আইনের থেকে সে আইনটি তার হিসেবে অধিকতর কার্যকর, আরও উত্তম! যেভাবে তারা সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' আইন বহাল রেখেছেন তার থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বর্তমান জোট সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী সম্ভব হলে দেশে শরিয়া আইন প্রবর্তন করেও নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী! কিন্তু এটা করার জন্য সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও দেশের মধ্যে এর বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এটা বাস্তবত তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব হলে তারা শুধু জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিচারই নয়, সকল প্রকার শাসন কাজ পরিচালনার জন্যই শরিয়া আইন প্রবর্তন করে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতিকে বিদায় করে ডুগডুগি বাজাতেন। এসবকে কথার কথা মনে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন বলেন যে, তিনি জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিচার শরিয়া আইনে করবেন তখন একে পশ্চাৎপদ গ্রাম্য সংস্কৃতির অভিব্যক্তি বলে বসে থাকার উপায় নেই। দেশে অন্য আইন ব্যবস্থা বহাল রেখে বিভিন্নভাবে শুধু জামায়াত-শিবিরের বিচার তো সম্ভব নয়। যে কোনো দেশেরই আইন ব্যবস্থা অবিভাজ্য।
যে দেশের ২৪ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পর দেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এ আলোচনা করতে হয়, সে দেশের মতো হতভাগ্য দেশ দুনিয়ার আর কোথায় আছে?
১৯.১১.২০১২
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
সাধারণভাবে বাংলাদেশে এ ধারণা প্রচলিত আছে যে, আওয়ামী লীগ একটি ধর্মবিযুক্ত (secular) দল এবং আওয়ামী লীগাররা ধর্মবিযুক্ত ব্যক্তি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আওয়ামী লীগ তার বিভিন্ন নীতি ও কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে এই ধারণার অসারত্ব বারবার প্রমাণ করে এলেও আওয়ামী লীগ একটি ধর্মবিযুক্ত দল হিসেবেই কথিত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক মহলের লোকজন ও বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির দৈন্য ও যুক্তি বিচারের অক্ষমতার একটা পরিচয় এর মধ্যে পাওয়া যায়। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের এসব লোকের উচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যে ধারণা প্রচলিত আছে তার কোনোই ভিত্তি নেই।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সময় এর নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীকালে এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সংকটাপন্ন ও তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে দলটির নাম থেকে বাস্তব কারণেই মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে একে ধর্মবিযুক্ত (secular) করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর নেতাকর্মীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার রেশ থেকেই যায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সর্দার বল্লভ ভাই পেটেল, পুরুষোত্তম দাস টেন্ডন, আচার্য কৃপালিনীর মতো হিন্দু মহাসভাপন্থি লোকের যেমন অভাব ছিল না, তেমনি আওয়ামী লীগের উচ্চতম থেকে নিম্নতর পর্যায়ের লোকদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক লোকের অভাব ছিল না এবং এখনও নেই। সাম্প্রদায়িকতার এই অবশেষ যদি তাদের মধ্যে না থাকত তাহলে আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক, এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদী নীতি যেভাবে অনেক সময় খোলাখুলি ঘোষণা ও কার্যকর করে এসেছে সেভাবে এটা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
অন্য কথা বাদ দিয়েও এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হলো ইসলাম! আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এই আইন সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সময় করা হয়েছিল। ঠিক, খুব ঠিক। কিন্তু তারা যে কাজ করেছিল সেটা যদি আপত্তিজনক হয় তাহলে তা বহাল রাখা হচ্ছে কী কারণে? বিশেষত যদি আমরা বিবেচনায় রাখি যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ জোট সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি, তাহলে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট হবে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাদের জোট সরকারে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, তাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট ইত্যাদি নামে পরিচয়দানকারী দলগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম আইন বাতিল না করে তাকে বহাল রেখেছে। সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা বাংলাদেশের রাজনীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এর থেকে তার বড় পরিচয় আর কোথায় আছে? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযোজন করেছিলেন। এর সমালোচনায় আওয়ামী লীগ খুব সোচ্চার ছিল এবং ধর্মবিযুক্ততা গেল গেল আওয়াজ তুলে বাজিমাত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সংযোজিত সেই বিসমিল্লাহ আজও সংবিধানে একইভাবে আছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য আরও এ কারণে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে। এ সংশোধনী পাস করে তারা নাকি বাংলাদেশের সংবিধানকে তার বিশুদ্ধরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সংবিধানের মুখবন্ধে বিসমিল্লাহ বহাল রেখে কীভাবে তারা এ দাবি করতে পারে ভাবলে শুধু অবাক নয়, হতবুদ্ধি হতে হয়! তাদের জোটের অন্তর্ভুক্ত তথাকথিত সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট প্রভৃতির ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে কতখানি ন্যক্কারজনক সেটাও এর থেকে বোঝা যায়।
সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হিসেবে এখানকার শাসকশ্রেণীর দলগুলোকে বিশেষত সরকারি দল আওয়ামী লীগকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন! এটা এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। আমাদের বর্তমান আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই পরামর্শের প্রতিবাদে সংসদের ভেতরে-বাইরে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ত্রুক্রদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় দলের সঙ্গে তাদের মতো অসাম্প্রদায়িক দলকে আলোচনায় বসতে বলা এক অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব। বেশ, এটা তো বোঝা গেল। কিন্তু এহেন ধর্মীয় দলের সঙ্গে ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনের পর বৈঠকে বসে সমঝোতার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারা ক্ষমতায় বসেছিলেন কীভাবে? জামায়াতে ইসলামী খুব খারাপ ধর্মীয় জঙ্গিবাদী দল, এই হিসাব তখন তাদের কোথায় ছিল? মতলবি কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং আখের গোছানের ব্যবস্থা করলে তাতে বুঝি কোনো দোষ নেই? এ তো গেল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপার। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সামনে রেখে খেলাফত মজলিসের মতো একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় দলের সঙ্গে শুধু আলোচনায় বসা নয়, একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল! সেই চুক্তি অনুযায়ী নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারা বাংলাদেশে 'ব্লাসফেমি আইন' পর্যন্ত জারি করতে অর্থাৎ ইসলামবিরোধী কোনো কথা কেউ বললে তাকে চরম দণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল! এই দুষ্টু চুক্তির সঙ্গে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির কী সম্পর্ক? এর মধ্যে কি দেশের সর্বপ্রধান ও সব থেকে পুরনো রাজনৈতিক দলটির ক্রিমিনাল সুবিধাবাদিতার পরিচয় নেই?
আওয়ামী লীগের এ ধরনের 'ধর্মবিযুক্ত' নীতির আরও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য তার প্রয়োজন নেই। এ মুহূর্তে এখানে যা দেখা যাচ্ছে সেটাই আমাদের এখনকার আলোচনার বিষয়। এ আলোচনায় আসার জন্য এতক্ষণ আওয়ামী লীগের 'ধর্মবিযুক্ত রাজনীতি'র ইতিহাস থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো। মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ জোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গি ও ভাষায় হুমকি দিয়ে বলেছেন যে, পুলিশের ওপর জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের লোকদের আক্রমণের বিচার তিনি শরিয়া আইন অনুযায়ী করবেন! এ কথার অর্থ কী? প্রথমত যে আইনে তিনি এভাবে বিচার করবেন বলেছেন সে আইন কি এ দেশে বলবৎ আছে, না বলবৎ আছে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড মেকলের তৈরি আইন? যদি দেশে সে রকম কোনো আইন না থাকে তাহলে সে আইনে বিচার করার হুমকি প্রদান কি মানসিকভাবে সুস্থ লোকের পক্ষে সম্ভব? এ কথা কেউ বললে তার যে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন এটা কোনো বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক কি অস্বীকার করতে পারেন? কেউ কি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন যে, এ ধরনের কোনো অসুস্থ লোকের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করা সম্ভব নয়? দেশ আজ সবদিক দিয়ে যেভাবে নৈরাজ্যে ছেয়ে গেছে তার সঙ্গে যে এই ধরনের নেতৃত্ব সম্পর্কবিহীন এটাও কি কেউ মনে করতে পারেন?
এবার আসা যেতে পারে শেখ হাসিনার হুমকির অন্য দিকটিতে। দেশে শরিয়া আইন না থাকলেও তার কথা মেনে বোঝা যায় যে, তার চিন্তায় শরিয়া আইনের গ্রাহ্যতা (Validity) আছে এবং বর্তমানে প্রচলিত আইনের থেকে সে আইনটি তার হিসেবে অধিকতর কার্যকর, আরও উত্তম! যেভাবে তারা সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' আইন বহাল রেখেছেন তার থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বর্তমান জোট সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী সম্ভব হলে দেশে শরিয়া আইন প্রবর্তন করেও নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী! কিন্তু এটা করার জন্য সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও দেশের মধ্যে এর বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এটা বাস্তবত তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব হলে তারা শুধু জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিচারই নয়, সকল প্রকার শাসন কাজ পরিচালনার জন্যই শরিয়া আইন প্রবর্তন করে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতিকে বিদায় করে ডুগডুগি বাজাতেন। এসবকে কথার কথা মনে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন বলেন যে, তিনি জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিচার শরিয়া আইনে করবেন তখন একে পশ্চাৎপদ গ্রাম্য সংস্কৃতির অভিব্যক্তি বলে বসে থাকার উপায় নেই। দেশে অন্য আইন ব্যবস্থা বহাল রেখে বিভিন্নভাবে শুধু জামায়াত-শিবিরের বিচার তো সম্ভব নয়। যে কোনো দেশেরই আইন ব্যবস্থা অবিভাজ্য।
যে দেশের ২৪ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পর দেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে এ আলোচনা করতে হয়, সে দেশের মতো হতভাগ্য দেশ দুনিয়ার আর কোথায় আছে?
১৯.১১.২০১২
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
No comments