হাজারীবাগ অগ্নিকাণ্ড-বাবুলের 'স্লিপ' ছাড়া ত্রাণ মিলছে না by রেজোয়ান বিশ্বাস
আগুনে ছারখার বৌবাজার বস্তির বাসিন্দারা এখন খোলা আকাশের নিচে। পোড়া বাঁশ-খুঁটি কুড়িয়ে নিয়ে আবার মাথার ওপর কোনো রকম একটা আশ্রয় বানিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে ব্যস্ত তারা। এত বড় বিপর্যয় সামাল দিতে একদিকে বস্তিবাসী হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি বরাদ্দ যথারীতি নয়ছয় করাও থেমে নেই।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ টাকা, চাল, কম্বল ও কাপড় বিতরণে। অসহায় মানুষগুলো শিকার হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের 'স্লিপ' রাজনীতির। ত্রাণ না পেয়ে গতকাল সকালে বৌবাজার বস্তিতে বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটেছে। সরেজমিনে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে।গত রবিবার ভোরে আকস্মিক আগুনে বৌবাজার বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেখানে এখন প্রায় ৬০০ পরিবার খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। ঘটনার পরপরই ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য বাবদ সরকারিভাবে এক কোটি টাকা, ৯০ টন চালসহ কম্বল, শাড়ি, লুঙ্গি ও খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনপ্রতি বরাদ্দ পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে কিছু লোক তিন হাজার টাকা ও খাবার পেয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ এখনো ত্রাণের অপেক্ষায়।
হাজারীবাগ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান বাবুলের স্বাক্ষর করা স্লিপ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের অভিযোগ, তাদের নামে বরাদ্দ নগদ টাকাসহ ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ করা হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক মানুষ ত্রাণ না পেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) হারুন ইউসুফ বলেন, বৌবাজার বস্তির আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৯০১ জনের তালিকা করা হয়েছে। কেবল তালিকাভুক্তদের সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হবে। বরাদ্দ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের পাঁচ হাজার টাকা, ৩০ কেজি চাল, কম্বল, শাড়ি ও লুঙ্গি দেওয়া হবে। এর বাইরে কোনো ত্রাণসামগ্রী আপাতত দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে সরকারি সাহায্য বিতরণ করা হয়েছে।
হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান বাবুলের স্বাক্ষর ও সিলসহ স্লিপ অনুযায়ী সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটা সম্পূর্ণ নিয়ম-বহির্ভূত। নিয়ম অনুযায়ী ওই স্লিপে ডিসি অফিসের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট অফিসারের (পিআইও) সিল ও স্বাক্ষর থাকবে। তাঁর স্লিপ ছাড়া কাউকে ত্রাণ দেওয়ার নিয়ম নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে আনিসুর রহমান বাবুল কালের কণ্ঠকে জানান, জেলা প্রশাসকের লোকজনকে সহযোগিতা করতে তাঁরা ত্রাণ বিতরণে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, আগুনে প্রায় তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। যেসব বাড়িঘর পুড়ে গেছে সেগুলোর মালিক ও ম্যানেজারের তথ্য অনুযায়ী তালিকা করে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এক কোটি টাকা ও ৯০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে স্লিপের মাধ্যমে নগদ টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশির ভাগই ত্রাণ পায়নি। অনেকে শুধু স্লিপ পেয়েছে। তাদের কাছে বাবুলের স্বাক্ষর করা স্লিপ দেখা গেছে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ফাতেমা জানান, সোমবার তিনি চার কেজি চাল পেয়েছেন। অথচ তাঁকে বলা হয়েছে, ৩০ কেজি চাল দেওয়া হবে। এভাবে রিনা, জেসমিন ও কালামসহ অর্ধশতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা স্লিপ পেলেও চাল পেয়েছেন চার কেজি। টাকা পেয়েছেন তিন হাজার। এর বাইরে তাঁরা কোনো সাহায্য পাননি বলে জানান।
গতকাল সকাল ১১টায় পঙ্গু অটোরিকশাচালক দুলাল মিয়াকে ঘটনাস্থলে কাঁদতে দেখা যায়। আগুনে তাঁর আয়ের একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটি পুড়ে গেছে। ঋণের টাকায় কেনা এ অটোরিকশা দিয়ে যে আয় হতো, তা দিয়ে পরিবারের পাঁচ সদস্যের জীবন চলত। দুলাল মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হুনছি সরকার থাইকা আমাগো জন্য অনেক ট্যাহা-পয়সা, খাবার দেয়া অইছে। কিন্তু আমি এহন পর্যন্ত কিছুই পাইনি। আমার কী অপরাধ?' তাঁর মতো আরো অনেকে একই অভিযোগ করে।'
একটু দূরে পোড়া রিকশা গ্যারেজের পাশে বসে কাঁদছিলেন গ্যারেজ মালিক শাহজাহান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগুনে তাঁর ৮৬টি রিকশা পুড়ে গেছে। যাঁরা তাঁর রিকশা চালাতেন তাঁরাও এখন বেকার। গত দুই দিন ধরে তাঁরা খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছেন। এখন পর্যন্ত তাঁদের কোনো সরকারি স্লিপ দেওয়া হয়নি।
সুমনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
বৌবাজার বস্তিতে আগুনের ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একটি স্পেশাল ওয়ার্ড খোলা হয়। সেখানে ভর্তি হয়েছেন নূরুল ইসলাম (৩০) ও সুমন (৩০)। তৃতীয় তলার শিশু ওয়ার্ডে রয়েছে চার মাসের জুঁই। তাদের মধ্যে সুমনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তাঁকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত রবিবার ভোরে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার বৌবাজার বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়।
No comments