স্মরণ- শতাব্দীর সূর্য by কাজী মদিনা
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে এমন একজন বিশাল মাপের ব্যক্তিত্বের অবয়ব ভেসে ওঠে, যিনি ছিলেন শতাব্দীর সূর্য। দীর্ঘদিন ধরে যিনি প্রতিনিয়ত বাঙালি মুসলমান সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার দূর করতে আলো ছড়িয়েছেন। আর সেই আলোয় আলোকিত হয়েছেন আজকের প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য শিক্ষিত, রুচিবান ও সংস্কৃতিমান বাঙালি মুসলমান।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ২০ নভেম্বর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন চাঁদপুরের পাইকারদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়ে মুসলিম সমাজ বাংলার নবজাগরণে একাত্ম হতে পারেনি বলে একদিকে যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল, অন্যদিকে ছিল পশ্চাৎপদতা। অজ্ঞানতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিল তারা। নাসিরউদ্দীন স্কুলজীবনেই মুসলিম সমাজের এই জগদ্দল অচলায়তন ভাঙার অঙ্গীকার করেন। পরবর্তী সময়ে পরম বিস্ময়ে সবাই দেখল, এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কী অসাধারণ কাজ করেছেন নাসিরউদ্দীন।নাসিরউদ্দীন আবদুর রহমান ও আমেনা বিবির জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবা তাঁর সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য নিজ গ্রাম থেকে অনতিদূরে হরিণা গ্রামে ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। নাসিরউদ্দীনের বয়স যখন মাত্র আঠারো বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবার অবর্তমানে সংসারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয় নাসিরউদ্দীনকে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তখন তিনি স্বল্প বেতনে স্টিমার কোম্পানিতে স্টেশন মাস্টারের সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের এজেন্টের কাজ নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করেন। কিছুটা পুঁজি হলে চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর তিনি তাঁর লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের প্রয়াস নেন। প্রকাশ করেন মাসিক সওগাত। সময় ১৯১৮ সাল।
সওগাত প্রকাশনা ছিল বাঙালি মুসলমানের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের উৎস। মুসলিম বাংলার সাহিত্য, সমাজ সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য সওগাত প্রকাশনার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধ থেকেই নাসিরউদ্দীন সওগাত-এর মাধ্যমে সমাজ চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চেতনা, প্রগতিশীল চেতনা এবং বাঙালি মুসলমানের মননচিন্তা, মেধা জাগ্রত ও বিকাশ করতে এবং প্রসার ঘটাতে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাঁরই প্রেরণায় ও উৎসাহে মুসলিম সমাজের অগণিত লেখক ও সংস্কৃতিসেবী নিজ প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছেন। সওগাত পত্রিকার প্রথম সংখ্যাই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সংখ্যায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মানকুমারী বসু, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের লেখা ছাপা হয়। নজরুলের সৃষ্টিকর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় সওগাত-এর ভূমিকা ছিল অনন্য। সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করে নাসিরউদ্দীন মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার দ্বার খুলে দেন। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও রক্ষণশীলদের আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন এবং সওগাতকে জাতীয় দর্পণরূপে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন। আজকের লব্ধপ্রতিষ্ঠ বেশির ভাগ মুসলিম সাহিত্যিক সাংবাদিক সওগাত পত্রিকাকে অবলম্বন করে তদানীন্তন সুধীসমাজে পরিচিতি লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সওগাত পত্রিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। নাসিরউদ্দীন শিশুদের সাহিত্যে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে শিশুদের উপযোগী আকর্ষণীয় চিত্রশোভিত শিশু সওগাত প্রকাশ করেন। তাঁর এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা শিশুসাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করে। একই সঙ্গে নারীদের প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্য অঙ্গনে আনার জন্য তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১৩৬৬ (বাংলা) সনে ভাদ্র মাস সংখ্যাটি শুধু মহিলাদের লেখা ও তাঁদের চিত্রসহ সচিত্র মহিলা সওগাত প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করে। সেই সময় অবরোধবাসিনী মুসলিম নারীদের পত্রিকায় লেখা ছাপানো ছিল অপরাধ। নাসিরউদ্দীন সেই অর্গল ভেঙে মহিলাদের ছবিসহ লেখা ছাপিয়ে বাঙালি মুসলিম সমাজের নারীদের উন্নততর স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। নাসিরউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য অবদান হলো সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা ১৯৪৭ সালে জুলাই মাসে কলকাতায় প্রকাশ। ১৯৫০ সালে সওগাত ও বেগম পত্রিকা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। পর্দার অচলায়তন ভেঙে মুসলিম নারীরা বেগম পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। আজকের লব্ধপ্রতিষ্ঠ বেশির ভাগ মুসলিম নারী বেগম পত্রিকায় আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। নাসিরউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা নূরজাহান বেগম আজও পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন। বেগম প্রায় ৬৫ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বিশ্বাস করতেন, নারীকে শতবর্ষের কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। এই সচেতনতা নারীদের মাঝে সঞ্চারিত করার জন্য এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবে দেশের বরেণ্য নারীদের সংবর্ধনা দেওয়া হতো। প্রগতিশীল নাসিরউদ্দীন আজীবন মুসলিম নারীর স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও নারীমুক্তির জন্য একজন প্রত্যয়ী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ অগণিত নারীর সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে নারিসউদ্দীনের অবদান চিরস্মরণীয়।
১৯৯৪ সালের ২১ মে তিনি ঢাকায় মারা যান।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ১০৬ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে কখনো বিশ্রাম নেননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সভা-সমিতিতে উপস্থিত থেকেছেন। সভায় কখনো দেরিতে উপস্থিত হননি। অনেক সময় দেখা গেছে, তিনিই প্রথম ব্যক্তি সভাতে উপস্থিত হয়েছেন। এই মহান ব্যক্তির আজ ২০ নভেম্বর জন্মদিন। জন্মদিনে শতাব্দীর সূর্য এই মৃত্যুঞ্জয়ীকে অভিবাদন।
কাজী মদিনা
No comments