কল্পকথার গল্প-নরম খবর গরম খবর চোখ বোলাতেই বাসি by আলী হাবিব
পুরাণে ত্রিশঙ্কু নামে এক রাজার কথা আছে। বশিষ্ঠের শতপুত্রের অভিশাপে চণ্ডাল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বামিত্রের তপস্যায় সশরীরে স্বর্গে আরোহণ করছিলেন তিনি। কিন্তু দেবতারা তাঁকে সেখানে থাকতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ ত্রিশঙ্কু গুরুশাপে অভিশপ্ত।
তাঁকে অধোমুখে মর্ত্যে নেমে আসতে বলা হলো। নামতে শুরু করলেন ত্রিশঙ্কু। বিশ্বামিত্র বলে উঠলেন, তিষ্ঠ। সেখানেই থেমে গেলেন তিনি। সেই থেকে ঝুলে আছেন আকাশে।প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে। আবার জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে। কিছু কিছু খবর আছে, যেগুলো কখনো মুছে যায় না। আবার এমন অনেক খবর আছে, যেগুলো পত্রিকার পাতায় জায়গা পায় না। খবরের পেছনে খবর থাকে। কত খবর কতজনের মনে কত রকমের ছবি আঁকে, সে খবরও আমরা রাখি না। কিছু কিছু খবর আছে, পাঠককে সহজেই আকর্ষণ করে। সব খবরে কি পাঠকের মন ভরে? কিন্তু খবর তো খবরই। কিছু কিছু খবর আছে, যেগুলো কেবলই রটনা। আবার প্রতিদিন ঘটে যায় এমন অনেক ঘটনা, যেগুলো পাঠকের মনে দাগ কাটে। অনেক দিন থাকে তার ছাপ। যেমন ছাপ থাকে মানুষের কাজের। কিছুদিন এমন কিছু খবরে আমাদের চোখ আটকে যায়। যথেষ্ট কারণও আছে তার। মানুষের শুধু নয়, সব প্রাণীরই এমন কিছু চরিত্র আছে, যে চরিত্রের জন্য সে প্রাণিকুলে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশেই শুধু নয়, সব দেশেই মানুষকে চিহ্নিত করা কিছু বিশেষ পদ্ধতি আছে। কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 'সার্জেন্ট যবে আর্জেন্ট মার হাতে করে করে আসে তাড়ায়ে।' এই সার্জেন্ট শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখে একটি বিশেষ পোশাক পরা বাহিনীর ছবি ভেসে ওঠে। বাহিনীটি হচ্ছে পুলিশ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পুলিশ এখানে ছিল, আছে, থাকবে। পুলিশের বিকল্প নেই। পুলিশ চরিত্রটি ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসপটে একটি চিত্র ভেসে ওঠে। এমনিতেই কথায় আছে, 'বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ'। ভাবটা এমন, যেন পুলিশ বাঘের চেয়েও ভয়ংকর কোনো প্রাণী। তো, এই পুলিশের যে চিত্রটা আমাদের চোখের সামনে সচরাচর ভেসে ওঠে তা সুখকর নয়। পুলিশ পেটাচ্ছে, অকারণে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গাড়ি উঠে যাচ্ছে, এমন ছবি আমাদের মনে আঁকা আছে অনেক দিন ধরেই। সেই পুলিশকে যখন অসহায়ের মতো মার খেতে দেখি, তখন অবাকই তো হতে হয়। গত কয়েক দিন সেই চিত্র দেখলাম আমরা। খবরের কাগজে যেটা স্থিরচিত্র, টেলিভিশনে সেটাই জীবন্ত। 'বিনামেঘে বজ্রপাত' বলে একটা কথা চালু আছে। সে রকমই বিনা উস্কানিতে পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে পুলিশকে বেধড়ক পিটিয়ে চলে যাওয়ার খবর পড়েছি আমরা। এসব খবর দেখে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, 'কেমন করে এমন হলো'?
প্রশ্ন মনে আসাটাই তো স্বাভাবিক। কারণ উল্টো ছবি যে। বাংলাদেশে গত চার দশকে যে পুলিশ 'ঠোলা' হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের 'পেটোয়া বাহিনী' হয়ে বিরোধীদের পিটিয়েছে, সেই পুলিশ রাস্তায় মার খাচ্ছে_এটা কেমন কথা! পাবলিক এত দিন পুলিশকে মারতে দেখে, তাড়া করতে দেখে অভ্যস্ত। সেই মারমুখী পুলিশ আজ মারের ভয়ে কি সিঁটিয়ে আছে? মারছে কারা? খবর মিলতে সময় লাগে না। জানা গেল, সারা দেশে যারা পুলিশকে পিটিয়েছে, পুুলিশের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে গেছে, তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, এমন কাউকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? এককথায় এর জবাব, যাবে। আজকের শিশুটিও জানে, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। একাত্তরে যখন দেশের মানুষ লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য, তখন সেই রাজনৈতিক দলটি দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে হত্যা করে এ দেশের মানুষ। হত্যা করে বুদ্ধিজীবীদের। মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। নির্যাতনের শিকার হতে হয় অনেক মা-বোনকে। এখন সেই দলের পক্ষ থেকে বলা হতে পারে, সেটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সে সিদ্ধান্ত ভুল হলে তার খেসারত তো দলের অনুসারীদেরই দিতে হয়।
এমন কিছু বিষয় আছে, যা কোনো দিন মুছে ফেলা যায় না। যেমন_একাত্তর। যত দিন বাঙালি ও বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন মুছে ফেলা যাবে না একাত্তর। কারণ একাত্তর আমাদের পরিচয়। একাত্তরে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়। সেই বিজয়ের দিন সামনে। বিজয়ের সেই দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই কিছু কিছু মানুষের চেহারায় চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠছে। চার দশক ধরে এই চিত্রটা আমরা দেখে আসছি। মার্চ এলে, ডিসেম্বর এলে কিছু মানুষের মুখ থেকে হাসি উবে যায়। ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। এই ডিসেম্বরেই কারো কারো জন্য লেখা হয়েছিল সর্বনাশ। একাত্তরে 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে।' স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে আসার পরও অনেক পরিবারের কান্না ফুরোয়নি। মুছে ফেলা যায়নি অনেকের অশ্রু।
একাত্তর নিয়ে অনেক গল্প আছে। বাঙালির বীরত্বের প্রকাশ একাত্তর। আবার এ দেশেরই কিছু মানুষ লোভের বশবর্তী হয়ে কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, সে ইতিহাস নিয়েই তো একাত্তর।
তো, সেই একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছিল, এটা তো আর মিথ্যে নয়। যুদ্ধ হলে যুদ্ধাপরাধ ঘটা স্বাভাবিক। ঘটেছিল একাত্তরে। সেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুও হয়েছিল সদ্য স্বাধীন দেশে। কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সেটা থেমে যায়। একাত্তরের ঘাতকচক্র ভোল পাল্টে রাষ্ট্রক্ষমতায় পর্যন্ত চলে আসে। সে ইতিহাসও লেখা আছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে দেশে। অনেক কিছু বদলে ফেলা হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি বিকৃত হয়েছে কিছু মানুষের মন ও মানসিকতা। কিন্তু মানুষ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবি থেকে সরে আসেনি। সেই বিচার এখন আবার চলছে।
এ অবস্থায় ডিসেম্বর যতই এগিয়ে আসছে, ততই একাত্তরের ঘাতকদের দলটি গুটিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। এবার তারা শেষ কামড় দিতে চাইছে বোধ হয়। সে জন্যই আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে। পুলিশের ওপর আক্রমণ করছে তারা। যেকোনো উপায়ে বিচার বন্ধ করতে চায়। ওদিকে দলের একটি অংশ নাকি একাত্তরের ঘাতকদের দায় নিতে চায় না। যেমন দায় নিতে চাইছে না দলটির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। ফলে দলটির অবস্থা এখন ত্রিশঙ্কুর মতোই। দলের শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাবন্দি। বিচার চলছে। দলের রাজনৈতিক মিত্র এখন তাদের কোনো দায় নিতে চায় না। এমনকি নৈতিক বিবেচনা থেকেই বোধ হয় রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকেও দূরে রাখার কৌশল বেছে নিয়েছে। জনগণের কাছে নেই গ্রহণযোগ্যতা। স্বাভাবিকভাবেই ঝুলে আছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী রাজনীতিকদের দলটি। তবে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকার সম্ভাবনা এবার ক্ষীণ। ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। হয়তো সে কারণেই আবার খবরের শিরোনাম হতে চাইছে দলটি। কিন্তু সে খবর বাসি হতে তো সময় নেবে না।
বাংলাদেশের এক নন্দিত ছড়াকার লিখেছেন, 'খুনের গুণে পুরস্কৃত সেবার দায়ে ফাঁসি/ সকাল বেলার গরম খবর চোখ বোলাতেই বাসি।' হ্যাঁ, সে এক অন্ধকার সময় এসেছিল বাংলাদেশে, যখন খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার অমর নায়ক ও সংগঠকদের। আজ কিন্তু 'সে দিন হয়েছে বাসি...।' 'আজ জেগেছে সেই জনতা', যে জনতা দেখতে চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কার্যকর হয়েছে বিচারের রায়। না, কোনোভাবেই এই বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments