নতুন 'যুদ্ধে' পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী
প্রকাশ্য 'যুদ্ধে' জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী। তবে এ যুদ্ধ দেশের ভেতর-বাইরে সক্রিয় সশস্ত্র বিদ্রোহী বা আদর্শগতভাবে চরমপন্থী কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়। বরং আরেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগের সঙ্গে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে এমনটাই মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, সামরিক বাহিনী তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষমতার চর্চায় অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দেবে কি না তা-ই এখন দেখার বিষয়।পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বহুদিনের। বর্তমান পরিস্থিতে স্পষ্ট যে বাহিনীটির প্রধান শত্রু এখন প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানানোর পর দুই প্রতিষ্ঠান মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
অনেকের মতে, সেনাবাহিনী-বিচার বিভাগ দ্বন্দ্বের শুরু ২০০৭ সালে। সেই সময় সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের সরকারের বিরুদ্ধে এক দুর্নীতির মামলা চালু করার পর মার্চে ইফতেখারকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। আইনজীবীদের প্রতিবাদ ও সংবাদমাধ্যমের সমালোচনার ফলে ইফতেখার ২০০৯ সালে স্বপদে পুনর্বহাল হন। এসেই তিনি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতির পেছনে লাগেন।
ইফতেখার সাবেক সেনাপ্রধান মির্জা আসলাম বেগ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসাদ দুররানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের নির্দেশ দেন। অভিযোগ, তাঁরা ১৯৯০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এ কাজে তাঁরা আইএসআইয়ের মাধ্যমে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেন রাজনীতিকদের। এই অর্থের জোগান দেওয়া হয় গোপন তহবিল থেকে। এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট আসলাম বেগ ও দুররানিকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। রায়ে বলা হয়, ১৯৯০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। 'বেগ ও দুররানি অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।' এরপর ইফতেখার অনেকটা প্রকাশ্যেই সামরিক বাহিনীর সমালোচনা অব্যাহত রাখেন, যাতে বাহিনীটির প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইফতেখারের প্রকাশ্য বিবৃতির জবাবে সম্প্রতি মুখ খোলেন বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি। গত ৫ নভেম্বর তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের এক বৈঠকে বক্তব্য দেন। কায়ানি বলেন, 'রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করার একতরফা দায়িত্ব কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়নি। স্বল্পমেয়াদি কোনো স্বার্থের জন্য আমরা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।' সামরিক বাহিনী ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তা করা অর্থহীন বলে সেই বৈঠকে সেনা কর্মকর্তারা মত দেন। বিশ্লেষকদের মতে, ওই বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকার কলামিস্ট সিরিল আলমেইদা এ অবস্থাকে নজিরবিহীন অভিহিত করে বলেন, 'সামরিক বাহিনী ভয় পাচ্ছে, পাছে তাদের প্রভাব হাতছাড়া হয়।' তিনি বলেন, 'আগে এ ধরনের বক্তব্য শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।' তাঁর মতে, জনগণের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি আগের সেই সমর্থন আর নেই। এর পেছনে সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক বেশ কিছু ব্যর্থতাকেই দায়ী করা হয়। এর শুরু দেশটিতে মার্কিন বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য এবং সর্বশেষ ২০১১ সালের মে মাসে অ্যাবোটাবাদে বিন লাদেন হত্যা অভিযান। ওই ঘটনার পর থেকে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে সেনাবাহিনী ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সেনা গোয়েন্দাদের হাতে গুপ্তহত্যা বা গুমের বিষয়টি।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০০২ থেকে তালেবান ও আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানের বিনিময়ে পাকিস্তান বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা পেলেও এই অভিযানে পাকিস্তানকে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক বেশি। পাকিস্তানের অথনৈতিক জরিপ ২০১০-১১ মতে, ইসলামী জঙ্গিবিরোধী যুদ্ধে গত ১০ বছরে পাকিস্তানের ৪০ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছে। ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধকে সমর্থন করতে গিয়ে পাকিস্তানকে এই ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। আর সামরিক বাহিনীর প্রতি জনগণের যে মোহ ছিল তা অনেকটাই কেটে যাওয়ায় তারাও বেকায়দায় রয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলমান লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন অনেকে। সূত্র : আল-জাজিরা।
No comments