ডোরেমন প্রজন্ম! by সাইদ সিদ্দিকী
ছয় বছর বয়সের খালাতো বোনের জন্য হলিক্রস স্কুলের ফরম নিয়ে যখন বাসায় পেঁৗছলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়। আমাকে দেখেই অসহায় ভঙ্গিতে খালাম্মা বললেন, তোর বোন সকালের পর এখনও কিছু খায়নি।
একটু অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করতেই খালাম্মার সরল উত্তর, কারণ নোবিতা খায়নি। আমি নোবিতাকে চিনি না। ভেবেছিলাম পাশের ফ্ল্যাটের কেউ হবে। কিন্তু না, পরক্ষণেই আমার ভুল ভাঙল। নোবিতা ডোরেমন কার্টুনের প্রধান চরিত্র। খালাম্মার ভাষায়, নোবিতা যা করে ও ঠিক তাই করে। নোবিতা আজ খায়নি, তাই সেও খাবে না। নোবিতা হোমওয়ার্ক ফাঁকি দেয়, তাই সেও মাঝে মধ্যে মায়ের চোখ এড়িয়ে এই কাজটি করে। নোবিতা মিথ্যা বলে, তাই সেও মিথ্যা বলে। আর কথার ফাঁকে হিন্দি বলা সে তো আছেই। এমন পরিস্থিতিতে আমি নতুন বলে ধন্ধে পড়ে যাই। ডোরেমন সম্পর্কে জানতাম না, ঠিক তা নয়। হিন্দিতে ডাবিং করা বাচ্চাদের কাছে জনপ্রিয় জাপানি কার্টুন_ এতটুকুই জানতাম। কিন্তু এটি যে এমন ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে, এমনটি জানতাম না। একটু খোঁজ নিয়েই শুনলাম, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে ঢাকার প্রায় প্রতিটি ফ্ল্যাটের একই দশা। এখানে ডোরেমন এক ব্যাধির নাম। কেউ কেউ বলেন, বাচ্চারা ডোরেমনজ্বরে ভুগছে। স্কুলে গেলে ডোরেমন ব্যাগ চাই। ডোরেমন কার্টুনের বই কিনে না দিলে সে স্কুলের পড়া পড়বে না। ডোরেমন খাতা, ডোরেমন কলম, ডোরেমন রাবার, ডোরেমন বক্স, ডোরেমন পোশাক, এমনকি জন্মদিন পালনে ডোরেমন কেক কাটতে হবে। রীতিমতো ডোরেমনময় জীবন। কোমলমতি বাচ্চাদের ঘাড় থেকে এই ডোরেমন ভূত কিছুতেই নামানো যাচ্ছে না। এভাবেই আমাদের চোখের সামনে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। যারা ডোরেমন প্রজন্ম!শিশুদের ওপর ডোরেমনের এমন প্রভাব বিস্তারে প্রথম ও প্রধান সমস্যাটি হলো ভাষাগত। আমাদের ভাষার একটি রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। বইয়ের গল্পে আর মা-বাবার কাছে শুনলেও আমাদের শিশু প্রজন্ম সেটি অনুধাবন করছে না মোটেও। এমনিতেই দেশে গড়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলা মাসের নামগুলো ভালো করে বলতে পারে না। এখন আবার ডোরেমন যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে আমাদের নবীনতম প্রজন্মকে স্বাভাবিকভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষায় বাধাগ্রস্ত করছে। শিশুরা প্রকৃতিগতভাবেই কাদা মাটির মতো। পারিপাশর্ি্বকতাই এদের গড়ে তোলে। যে মুহূর্তে সে বাংলা ভাষার গাঁথুনিকে শক্ত করবে সে মুহূর্তে সে হিন্দি শিখছে। দিনের অধিকাংশ সময়, বিশেষ করে স্কুলের নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা আর ঘুমের সময় ব্যতীত সে বসে আছে ডোরেমনের সামনে। সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে শুনছে ডোরেমনের হিন্দি সংলাপগুলো। সারাদিনে সে বাংলা ভাষা যতটুকু শুনেছে তার চেয়েও কয়েকগুণ হিন্দি ভাষা শুনেছে ডোরেমন কার্টুন থেকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে নিজের অজান্তে বাবা-মা আর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে হিন্দি বলছে।
সমস্যা এখানেই শেষ নয়। তারপর রয়েছে এর নেতিবাচকতা। ছোটদের জন্য দেশে-বিদেশে যে কার্টুনগুলো তৈরি হয় সেগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে এর মাধ্যমে তাদের ইতিবাচক কাজগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যেমন বড়দের সম্মান করতে হবে, স্কুলের পড়া ঠিকঠাকমতো শিখতে হবে, সত্য বলতে হবে ইত্যাদি। আমাদের মীনা কার্টুন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু ডোরেমন নামক এই কার্টুনটি একেবারেই ভিন্নরকম। এখানে নোবিতা নামে যে প্রধান চরিত্র সে পড়াশোনায় অত্যন্ত অমনোযোগী। সে তার বাবা-মা আর শিক্ষকদের ফাঁকি দিয়ে নানা অপকর্ম করে এবং এ ক্ষেত্রে 'ডোরেমন' নামক আরেকটি চরিত্র তাকে এসব অপকর্মে সাহায্য করে। এসব হয়তো তার ওপর প্রভাব ফেলত না যদি সে পরিণত বয়সে এসব দেখত। কিন্তু সে এমন একটি বয়সে এসব নেতিবাচক চরিত্রগুলো দেখছে, যখন তার শুধুই দেখে শেখার বয়স। শুধু তাই নয়, এই ডোরেমনের মাধ্যমে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 'ডিজনি' নামক চ্যানেলে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কার্টুনটি দেখানো হচ্ছে। তাই পরিবারের ছোট্ট সদস্যটির কারণে বাবা সংবাদ দেখতে পারছেন না, মা সিরিয়াল দেখতে পারছেন না, বড় ভাইটি খেলা দেখতে পারছে না। এভাবে পরিবারের ক্ষুদে সদস্যটির ওপর সবার ক্ষোভ বাড়ছে। অল্প সময়ের জন্য হলেও তৈরি হচ্ছে দূরত্ব আর মনস্তাত্তি্বক টানাপড়েন, যা একটি শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
প্রশ্নটি হলো, এর সমাধান কী? কীভাবে আমাদের শিশু প্রজন্মকে এই ডোরেমনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা যায়। আমরা কি হঠাৎ করেই এই দেশে 'ডিজনি' চ্যানেলের প্রদর্শন বন্ধ করে দেব? না, এ রকম করা মোটেও উচিত হবে না। সেটি হবে আরও বড় ধাক্কা। সুতরাং আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। আমাদের 'মীনা' আর 'সিসিমপুর' কার্টুনের আরও বেশি বেশি এপিসোড তৈরি করতে হবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আরও নতুন নতুন কার্টুন তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশি অন্য কার্টুনকে বাংলায় ডাবিং করতে হবে।
য়শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments