সমাজ-শিশুরও আছে অধিকার by গওহার নঈম ওয়ারা
সাগর আর রুনি কী ভেবে ছেলের নাম মেঘ রেখেছিলেন তা আমাদের জানা নেই; কিন্তু এই নামটা এখন বিপদে পড়া সব শিশুর প্রতীক হয়ে গেছে। আমাদের অতি উৎসাহের তাপ যদি মেঘের গায়ে লাগতেই থাকে তাহলে খরায় পুড়ব আমরা_ এই সত্যটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
খুবই জানতে ইচ্ছা করছে সেসব মনোবিজ্ঞানীর হাল সাকিন যাদের দোহাই দিয়ে মেঘের কাছ থেকে তথ্য পেতে চাইছেন কর্তারা। এ দেশের আইন এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা আছে।শিশুদের ওপর আমাদের দাদাগিরি চিরন্তন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্ট এই ছোটানো কাজটা শুরু করেছিল। তখন তৈরি হয় আমাদের গর্বের আইন 'শিশু আইন', যদিও আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের কথায় এই আইনে, বিশেষ করে বলা হয়েছিল তবুও এখানে বিপদে পড়া শিশুদের প্রতি বড়দের আচরণ, পুলিশের আচরণ, সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আচরণ কেমন হবে তা যথেষ্ট পরিষ্কার করে বলা আছে। এই আইনে এটাও বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিশু দূরে থাক এমনকি 'অভিযুক্ত' শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যাতে সে বিচলিত হতে পারে। তাকে থানায় নেওয়া বা রাখা যাবে না, তাকে সাধারণ কোর্টেও নেওয়া যাবে না। যদি কোর্টে নিতেই হয় তবে এমনভাবে এমন দিনে এমন ঘরে তাকে নিতে হবে যেন সে বুঝতে না পারে_ তাকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। এ দেশের স্থপতিরা বসে যে আইনটা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেটা এখন আমাদের কিসের তলায় পড়ে আছে তা জানারও কারও আগ্রহ নেই।
যে দেশের রাস্তায় যত শিশু সে দেশ তত গরিব। ধনী দেশের রাস্তায় শিশুদের কম দেখা যায়। তারা থাকে পার্কে, স্কুলে, ক্রেশে, বাড়িতে, খেলার মাঠে, তেমন অসুস্থ হলে বা নতুন জন্ম নিলে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে। আর আমাদের শিশুরা থাকে রাস্তায়, বাজারে, পুলিশের খাওয়ার গাড়িতে, লঞ্চের কুলির সারিতে, গ্যারেজে, প্লাটফর্মে, বাসস্ট্যান্ডে। আমাদের সেবা দেওয়ার জন্য কোথায় নেই তারা। আমাদের অর্থনীতিতে তাদের সিংহভাগ অবদান কিন্তু আমাদের অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করেন না; দম্ভ করে বলে ফেলেন_ শিশু? শিশু আবার কী?
শিশুর প্রতি আমাদের নির্দয় আচরণের কোনো শেষ নেই। বাসে-গাড়িতে শিশুকে উঠিয়ে দিয়ে অথবা সিট থেকে উঠিয়ে 'দয়াপরবশ' হয়ে 'কোলের' ওপর বসিয়ে নেওয়ার দৃশ্যে কেউ প্রতিবাদ করি না। জুমার নামাজে মসজিদে গিয়ে যখন শিশুরা নিতান্তই শিশু বলে ইমামসহ সকলের অবহেলার পাত্র হয়, তখনও আমরা কিছু বলি না বরং উপভোগ করি। অনাথ আশ্রম আর গির্জায় গির্জায় যখন শিশুরা দিনের পর দিন লাঞ্ছিত হয়, শারীরিক লালসার শিকার হয়, তখনও আমরা মৌন 'মহান' হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, বলি না কিছুই।
এ দেশে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৪৭% ভাগেরও কিছু বেশি। প্রায় আধাআধি বলা চলে। শুধু সংখ্যার কারণে হলেও তাদের সঙ্গে আমাদের আচরণ সমীহ, সম্মান আর পারস্পরিক মর্যাদার ওপর ভিত্তিতে রচিত হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের ঘর-মন-মসজিদ কোথাও শিশুদের জায়গা নেই। ঘরে রাখি শিশুদের সবসময় একটা চাপের মধ্যে। সে শুধুই প্রথম হবে ক্লাসে, মাঠে, আবৃত্তিতে, গানে, সাঁতারে আর তার এসব অর্জন আমি ভোগ করব, সবাই আমার দিকে তাকাবে ঈর্ষার নজরে, আমি তাদের (অন্য শিশুর অভিভাবক) দিকে তাকাব করুণার চোখে। মনে রাখি না শিশুর ভালো লাগা আর মন্দ লাগার বিষয়গুলো। শিশুরও যে একটা মন আছে সেটাও যে কাঁদে-হাসে। আমাদের তা মনে থাকে না। আমাদের যেমন ভালো না লাগলে হাজার চেনাজানা হলেও তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না, তেমনি পরিস্থিতি শিশুর জন্যও হতে পারে। শিশুরও মনে হতে পারে_ না এই বদমায়েশটার সঙ্গে বা এই শাকচুনি্নর সঙ্গে কথা বলব না।
শিশুদের কথা শুনতে হলে, শিশুদের কথা জানতে হলে আমাদের ভাবতে হবে_ এক একটি শিশু কমপক্ষে এক একজন অমর্ত্য সেন, এক একজন দিলীপ কুমার, মহাশ্বেতা দেবী কিংবা মার্গারেট থেচার। তাদের ব্যক্তিত্ব-মনমর্জিকে যেমন আমলে নিতে হয়, পাত্তা দিতে হয়, তেমনি শিশুদের মনমর্জিকেও আমাদের পাত্তা দিতে হবে।
এ দেশে শিশুদের মতো অসহায় আর কেউ নেই, তাই সহজেই তারা আমাদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে বাড়িতে, পথেঘাটে, উপাসনালয়ে। সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশ, শিক্ষক বা সেবাদার সবার জন্যই আচরণবিধি আছে। কীভাবে শিশুকে পড়াতে হবে, কীভাবে তার কথা শুনতে হবে, কীভাবে তাকে রাখতে হবে, কীভাবে তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে হবে_ এসবই কাগজে-কলমে আবছা নয় বেশ পরিষ্কার করেই লেখা আছে। তবু তারা তাড়া খাচ্ছে সর্বত্র, সবার কাছে।
সারা দুনিয়া যখন শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবছে, তৈরি করছে অবশ্য পালনীয় শিশু সুরক্ষা নীতিমালা, ঠিক করছে শিশুর সঙ্গে কীভাবে, কে, কখন, কেন? কতটুকু কথা বলবে আর শিশুর মর্যাদা, গোপনীয়তা আর সুস্থ থাকার বিষয়টিকে সবার ওপরে মর্যাদা দেবে, তখন আমরা খরায় ক্লান্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত অভাগা মানুষের মতো কষ্টে রাখা ফসলের বীজটা দাঁতে কাটছি বা রেঁধে খাচ্ছি।
আমাদের ক্ষুধাটা কি এতই কঠিন ক্ষুধা? আমার তো মনে হয় মেঘের নাম আর ছবি প্রচার করাটাও ঠিক হয়নি। আমাদের এই মেঘের সামনে এখন অনেক রাস্তা। তার স্কুল, বন্ধু, সহপাঠী, খেলার সাথী, শিক্ষক, পাহাড়, নদী, সবার সঙ্গে মিলেমিশে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের প্রচারযন্ত্রের সচিত্র প্রচারণা তাকে কি সে সুযোগ দেবে?
একবার আমরা বিশেষভাবে প্রান্তিক শিশুদের তালিকা করছিলাম। তখন সবে তার দেশ থেকে এ দেশে আসা এক তরুণী বলেছিলেন, তোমাদের এ তালিকা আরও দুটি দলের শিশুদের রাখা উচিত। এক. যেসব শিশুর বাবা-মা জেলে অথবা হাজতে আছে কিংবা লাপাত্তা আছে; দুই. যেসব শিশুর বাবা-মা খুন হয়েছে। প্রথম দলটার কথা কোনো রকম তর্ক ছাড়া মেনে নিলেও দ্বিতীয় দল নিয়ে তর্ক জমে উঠল।
তার যুক্তি বাবা-মা খুন হলে পত্রিকায় যে রকম অসমর্থিত বা আধা-সমর্থিত রগরগে খবর ছাপা হয়, তাতে তাদের শিশুরা আর আগের মতো অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না_ সমাজের লোকেরা মিশতে দেয় না, মিলতে দেয় না। স্কুলে, পাড়ায়, শহরে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাবা-মা দু'জনে মারা গেলেও এমনটি হতে পারে। আর লাশের হদিস না মিললেও গল্পের গাছপালা শিশুটিকে খেয়ে ফেলে রাক্ষসের মতো।
খুন হয়ে যাওয়া মানুষের শিশুদের খুন হতে হয় বারবার পদে পদে। শিশুদের সব ধরনের কষ্ট আর নির্যাতন থেকে রক্ষা করার জন্য একজন ন্যায়পালের 'খুবই' প্রয়োজন। জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়ে রাষ্ট্র কসম খেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে বারতিনেক। অনেক প্রতিশ্রুতির ভিড়ে সেটাও এখন ফেরার।
গওহার নঈম ওয়ারা : কলাম লেখক
No comments