সদরে অন্দরে-এ কোন আগুন জ্বলে শিক্ষায়তনে by মোস্তফা হোসেইন
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। পুড়ছে শিক্ষকের গাড়ি। দিয়াশলাইয়ের কঠিতে আগুন এসেছে শিক্ষার্থীর হাত ধরে। সেই শিক্ষার্থীরাই শিক্ষককে দাবড়িয়ে বেড়ায় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে। এমন চিত্রও কি কল্পনা করা যায়? অকল্পনীয় হলেও এটা বাস্তবচিত্র। খানিক পরের দৃশ্য, টেলিভিশন সংবাদে।
ক্যামেরায় ভয়ার্ত শিক্ষিকার আঙুল তখন ডানে নির্দেশ করছে। প্রকাশ হচ্ছে, ক্ষোভমিশ্রিত অভিজ্ঞতার বর্ণনা। ওই যে জগন্নাথের ছেলেরা, ওরাই ঘটিয়েছে এসব। আমরা কি তাদের সন্ত্রাস থেকে নিরাপত্তা পাব না?কার কাছে ওই শিক্ষিকার এই দাবি? শুধুই কি সরকার এ দাবি পূরণের অধিকারী? আর কেনই বা নয়?
ঘটনাটি বুধবারে সংঘটিত পুরনো ঢাকার প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুল কলেজের। এক শিক্ষিকা ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন, ছাত্র নামের সন্ত্রাসীরা কিভাবে কবি নজরুল কলেজে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করে রক্তাক্ত করেছে, সেখানে থাকা শিক্ষকদের গাড়িতে অগি্নসংযোগ করেছে। আর কিভাবে সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের হাতে নাজেহাল হয়েছেন।
অথচ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত, তা অতি তুচ্ছ একটি ব্যাপার মাত্র। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাদানুবাদ থেকে এত বড় ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবাও যায় না। ধৈর্যহারা শিক্ষার্থী স্বগোত্রীয়দের ওপর এভাবে হামলে পড়ার কারণ কি শুধুই সাময়িক ক্রোধ থেকে, নাকি এর পেছনে আরো কিছু রয়েছে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির ফরমের টাকা ব্যাংকে জমা দিতে এসেছিলেন। এটা অবৈধ কোনো কাজ নয়। কিন্তু এর পেছনে আর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি? হলফ করে বলা যাবে না, এর পেছনে ভর্তি-বাণিজ্যজাতীয় কোনো অনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত নেই। বলা যাবে না, সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য লাইনে দাঁড়ানো কোনো ছাত্র নেতা বা কর্মী নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে গিয়েই এ অঘটন ঘটিয়েছে। ঘটনার মূলে যাই থাক না কেন, কোনো শিক্ষার্থী এমন আচরণ করাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আর এ ঘটনার জন্য এককভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই সর্বোতভাবে দায়ী তা-ও বলার সুযোগ নেই। এক হাতে তালি বাজে না, এমন কথাকে মেনে নেওয়ার জন্যই নয়। ঘটনার বর্ণনাও বলে দেয়, উভয় পক্ষই সেখানে চরম ধৈর্যহারার পরিচয় দিয়েছে। আসলে নৈতিকতা বোধ যখন মানুষের মধ্য থেকে বিদায় নেয়, শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে যখন কেউ নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায় তখনই এ ধরনের ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে।
এ ঘটনার পর দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা হয়তো তদন্ত করে প্রতিবেদনও জমা দেবে। হয়তো সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভাগ্য হবে অতীতের মতোই। ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকবে আলমারিতে। আবার শাস্তিও পেতে পারে হোতাদের কেউ কেউ। কিন্তু এতে করে কি এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে যে ভবিষ্যতে এমন আর কোনো ঘটনা ঘটবে না?
ধ্বংস করা তো তারুণ্যের পরিচায়ক নয়। সন্ত্রাসী তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ হতে পারে না। কিন্তু এর পরও আমাদের এমন দৃশ্য কেন দেখতে হচ্ছে? এসব প্রশ্ন করলে জবাব পেতে কিন্তু খুব দেরি হবে না। এগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, পেশিশক্তির প্রতি প্রশাসনের দুর্বলতা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকের দূরত্ব, যাকে শিক্ষা পরিবেশের অসুস্থতার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
কবি নজরুল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী যদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে থাকে, তাহলে সেটা তাৎক্ষণিক সমাধান করা যেত। এমনকি যে মুহূর্তে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রক্তাক্ত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে তখনো দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারত। শিক্ষকরা যদি তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করতেন, তাহলে বোধ করি ঘটনাটা এত দূর পৌঁছাত না। কিন্তু উভয় পক্ষই অভিভাবকত্বকে মর্যাদা দেওয়ার পরিবর্তে সেখানে পেশিশক্তি প্রদর্শনকেই শ্রেয় মনে করেছে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের ভূমিকা তাই প্রশ্নাতীত নয়। প্রশাসন তথা ছাত্র-শিক্ষকের আন্তসম্পর্কের দূরত্বের কারণে শিক্ষার্থীকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে কুণ্ঠা বোধ করেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। প্রশ্ন আসে, তারা এই অধঃপতিত পথে যাওয়ার প্রেরণা পায় কোথা থেকে।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা উদাহরণ আনতে পারি, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে। সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি, সেখানকার প্রক্টর নিজেরই ছাত্রীকে কিভাবে ঘুষি দিচ্ছেন। এত বড় একটি ঘটনা সব প্রচারমাধ্যমে প্রকাশের পরও সেই ঘটনার সমাধানের কোনো খবর পত্রিকান্তরে আজও প্রকাশ হয়নি। একজন শিক্ষক হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তিনি শ্রদ্ধেয়। সরাসরি শিক্ষা লাভ করে না এমন শিক্ষার্থীর কাছেও একজন শিক্ষক শ্রদ্ধা পাওনা। সেই শিক্ষকদের কাউকে যদি সরাসরি এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকতে দেখা যায়, তাহলে শিক্ষার্থী কি সেই শিক্ষকের প্রতি আগের মতো বিনয়ী থাকতে পারে? শিক্ষকের ব্যক্তিগত আচরণও কখনো কখনো শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করতে পারে। এ সত্যকেও কি অস্বীকার করা যাবে? কেউ যদি বলেন, একজন শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজেরই অংশ, তাহলেও কি সর্বাংশে মেনে নেওয়া যাবে? আমাদের মনে রাখা দরকার, একজন শিক্ষক অবশ্যই ঘূণেধরা সমাজ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। কারণ তিনি আলো ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত। তিনি নিজে আলোকিত, এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে। সুতরাং আমরা সাধারণ মানুষ শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আলোময় আচরণই প্রত্যাশা করি।
আবার অন্যদিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্ত্রাসী আচরণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই পরিবেশ কি শিক্ষায়তনের শান্তি রক্ষার পক্ষে কখনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে? স্পষ্টতই যদি বলি, আমাদের দেশে যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের মুক্ত মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। সেখানে স্পষ্টত, তারা পেশিশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে হেন কোনো কাজ নেই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হয় না। শুধু তাই কি, আমরা দেখতে পাই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে বিকৃত যৌন আচরণের মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। এ ক্ষেত্রে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনতে পারি। সেখানে ধর্ষক ছাত্র নেতাকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতাসীন প্রশাসন কিভাবে নির্লজ্জ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে সেই প্রশাসনকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবির মুখে কৌশলে সরিয়ে দেওয়ার পর আবার পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ ঘটনা বছর কয়েক আগের মাত্র। কিন্তু ঘটনা তো নদীর স্রোতের মতো বয়েই চলেছে। পার্থক্য শুধু স্থান-কাল-পাত্রের। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে মুক্তির পথ হতে পারে নৈতিকতাকে সমুন্নত রাখা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে অবক্ষয়প্রাপ্ত সমাজের জঞ্জাল থেকে আলাদা করার পথ বেছে নেওয়া। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তসম্পর্ক উন্নয়ন।
mhussain_71@yahoo.com
No comments