মীর কাসেমকে ছাড়াতে মরিয়া কেসিডি by আজাদুর রহমান চন্দন
একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী লবিস্ট ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বর্তমানে মীর কাসেম আলীকে ছাড়ানোর তদবিরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মিসৌরির গ্রেগ হার্টলে। তিনি কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ভাইস চেয়ারম্যান।
সেন্ট লুইস পোস্ট-ডিসপাচ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন কংগ্রেস, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অন্যান্য দেশ যাতে মীর কাসেম আলীকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে সে চেষ্টাই করছেন হার্টলে। 'মিসৌরিয়ান ইন কোয়েস্ট টু ফ্রি বাংলাদেশি নিউজপেপার ওনার ফ্রম জেল' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গ্রেগ হার্টলে এরই মধ্যে মীর কাসেম আলীর পক্ষে মার্কিন কংগ্রেস, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন জোগাড় করে ফেলেছেন। এ ছাড়া তাঁর কম্পানি এ বিষয়ে সরাসরি আবেদন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছেও।জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীকে গত ১৭ জুন গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁকে আটক রাখা হয়েছে। মীর কাসেম আলীর দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের অধীনে রয়েছে দৈনিক নয়াদিগন্ত এবং দিগন্ত টেলিভিশন। এ বিষয়টিকে পুঁজি করেই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বিদেশে। বলা হচ্ছে, মীর কাসেম আলীর মালিকানাধীন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সরকারের সমালোচনা হওয়ায় তাঁকে আটক রাখা হয়েছে।
সেন্ট লুইস পোস্ট-ডিসপাচের অনলাইন সংস্করণ এসটিএলটুডে.কমের প্রতিবেদনে গ্রেগ হার্টলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, মীর কাসেম আলীকে আটক রাখার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার যদি জোরালো নিন্দা ও প্রতিবাদ না জানায়, তাহলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রথমে চট্টগ্রামের নেতা ছিলেন মীর কাসেম আলী। পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সুবাদে তিনি আল-বদর হাইকমান্ডের সদস্য ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রামে বহু হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগ আছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার লক্ষ্যে মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের মে মাসে ওয়াশিংটনভিত্তিক কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে লবিস্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। কেসিডির সঙ্গে ওই সময় ছয় মাসের জন্য চুক্তি হয় ২৫ মিলিয়ন ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮২ কোটি টাকা)। ওই চুক্তিপত্রের একটি কপি কালের কণ্ঠের হাতে আসে গত বছর। এর ভিত্তিতে গত বছর ২ জুন কালের কণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় 'যুক্তরাষ্ট্রে ১৮২ কোটি টাকায় লবিস্ট নিয়োগ মীর কাসেমের' শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী কেসিডিকে ২৫ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছে মীর কাসেম আলীকে। ওই প্রতিবেদন তৈরির সময় মীর কাসেম আলীর মন্তব্য জানার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে কাসেম আলীর ফোন নম্বর চাইলেও তিনি তা দেননি। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মীর কাসেম আলীর পক্ষ থেকে কালের কণ্ঠে কোনো প্রতিবাদও পাঠানো হয়নি। তবে চুক্তির খবর সঠিক নয় বলে তখন নানাভাবে দাবি করেন মীর কাসেম আলী।
কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে মীর কাসেম আলীর প্রথম চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল প্রয়োজনে আরো ২৫ মিলিয়ন ডলার (১৮২ কোটি টাকা) দিয়ে চুক্তির মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানো যাবে। মীর কাসেম আলীর পক্ষে কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এখনো তৎপরতা চালানোয় ধরে নেওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটিকে এ পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
তৎপর টবি ক্যাডম্যান ও আল-গামদিরাও : ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে জামায়াতীরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তাদের লিগ্যাল কনসালটেন্ট বলে দাবি করলেও মূলত তিনি আইনি পরামর্শের বদলে অন্য কাজে ব্যস্ত। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের হাত থেকে জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে তথা এ বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। একই কাজ করছেন স্টিভেন কে কিউসি নামের আরেক ব্যক্তি। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সূত্রে জানা যায়, স্টিভেন কে কিউসি এবং টবি ক্যাডম্যানের জন্য এবং জামায়াতের আইনি খরচ চালাতে লন্ডন থেকে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৬৫ কোটি টাকা) সংগ্রহ করেছেন প্রবাসী জামায়াত নেতারা। সেই অর্থেই মূলত টবি ক্যাডম্যান এবং স্টিভেন কে কিউসি জামায়াতের আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের মূল কাজ হলো বিভিন্ন টিভি, পত্রিকা, টক শো, জার্নালে বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে এবং বাংলাদেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা।
মধ্যপ্রাচ্যে এ কাজে নিয়োজিত আছেন সাবেক সৌদি কূটনীতিক ড. আলি আল-গামদি। এক সময় বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন তিনি। ইদানীং তিনি মাঝেমধ্যেই সৌদি গেজেটে লিখছেন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে। সবশেষ লেখাটি তিনি লিখেছেন ১৪ নভেম্বর। ওই লেখায় গামদি জানিয়েছেন, সম্প্রতি সৌদি আরবে গিয়ে টবি ক্যাডম্যান নাকি বলেছেন, বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনের ব্যাপক লংঘন হচ্ছে। এ বিচার বন্ধ করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে ক্যাডম্যান সৌদি আরবের প্রভাবশালীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
No comments