বাংলাদেশের জানালা by নন্দিতা ফরহাদ

বিদেশে (ইউরোপে) বসে যে জানালাটা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি বাংলাদেশকে দেখি, সেই জানালাটা হলো প্রথম আলো। দেশে থাকার সময়টায় আমরা ছিলাম প্রথম আলোর একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত। প্রতিদিন সকালে আমাদের বাসায় কাজের সহযোগী মেয়েটা যখন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলত,
ওর হাতে থাকত প্রথম আলো। মাঝেমধ্যে শিরোনামগুলো পড়ে শোনাত ও। মাঝেমধ্যে আধা চোখ খুলে ও আধা চোখ বুজে আমি পড়ে নিতাম। এমন করেই দিনটা শুরু হতো প্রথম আলোকে সঙ্গী করে। রাতে ঘরে ফিরে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিস্তারিত পড়তাম আকর্ষণীয় খবরগুলো।
বিদেশে আসার পর সকালটা শুরু হতো কেমন যেন ‘কী নাই, কী নাই’, ‘কী হলো না, কী হলো না’ ভাব দিয়ে। পরে বুঝলাম, ‘কী নাই, কী নাই’ ভাবের কারণ আর কিছুই নয়, সেটা হলো তরতাজা প্রথম আলো। তো কী আর করা! একদিনের কাগজ, রঙিন ছবি আর কালির গন্ধওয়ালা প্রথম আলো না-ই বা পেলাম, ডিজিটাল প্রথম আলোকেই তাই আমার বাংলাদেশের জানালা বানিয়ে ফেললাম।
বিদেশবাসের প্রথম দিকে যখন আমার চাকরি ছিল না, আক্ষরিক অর্থেই আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল প্রথম আলো। সকালে চা নিয়ে বসতাম কম্পিউটারের সামনে, সারাটা দিন পত্রিকা পড়ে কাটাতাম। মাঝেমধ্যে ফেসবুক আর স্কাইপে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ—এই ছিল আমার রোজকার রুটিন। দেশে থাকা বন্ধুদের প্রথম আলোর গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবরের লিঙ্ক ই-মেইলে শেয়ার করলে ওরা দম্ভভাবে উত্তর দিত, সকালেই কাগজে খবরটা পড়েছি। তা-ও আমি দমতাম না, এখনো দমি না। তাই মহা উৎসাহে এটা-সেটা খবরের লিঙ্ক সবাইকে শেয়ার করেই যাচ্ছি।
তারপর যখন চাকরি শুরু করলাম, তখন আর ঠিক সকালবেলাতেই প্রথম আলোর জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া হতো না। কিন্তু অফিসের কম্পিউটারের ব্রাউজারে প্রথম আলো খুলে মিনিমাইজ করে রাখতাম। কাজের চাপ বেশি থাকলে সেটা পড়া হতো না। কিন্তু আমি একধরনের মানসিক স্বস্তি পেতাম যে বাংলাদেশের জানালা খোলা আছে। আমি চাইলেই প্রথম আলোর সেই জানালা দিয়ে একঝলক বাংলাদেশের বাতাস পেতে পারি যেকোনো সময়।
কাজের চাপ কম থাকলে অবসর কাটত প্রথম আলো পড়ে।
যেহেতু অফিসে বসে ফেসবুকিং করাটা খুব শোভন নয়, তাই কাজের অবসরে পেপার পড়াটাকেই অবশ্যকর্তব্য হিসেবে পালন করতাম। প্রথম পাতা পড়ে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম সারা বিশ্ব। আমাদের অফিসটা ওপেন প্লেস সিস্টেম। কোনো ঘর, কিউব বা ঘেরাটোপ নেই। তাই মজার ব্যাপার হলো, প্রথম আলোর সারা বিশ্বের পাতায় কখনো কখনো ইউরোপের অতিরিক্ত বরফ বা ইউরোপের অন্য কোনো ছবি থাকলে আমার কলিগরা আশপাশ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করত, ঘটনাটা কী। এই খবর, অর্থাৎ ইউরোপের খবর বাংলাদেশের পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। আর কখনো কাস্টমার ভিজিটের (আইবিএম অফিসে ইন্টারনেট কাস্টমারদের সঙ্গে ডিল করতে হতো) সময় হলে ম্যানেজার এসে বলত, ‘আপাতত তোমার এই অতিসুন্দর অক্ষরের পত্রিকাটা কিছু সময়ের জন্য নামিয়ে রাখো, কাস্টমার চলে গেলে না-হয় আবার পড়া শুরু কোরো।’ এমনি করে আমি অফিসের আটটা ঘণ্টা প্রথম আলোর জানালা খুলে বসে থাকতাম।
স্মার্টফোন হাতে ওঠার পর যেন আবারও আমি সেই বাংলাদেশের সকালবেলার দিনগুলো ফেরত পেলাম। চোখ মেলেই ফোনটা পাশ থেকে তুলে নিয়ে প্রথম আলো খুলে হেডলাইনে চোখ বোলাই। বাসে যেতে যেতে প্রথম পাতা পড়ে ফেলি। তারপর শেষের পাতাটা শেষ করে সারা বিশ্ব নিয়ে বসি। বাড়ি ফিরে সম্পাদকীয় ও খোলা কলম, ফিচার পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।
খেলাধুলায় আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই ক্রিকেটের খবর ছাড়া খেলার পাতাটা তেমন পড়া হয় না। তা ছাড়া কমবেশি সবটা পড়া হয়। আজকাল আমার বাংলা তেমন লেখা হয় না, তবে গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমার বিদেশি বন্ধুরা ও সহকর্মীরা সবাই বাংলা অক্ষর চিহ্নিত করতে পারে। আর তা শুধু প্রথম আলোর জন্যই। ওদের মুখে যখন শুনি, ‘আর ইউ রিডিং প্রথম?’, তখন ভীষণ মজা লাগে—অন্তত একটা বাংলা শব্দ তারা শিখেছে, আর তা হলো প্রথম আলোর ‘প্রথম’।
নন্দিতা ফরহাদ
সুইডেন

No comments

Powered by Blogger.