গুলাগে কেন? by মোফাজ্জল করিম
(শুরুতেই একটি সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়ে রাখি : পাঠক, আজকের লেখাটির শিরোনামটি একটু সাবধানে পাঠ করবেন, বিশেষ করে শিরোনামের প্রথম শব্দটি। তা না হলে শুচিতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।)জানি, কোনো কোনো পাঠক হয়তো বলতে শুরু করেছেন : ওই দ্যাখো, ভদ্রলোক আবারও হেঁয়ালি শুরু করেছেন।
কেন রে বাবা, একটু ঝেড়ে কাশলে কী হয়। আচ্ছা বেশ, তাহলে খুলেই বলি।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে তো ম্যালাই কথাবার্তা হলো, এখনো হচ্ছে, এত কথাবার্তা, এত নাটকের পর আমার তো মনে হয়, দুঃখে-ক্ষোভে-লজ্জায় পদ্মা বিবি না আবার সুইসাইড 'খেয়ে' বসে। পদ্মা বিবিও ভাবতে পারে, আমাকে নিয়ে যখন এত কথা, তখন আমি আমার এই জীবন আর রাখব না। আর ইতিমধ্যে মৃতপ্রায় শীর্ণকায় পদ্মা যদি সত্যি মরে যায় তাহলে তার ধু ধু বালুচরের ওপর দিয়ে হেঁটেই 'পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি' (গরুর গাড়ি, পাজেরো, রেলগাড়ি ইত্যাদি সব) অবস্থা হয়ে যাবে, বিশ্বব্যাংককে তখন আমরা মুনশিগঞ্জ/নরসিংদীর একটা বিশাল সাগরকলা দেখাতে পারব। কাউকে আর গুলাগে পাঠাতে হবে না, হার্টফেলও করতে হবে না কিংবা কাউকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে বাড়ি যেতে হবে না।
আবার গুলাগ! শব্দটা যখন এসেই গেল তখন ১৮ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তাঁর বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ফটক নয়, ফাটকটির কথা সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেছেন তার কথাটি স্মরণ করিয়ে দিই। জানি না পৃথিবীতে এত ভয়াবহ সব কারাগার_যেমন আগের আমলের আন্দামান, হাল আমলের গুয়ানতানামো ইত্যাদি থাকতে হঠাৎ গুলাগ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি কারাগার, যেখানে সাধারণ অপরাধীসহ রাজবন্দিদের নির্বাসন দেওয়া হতো) নামটা কেন মনে পড়ল তাঁর। অবচেতনে অন্য কিছু মনে পড়ে যায়নি তো? তিনি বলেছেন, 'আমার জীবনটাকে গুলাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' আমরা যারা এই নাটকের প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্য থেকে দর্শকের সারিতে বসে আছি, তারা জানি কারা তাঁকে ওই নির্বাসনে পাঠানোর পাঁয়তারা করছে। নিশ্চয়ই এ দেশের আমজনতা নয়, বিরোধী দল নয়, তাঁরই সমগোত্রীয়রা, যাদের ওপর রাগ করে তিনি ক্যাবিনেট মিটিং পর্যন্ত বর্জন করছেন। কিন্তু এত জায়গা থাকতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে ওখানে পাঠাতে গেলেন কেন? এটা ভারি অন্যায়! ড. মসিউর রহমানকে যা করা হয়েছে, ইংরেজিতে তাকে বলা হয় 'ডিচ্' করা। হি হ্যাজ বিন ডিচড্ বাই হিজ প্যালস। তাঁর দোস্তরা তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। ইংরেজি সংবাদপত্রের শিরোনাম এটাও হতে পারে : 'ড. মসিহ লেফট ইন দ্য কোল্ড'। ইংরেজি হচ্ছে ঠাণ্ডা বরফের দেশের ভাষা। মাইনাস ৫-৭ ডিগ্রিতে বিলেতের বা আমেরিকার হাইওয়েতে রাতের বেলা কাউকে ফেলে রেখে যাওয়াটা যে কী, তা ওসব দেশের লোকেরা হাড়ে হাড়ে (শব্দার্থে) বোঝে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই এই বাগধারাটির উৎপত্তি। আমাদের দেশে এত ঠাণ্ডা নেই, আছে নিদাঘের জ্বলুনি, যার দহনে, বোধ করি, ড. মসিহ এখন জ্বলেপুড়ে মরছেন। আল্লাহ তাঁকে শান্তি দিন।
তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, ড. মসিহ যেখানে আগাগোড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যাচ্ছেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে তিনি কোনো প্রকার দুর্নীতিতে জড়িত নন, বিশ্বব্যাংক বা আর কারো কাছে কোনো প্রমাণ থাকলে আসুক, জনসমক্ষে সেগুলো পেশ করুক, তিনি তদ্দণ্ডেই নির্বাসনে নয়, একেবারে বনবাসে চলে যাবেন, তাঁর রক্ত দিলে (আল্লাহ মাফ করুক) যদি পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে যায়, তবে তিনি তা-ও দিতে প্রস্তুত আছেন, সেখানে সবাই একযোগে তাঁকে এ রকম মুষ্টাঘাত করা কি ঠিক হচ্ছে? তিনি যে ইতিমধ্যেই ম্যাটের ওপর বসে পড়ে নাকমুখের রক্তক্ষরণ সামলানোর চেষ্টা করছেন, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তার পরও আবার এই 'হুক', 'জ্যাব', 'পাঞ্চ' ইত্যাদির মুষলবর্ষণ কেন? আর 'রেফারিই' বা কী করছেন? তিনি তো খেলোয়াড়ের এই নাজুক হালত দেখতেই পাচ্ছেন, খেলার নিয়মকানুনও তাঁর মুখস্থ, তিনি কেন এগিয়ে এসে হয় ১০ পর্যন্ত গুনতে শুরু করছেন না, অথবা প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করছেন না? (নাহ্, এদের কারো গায়ে-গতরে দেখছি একটুও দয়ামায়া নেই!)। শোনা যায়, রেফারি (আম্পায়ার) সিদ্ধান্তের জন্য নাকি বিষয়টি ওয়াশিংটনস্থ থার্ড আম্পায়ারের কাছে 'রেফার' করেছেন। দরকার ছিল কি? এরপর তো থার্ড আম্পায়ারের ঘুম হারাম হয়ে যাবে, বাংলাদেশ_এবং এ ধরনের 'ঠেলি খেলো, ফাউল নাই' মার্কা বিশ্বের তাবত ভেন্যু_থেকে রেফার করার হিড়িক পড়ে যাবে। যা হোক, দেখা যাক, টিভি ক্যামেরা কী বলে।
তবু আমি আবারও জোর দিয়ে বলব যতক্ষণ না একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ_তা খুনেরই হোক আর পাঁচ টাকার নুনেরই হোক_আইনের ভাষায় 'বিঅন্ড্ অল আয়োটা অব ডাউট' প্রমাণিত না হয়েছে, ততক্ষণ তাকে 'তুই চোর'-'তুই চোর' বলা যাবে না। সব দেশে এতদসংক্রান্ত প্রিসাম্্প্শন অব ল অত্যন্ত পরিষ্কার : একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়ে সেই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে তিনি নির্দোষ।
ফটক-সম্মেলনে (এবার কিন্তু ফাটক নয়, ফটক) ড. মসিহ একটি যুগান্তকারী ঘোষণা ও একটি পিলে চমকানো তথ্য দিয়েছেন। ঘোষণাটি (মন্তব্যও বলতে পারেন) হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের টাকায় বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতু হবে না। তিনি নাকি সব নথিপত্র ঘেঁটে-ঘুঁটে এই ধারণা লাভ করেছেন। শুনে একজন পাঠক হাসবেন না কাঁদবেন, নাকি তাঁরও ড. মসিহ্র মতো হার্ট অ্যাটাক করার ভয় ঢুকতে পারে, বুঝতে পারছি না। তবে এত বড় একটা বমশেল যেভাবে তিনি ফাটালেন, তা যদি সত্যি হয় তা হলে তো ড. মসিহ্দের খুলনার ভাষায় বলতে হয় : তা হলি আর বসি আছেন কেন? খেইল খতম, পয়সা হজম। এবার মানে মানে বাড়ি চলি যাতি পারেন। তবে দোহাই আপনাদের, ওই 'ছোট করে', 'নিজের পয়সায়', 'দেশবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তুলে' (লক্ষ করুন, শেয়ার লুটেরা, হলমার্ক-ডেসটিনিওয়ালাদের কথা বলা হচ্ছে না। হয়তো ভাবা হচ্ছে, ওগুলো হারাম পয়সা, ওগুলো দিয়ে ব্রিজ বানালে দুদিনেই ভেঙে পড়বে।), কিংবা চড়া সুদে মালয়েশিয়ার টাকায় ব্রিজ আমরা বানাতে পারি, বানিয়ে ছাড়ব_এসব কথা বলবেন না। দেশবাসীকে মুলা দেখিয়েছেন, আরো দেখান, ওটা দেখতে পয়সা লাগবে না; কিন্তু তাদের নাক-মুখে রক্ত ছোটে অমন কিছু করবেন না। আর রেলপথ বাদ দিয়ে শুধু যে সড়ক-সেতুর কথা বলছেন, তার সুদূরপ্রসারী সুফল-কুফলের কথা কি ভেবে দেখেছেন? দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা কি এই ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও গিলতে চাইবে মনে করেন? সেই দরজির কথা মনে পড়ে গেল, যে কাস্টমারের 'আরেকটু কম কাপড় দিয়ে শার্টটা বানানো যায় না?' এই প্রশ্নের হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতে দিতে একেবারে ছয় ইঞ্চিতে নেমে এসেছিল। শার্ট বানানো হয়ে গেলে ওটা দেখে তো কাস্টমারের চক্ষু ছানাবড়া : এটা কী বানিয়েছেন? এটা তো একটা ছোট পুতুলের শার্ট হয়েছে। জবাবে দরজি বলল : আপনি 'আরেকটু কমান, আরেকটু, আরেকটু করে যেখানে গিয়ে থেমেছেন, সেখানে এই শার্টই হয়েছে। আমি তো ভেবেছি, আপনি পুতুলের শার্টই চাচ্ছেন আপনার মেয়ের খেলাঘরের জন্য।' দোহাই, সেতুটাকে খেলনা সেতু বানিয়ে ফেলবেন না নিজেদের জেদ বা রাগ মেটাতে গিয়ে। উপদেষ্টা বলছেন, সেতু হবে না, সঙ্গে সঙ্গে কবির লড়াইয়ের উতোর-চাপানের মতো যোগাযোগমন্ত্রী বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই হবে, আলবত হবে। এই বিনা টিকিটের লড়াইয়ের দর্শকরা দাঁত কেলিয়ে তালিয়া বাজাচ্ছে, আর বলছে, বাহবা, বাহবা, দেখব কে জেতে?
তবে মাননীয় উপদেষ্টার ১৮ তারিখের ফটক-সম্মেলনের 'গুপ্তচর' সিনড্রমটির আবিষ্কার নিঃসন্দেহে অভিনবত্বের দাবি রাখে। ড. মসিহ চাকরি জীবনে দীর্ঘদিন ই আর ডি সচিব ছিলেন। তিনি তখন বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর হাঁড়ির খবর-নাড়ির খবর জানতেন। হয়তো সেই ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে তথ্যটি এখন জনসমক্ষে ফাঁস করেছেন। প্রসঙ্গটি যে কেবল উত্তেজনাকর তা-ই নয়, গবেষণাধর্মীও বটে। আমার অন্তত জানা ছিল না, বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাগুলো (দূতাবাস নয়। দূতাবাসের কথা তিনিও বলেননি।) একেকটা পেল্লায় সাইজের অফিস খোলা রাখার পাশাপাশি গাঁটের কাঁচা পয়সা খরচ করে স্থানীয় টাউট-বাটপাড়, ছিঁচকে গুপ্তচর ইত্যাদি নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। কী সর্বনাশের কথা! মাননীয় উপদেষ্টা বিষয়টি জানেন, অথচ আমাদের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা বাহিনী, নিজেদের রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় (ডাকনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), পরের রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় (ডাকনাম, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), ই আর ডি (ইকোনমিক রোমিং ডিভিশন বা অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে ঘোরাফেরা ডিভিশন), কেউ কোনো খবরই রাখে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা যখন বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছেন, তখন তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যথাযথ গুরুত্বসহকারে, প্রয়োজনে এফবিআই, ইন্টারপোল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। নইলে দুষ্ট লোকে নানা কথা বলবে : হয়তো বলবে, পুরো ইস্যুটাকে মোচড় মেরে পাবলিকের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার এটা একটা অপচেষ্টা সাবেক ব্যুরোক্র্যাট-কাম-হাফ পলিটিশিয়ান-কাম-হাফ ডিপ্লোম্যাট ড. মসিহ্র। আবার, ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে কাতর কোনো ভাদুরে পাগল হয়তো বলতে পারে, বেলা পৌনে ১২টার সময় এত সিরিয়াস বিষয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলতে হলে এ রকম ডেলিরিয়াম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আবারও বলি, আমি কিন্তু ড. মসিহ্র মতো একজন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ, সর্বোপরি পণ্ডিত ব্যক্তির কথাটিকে বাত-কি-বাত মনে করছি না।
সবচেয়ে খারাপ লেগেছে, ড. মসিহ_যিনি সিভিল সার্ভিসে আমার এককালের অত্যন্ত প্রীতিভাজন, প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিত সহকর্মী ছিলেন_তাঁর শারীরিক সমস্যার কথা জেনে। সারা জীবন নানাবিধ দায়িত্ব পালন করে, আমি মনে করি, তিনি ভালো করেই জানেন কিভাবে এসব টেনশন মোকাবিলা করতে হয়। তিনি হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা করবেন কেন? তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পটিকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবেন, দেশবাসী তাঁকে ধন্য ধন্য করবে, তিনি কেন সাংবাদিকদের বলবেন, আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন। কোনো অন্যায় না করে থাকলে, কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে থাকলে কিসের টেনশন? কিসের পদত্যাগ? কিসের ছুটি? সাহস রাখুন বুকে, আর যদি বিবেক পরিষ্কার থাকে, তবে এগিয়ে যান মাথা উঁচু করে। পারবেন?
পাদটীকা : ড. মসিহ্, আপনি বলেছেন, 'আমার জীবনটাকে গুলাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' আমার প্রশ্ন (উইথ অ্যাপোলজি) আপনাদের সবার কাছে, পজিশন-অপজিশন যে যেখানে আছেন, সবার কাছে, 'গুলাগে কেন?'
১৯.৯.১২
mkarim06@yahoo.com
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে তো ম্যালাই কথাবার্তা হলো, এখনো হচ্ছে, এত কথাবার্তা, এত নাটকের পর আমার তো মনে হয়, দুঃখে-ক্ষোভে-লজ্জায় পদ্মা বিবি না আবার সুইসাইড 'খেয়ে' বসে। পদ্মা বিবিও ভাবতে পারে, আমাকে নিয়ে যখন এত কথা, তখন আমি আমার এই জীবন আর রাখব না। আর ইতিমধ্যে মৃতপ্রায় শীর্ণকায় পদ্মা যদি সত্যি মরে যায় তাহলে তার ধু ধু বালুচরের ওপর দিয়ে হেঁটেই 'পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি' (গরুর গাড়ি, পাজেরো, রেলগাড়ি ইত্যাদি সব) অবস্থা হয়ে যাবে, বিশ্বব্যাংককে তখন আমরা মুনশিগঞ্জ/নরসিংদীর একটা বিশাল সাগরকলা দেখাতে পারব। কাউকে আর গুলাগে পাঠাতে হবে না, হার্টফেলও করতে হবে না কিংবা কাউকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে বাড়ি যেতে হবে না।
আবার গুলাগ! শব্দটা যখন এসেই গেল তখন ১৮ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তাঁর বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ফটক নয়, ফাটকটির কথা সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেছেন তার কথাটি স্মরণ করিয়ে দিই। জানি না পৃথিবীতে এত ভয়াবহ সব কারাগার_যেমন আগের আমলের আন্দামান, হাল আমলের গুয়ানতানামো ইত্যাদি থাকতে হঠাৎ গুলাগ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি কারাগার, যেখানে সাধারণ অপরাধীসহ রাজবন্দিদের নির্বাসন দেওয়া হতো) নামটা কেন মনে পড়ল তাঁর। অবচেতনে অন্য কিছু মনে পড়ে যায়নি তো? তিনি বলেছেন, 'আমার জীবনটাকে গুলাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' আমরা যারা এই নাটকের প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্য থেকে দর্শকের সারিতে বসে আছি, তারা জানি কারা তাঁকে ওই নির্বাসনে পাঠানোর পাঁয়তারা করছে। নিশ্চয়ই এ দেশের আমজনতা নয়, বিরোধী দল নয়, তাঁরই সমগোত্রীয়রা, যাদের ওপর রাগ করে তিনি ক্যাবিনেট মিটিং পর্যন্ত বর্জন করছেন। কিন্তু এত জায়গা থাকতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে ওখানে পাঠাতে গেলেন কেন? এটা ভারি অন্যায়! ড. মসিউর রহমানকে যা করা হয়েছে, ইংরেজিতে তাকে বলা হয় 'ডিচ্' করা। হি হ্যাজ বিন ডিচড্ বাই হিজ প্যালস। তাঁর দোস্তরা তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। ইংরেজি সংবাদপত্রের শিরোনাম এটাও হতে পারে : 'ড. মসিহ লেফট ইন দ্য কোল্ড'। ইংরেজি হচ্ছে ঠাণ্ডা বরফের দেশের ভাষা। মাইনাস ৫-৭ ডিগ্রিতে বিলেতের বা আমেরিকার হাইওয়েতে রাতের বেলা কাউকে ফেলে রেখে যাওয়াটা যে কী, তা ওসব দেশের লোকেরা হাড়ে হাড়ে (শব্দার্থে) বোঝে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই এই বাগধারাটির উৎপত্তি। আমাদের দেশে এত ঠাণ্ডা নেই, আছে নিদাঘের জ্বলুনি, যার দহনে, বোধ করি, ড. মসিহ এখন জ্বলেপুড়ে মরছেন। আল্লাহ তাঁকে শান্তি দিন।
তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, ড. মসিহ যেখানে আগাগোড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যাচ্ছেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে তিনি কোনো প্রকার দুর্নীতিতে জড়িত নন, বিশ্বব্যাংক বা আর কারো কাছে কোনো প্রমাণ থাকলে আসুক, জনসমক্ষে সেগুলো পেশ করুক, তিনি তদ্দণ্ডেই নির্বাসনে নয়, একেবারে বনবাসে চলে যাবেন, তাঁর রক্ত দিলে (আল্লাহ মাফ করুক) যদি পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে যায়, তবে তিনি তা-ও দিতে প্রস্তুত আছেন, সেখানে সবাই একযোগে তাঁকে এ রকম মুষ্টাঘাত করা কি ঠিক হচ্ছে? তিনি যে ইতিমধ্যেই ম্যাটের ওপর বসে পড়ে নাকমুখের রক্তক্ষরণ সামলানোর চেষ্টা করছেন, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তার পরও আবার এই 'হুক', 'জ্যাব', 'পাঞ্চ' ইত্যাদির মুষলবর্ষণ কেন? আর 'রেফারিই' বা কী করছেন? তিনি তো খেলোয়াড়ের এই নাজুক হালত দেখতেই পাচ্ছেন, খেলার নিয়মকানুনও তাঁর মুখস্থ, তিনি কেন এগিয়ে এসে হয় ১০ পর্যন্ত গুনতে শুরু করছেন না, অথবা প্রতিপক্ষকে নিরস্ত করছেন না? (নাহ্, এদের কারো গায়ে-গতরে দেখছি একটুও দয়ামায়া নেই!)। শোনা যায়, রেফারি (আম্পায়ার) সিদ্ধান্তের জন্য নাকি বিষয়টি ওয়াশিংটনস্থ থার্ড আম্পায়ারের কাছে 'রেফার' করেছেন। দরকার ছিল কি? এরপর তো থার্ড আম্পায়ারের ঘুম হারাম হয়ে যাবে, বাংলাদেশ_এবং এ ধরনের 'ঠেলি খেলো, ফাউল নাই' মার্কা বিশ্বের তাবত ভেন্যু_থেকে রেফার করার হিড়িক পড়ে যাবে। যা হোক, দেখা যাক, টিভি ক্যামেরা কী বলে।
তবু আমি আবারও জোর দিয়ে বলব যতক্ষণ না একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ_তা খুনেরই হোক আর পাঁচ টাকার নুনেরই হোক_আইনের ভাষায় 'বিঅন্ড্ অল আয়োটা অব ডাউট' প্রমাণিত না হয়েছে, ততক্ষণ তাকে 'তুই চোর'-'তুই চোর' বলা যাবে না। সব দেশে এতদসংক্রান্ত প্রিসাম্্প্শন অব ল অত্যন্ত পরিষ্কার : একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়ে সেই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে তিনি নির্দোষ।
ফটক-সম্মেলনে (এবার কিন্তু ফাটক নয়, ফটক) ড. মসিহ একটি যুগান্তকারী ঘোষণা ও একটি পিলে চমকানো তথ্য দিয়েছেন। ঘোষণাটি (মন্তব্যও বলতে পারেন) হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের টাকায় বর্তমান সরকারের আমলে পদ্মা সেতু হবে না। তিনি নাকি সব নথিপত্র ঘেঁটে-ঘুঁটে এই ধারণা লাভ করেছেন। শুনে একজন পাঠক হাসবেন না কাঁদবেন, নাকি তাঁরও ড. মসিহ্র মতো হার্ট অ্যাটাক করার ভয় ঢুকতে পারে, বুঝতে পারছি না। তবে এত বড় একটা বমশেল যেভাবে তিনি ফাটালেন, তা যদি সত্যি হয় তা হলে তো ড. মসিহ্দের খুলনার ভাষায় বলতে হয় : তা হলি আর বসি আছেন কেন? খেইল খতম, পয়সা হজম। এবার মানে মানে বাড়ি চলি যাতি পারেন। তবে দোহাই আপনাদের, ওই 'ছোট করে', 'নিজের পয়সায়', 'দেশবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তুলে' (লক্ষ করুন, শেয়ার লুটেরা, হলমার্ক-ডেসটিনিওয়ালাদের কথা বলা হচ্ছে না। হয়তো ভাবা হচ্ছে, ওগুলো হারাম পয়সা, ওগুলো দিয়ে ব্রিজ বানালে দুদিনেই ভেঙে পড়বে।), কিংবা চড়া সুদে মালয়েশিয়ার টাকায় ব্রিজ আমরা বানাতে পারি, বানিয়ে ছাড়ব_এসব কথা বলবেন না। দেশবাসীকে মুলা দেখিয়েছেন, আরো দেখান, ওটা দেখতে পয়সা লাগবে না; কিন্তু তাদের নাক-মুখে রক্ত ছোটে অমন কিছু করবেন না। আর রেলপথ বাদ দিয়ে শুধু যে সড়ক-সেতুর কথা বলছেন, তার সুদূরপ্রসারী সুফল-কুফলের কথা কি ভেবে দেখেছেন? দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা কি এই ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও গিলতে চাইবে মনে করেন? সেই দরজির কথা মনে পড়ে গেল, যে কাস্টমারের 'আরেকটু কম কাপড় দিয়ে শার্টটা বানানো যায় না?' এই প্রশ্নের হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতে দিতে একেবারে ছয় ইঞ্চিতে নেমে এসেছিল। শার্ট বানানো হয়ে গেলে ওটা দেখে তো কাস্টমারের চক্ষু ছানাবড়া : এটা কী বানিয়েছেন? এটা তো একটা ছোট পুতুলের শার্ট হয়েছে। জবাবে দরজি বলল : আপনি 'আরেকটু কমান, আরেকটু, আরেকটু করে যেখানে গিয়ে থেমেছেন, সেখানে এই শার্টই হয়েছে। আমি তো ভেবেছি, আপনি পুতুলের শার্টই চাচ্ছেন আপনার মেয়ের খেলাঘরের জন্য।' দোহাই, সেতুটাকে খেলনা সেতু বানিয়ে ফেলবেন না নিজেদের জেদ বা রাগ মেটাতে গিয়ে। উপদেষ্টা বলছেন, সেতু হবে না, সঙ্গে সঙ্গে কবির লড়াইয়ের উতোর-চাপানের মতো যোগাযোগমন্ত্রী বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই হবে, আলবত হবে। এই বিনা টিকিটের লড়াইয়ের দর্শকরা দাঁত কেলিয়ে তালিয়া বাজাচ্ছে, আর বলছে, বাহবা, বাহবা, দেখব কে জেতে?
তবে মাননীয় উপদেষ্টার ১৮ তারিখের ফটক-সম্মেলনের 'গুপ্তচর' সিনড্রমটির আবিষ্কার নিঃসন্দেহে অভিনবত্বের দাবি রাখে। ড. মসিহ চাকরি জীবনে দীর্ঘদিন ই আর ডি সচিব ছিলেন। তিনি তখন বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর হাঁড়ির খবর-নাড়ির খবর জানতেন। হয়তো সেই ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে তথ্যটি এখন জনসমক্ষে ফাঁস করেছেন। প্রসঙ্গটি যে কেবল উত্তেজনাকর তা-ই নয়, গবেষণাধর্মীও বটে। আমার অন্তত জানা ছিল না, বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থাগুলো (দূতাবাস নয়। দূতাবাসের কথা তিনিও বলেননি।) একেকটা পেল্লায় সাইজের অফিস খোলা রাখার পাশাপাশি গাঁটের কাঁচা পয়সা খরচ করে স্থানীয় টাউট-বাটপাড়, ছিঁচকে গুপ্তচর ইত্যাদি নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। কী সর্বনাশের কথা! মাননীয় উপদেষ্টা বিষয়টি জানেন, অথচ আমাদের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা বাহিনী, নিজেদের রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় (ডাকনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), পরের রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয় (ডাকনাম, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), ই আর ডি (ইকোনমিক রোমিং ডিভিশন বা অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে ঘোরাফেরা ডিভিশন), কেউ কোনো খবরই রাখে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা যখন বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছেন, তখন তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যথাযথ গুরুত্বসহকারে, প্রয়োজনে এফবিআই, ইন্টারপোল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। নইলে দুষ্ট লোকে নানা কথা বলবে : হয়তো বলবে, পুরো ইস্যুটাকে মোচড় মেরে পাবলিকের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার এটা একটা অপচেষ্টা সাবেক ব্যুরোক্র্যাট-কাম-হাফ পলিটিশিয়ান-কাম-হাফ ডিপ্লোম্যাট ড. মসিহ্র। আবার, ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে কাতর কোনো ভাদুরে পাগল হয়তো বলতে পারে, বেলা পৌনে ১২টার সময় এত সিরিয়াস বিষয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলতে হলে এ রকম ডেলিরিয়াম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আবারও বলি, আমি কিন্তু ড. মসিহ্র মতো একজন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ, সর্বোপরি পণ্ডিত ব্যক্তির কথাটিকে বাত-কি-বাত মনে করছি না।
সবচেয়ে খারাপ লেগেছে, ড. মসিহ_যিনি সিভিল সার্ভিসে আমার এককালের অত্যন্ত প্রীতিভাজন, প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিত সহকর্মী ছিলেন_তাঁর শারীরিক সমস্যার কথা জেনে। সারা জীবন নানাবিধ দায়িত্ব পালন করে, আমি মনে করি, তিনি ভালো করেই জানেন কিভাবে এসব টেনশন মোকাবিলা করতে হয়। তিনি হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা করবেন কেন? তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পটিকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবেন, দেশবাসী তাঁকে ধন্য ধন্য করবে, তিনি কেন সাংবাদিকদের বলবেন, আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন। কোনো অন্যায় না করে থাকলে, কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে থাকলে কিসের টেনশন? কিসের পদত্যাগ? কিসের ছুটি? সাহস রাখুন বুকে, আর যদি বিবেক পরিষ্কার থাকে, তবে এগিয়ে যান মাথা উঁচু করে। পারবেন?
পাদটীকা : ড. মসিহ্, আপনি বলেছেন, 'আমার জীবনটাকে গুলাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' আমার প্রশ্ন (উইথ অ্যাপোলজি) আপনাদের সবার কাছে, পজিশন-অপজিশন যে যেখানে আছেন, সবার কাছে, 'গুলাগে কেন?'
১৯.৯.১২
mkarim06@yahoo.com
No comments