ভারত-তৃণমূল কংগ্রেস (মার্কসিস্ট)! by সুব্রত নাগ চৌধুরী
স্বভাবসুলভ স্বরগ্রাম উচ্চকিত করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন তিনি ইউপিএ (কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট_ ইউনাইটেড পিপলস এলায়েন্স) সরকারে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। তৃণমূল কংগ্রেস এ সরকারে ছিল তিন বছর।
এ কাজ করে তিনি হয়তো লড়াকু হিসেবে তার ইমেজটা ঝালিয়ে নিলেন; কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়ে গেল যে, খুব জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় তিনি বাস্তবতাবাদী না থেকে জনপ্রিয় ভাবমূর্তির দিকেই হেলে পড়েন। অন্যদিকে ইউপিএ-টু সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে তিনি যে অবস্থানে পেঁৗছালেন তাতে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সম্প্রসারিত হওয়ার বদলে সংকুচিত হয়ে গেল। এমন এক রাজনৈতিক পাটাতনে দাঁড়ালেন যেখানে একই সঙ্গে তিনি সংগ্রামী ও শাসক_ এই অবস্থানই নির্ধারণ করে দিচ্ছে তার অননুমেয় রাজনীতিকে।
মঙ্গলবার ঘোষণাটি দিয়েই মমতা দুটি জরুরি বিষয়ে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এক. তার মন্ত্রীরা শুক্রবার বাদ জুমা পদত্যাগপত্র দেবেন। দুই. বাম ও বিজেপি সমর্থিত ২০ তারিখের বন্ধে তৃণমূল অংশ নেবে না। যদিও তিনি যে কারণে সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছেন একই কারণ বন্ধের পেছনেও উলি্লখিত হয়েছে। অর্থটা পরিষ্কার, মমতা বাম বা বিজেপি কোনো বন্ধনীতেই চিহ্নিত হতে চাইছেন না। অন্যদিকে শুক্রবার বাদ জুমার উল্লেখ করে তিনি তার ভোটারদের বড় অংশ মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। এ ভোটারদের তিনি কংগ্রেস থেকে ভাগিয়ে এনেছেন। ২০১৪-এর প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের তরফে বিজেপি ও তার জোটের সঙ্গে কোনো গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতি ও নীতির ক্ষেত্রে গভীর অনৈক্যের প্রেক্ষাপটে ইউপিএ-থ্রি বলে যদি কোনো জোটের কথা ভাবা হয় তাতেও তার অংশীদারিত্বে সুযোগ নেই। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩০ থেকে ৩৫ আসন লাভের আশা করে আর এই এমপিদের ভূমিকা বোধকরি তৃতীয় বিকল্পের জন্যই বরাদ্দ থাকবে।
পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে মমতার পদক্ষেপ সিপিএমের পালে যতটুকু বাতাস ছিল তাও সরিয়ে নিয়েছে। বাংলা ও বাংলার বাইরের কমিউনিস্টরা কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন যেন কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়; আর তাতে করে তারা ফাড়া কাটিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু যে ইস্যুতে তৃণমূল সরকার ত্যাগ করল সেগুলো জনসম্পৃক্ত এবং মানুষকে উদ্দীপ্ত করার মতো। অন্যদিকে বামরা পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকার ছেড়েছিল গতবার, সে ইস্যু মানুষকে ততটা নাড়া দেয়নি। এই সিদ্ধান্ত, বামদের রাজনৈতিক পরিসরকে আরও সংকুচিত করে ফেলবে। বাংলায় দিদি বামদের সমর্থন-ভিত্তি ক্রমাগত লোপ করে দিয়ে চলেছেন। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের দিন থেকে তৃণমূল কমিউনিস্ট সমর্থকদের নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে, শুধু বাংলাতেই নয়_ দিলি্লতেও। মমতার 'ঐতিহাসিক' সিদ্ধান্তের পর তাই বামদের তরফে পাওয়া গেছে মনমরা ও বিমর্ষ প্রতিক্রিয়া। সিপিএমের সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, 'আমরা কী করে তার প্রশংসা না করে থাকব? কেননা আমরা যে ইস্যুতে লড়ছি সেই একই ইস্যুতে তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। হয়তো এখন সেই সময়, যখন তৃণমূল ও কমিউনিস্টদের একত্রে রাস্তায় নামতে হবে, সাধারণ এজেন্ডা নিয়ে হাতে হাত রেখে লড়াই করতে হবে।' বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, ছোট একটি মহলে তৃণমূল কংগ্রেস মার্কসিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সিপিআই, আরএসপি, এফবির মতো বাম জোটের ছোট শরিকরা প্রকাশ্যেই তৃণমূল সম্পর্কে নতুন মূল্যায়নের কথা ভাবছেন।
ইউপিএ-টু থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনকালে তার দলের ম্যানিফেস্টোতেই প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তৃণমূলের ভেতরে একটা ক্রমবর্ধমান মনোভাব সক্রিয় যে, এই মেনিফেস্টো যতটা বিরোধী একটি দলকে মানায় ততটা শাসক দলকে মানায় না। বস্তুত এই মেনিফেস্টোতেই অনেক বিষয়ের উল্লেখ আছে, যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিভিন্ন সেক্টরে সিদ্ধান্ত নিতে ও অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্ত করেছে। বর্তমানের ভূমি অধিগ্রহণ নীতি শিল্পায়নের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও রক্ষণশীল জমি অধিগ্রহণ নীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি সাহায্যদাতা প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য নেওয়াও বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। তৃণমূল ব্যবহারকারীদের ওপর ফি চাপাতে চায় না। অভ্যন্তরীণ শিল্পগুলোর দিক থেকে শহরাঞ্চলে জমির অধিকারের সীমা নির্ধারক আইন সংশোধনের দাবি আছে। ইতিমধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য ইনফোসিস যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা থমকে আছে। অথচ চাকরি তৈরির ক্ষেত্রে ইনফোসিসের বিপুল সম্ভাবনা ছিল। এই সমস্যা হলো তৃণমূলের মেনিফেস্টো থেকেই উদ্ভাসিত। পার্টির ভেতরে অনেকেই মনে করেন, অবিলম্বে মেনিফেস্টো সংশোধিত হওয়া দরকার কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব কাগজে-কলমে যা আছে তাই মেনে চলেছেন।
গরিবদের উপকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয় এই সদিচ্ছা বাস্তব অতিক্রম করে চলেছে। রেলের ভাড়া বাড়ানোর বেলায় তার প্রতিবাদের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। কলকাতায় অনির্দিষ্টকালের গণপরিবহন ধর্মঘট নিয়মিত যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যাত্রীদের বড় একটি অংশ তেলের বাড়তি দামের ব্যাপারে রাজি ছিলেন। কিন্তু সরকার বেঁকে বসল আর ধর্মঘটে উৎসাহ জোগাল। মমতার গরিবপন্থি এজেন্ডা তাকে মানুষের কাছে পেঁৗছাতে সহায়তা করে; কিন্তু অনেক সময় বুঝতেও দেয় না তিনি যে নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে চান তা বাস্তবায়নের উপায় তার হাতে নেই।
সুব্রত নাগ চৌধুরী : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের
কলকাতা সম্পাদক
ভাষান্তর :মাহবুব মোর্শেদ
মঙ্গলবার ঘোষণাটি দিয়েই মমতা দুটি জরুরি বিষয়ে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এক. তার মন্ত্রীরা শুক্রবার বাদ জুমা পদত্যাগপত্র দেবেন। দুই. বাম ও বিজেপি সমর্থিত ২০ তারিখের বন্ধে তৃণমূল অংশ নেবে না। যদিও তিনি যে কারণে সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছেন একই কারণ বন্ধের পেছনেও উলি্লখিত হয়েছে। অর্থটা পরিষ্কার, মমতা বাম বা বিজেপি কোনো বন্ধনীতেই চিহ্নিত হতে চাইছেন না। অন্যদিকে শুক্রবার বাদ জুমার উল্লেখ করে তিনি তার ভোটারদের বড় অংশ মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন। এ ভোটারদের তিনি কংগ্রেস থেকে ভাগিয়ে এনেছেন। ২০১৪-এর প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের তরফে বিজেপি ও তার জোটের সঙ্গে কোনো গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতি ও নীতির ক্ষেত্রে গভীর অনৈক্যের প্রেক্ষাপটে ইউপিএ-থ্রি বলে যদি কোনো জোটের কথা ভাবা হয় তাতেও তার অংশীদারিত্বে সুযোগ নেই। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৩০ থেকে ৩৫ আসন লাভের আশা করে আর এই এমপিদের ভূমিকা বোধকরি তৃতীয় বিকল্পের জন্যই বরাদ্দ থাকবে।
পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে মমতার পদক্ষেপ সিপিএমের পালে যতটুকু বাতাস ছিল তাও সরিয়ে নিয়েছে। বাংলা ও বাংলার বাইরের কমিউনিস্টরা কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন যেন কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়; আর তাতে করে তারা ফাড়া কাটিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু যে ইস্যুতে তৃণমূল সরকার ত্যাগ করল সেগুলো জনসম্পৃক্ত এবং মানুষকে উদ্দীপ্ত করার মতো। অন্যদিকে বামরা পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকার ছেড়েছিল গতবার, সে ইস্যু মানুষকে ততটা নাড়া দেয়নি। এই সিদ্ধান্ত, বামদের রাজনৈতিক পরিসরকে আরও সংকুচিত করে ফেলবে। বাংলায় দিদি বামদের সমর্থন-ভিত্তি ক্রমাগত লোপ করে দিয়ে চলেছেন। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের দিন থেকে তৃণমূল কমিউনিস্ট সমর্থকদের নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে, শুধু বাংলাতেই নয়_ দিলি্লতেও। মমতার 'ঐতিহাসিক' সিদ্ধান্তের পর তাই বামদের তরফে পাওয়া গেছে মনমরা ও বিমর্ষ প্রতিক্রিয়া। সিপিএমের সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, 'আমরা কী করে তার প্রশংসা না করে থাকব? কেননা আমরা যে ইস্যুতে লড়ছি সেই একই ইস্যুতে তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। হয়তো এখন সেই সময়, যখন তৃণমূল ও কমিউনিস্টদের একত্রে রাস্তায় নামতে হবে, সাধারণ এজেন্ডা নিয়ে হাতে হাত রেখে লড়াই করতে হবে।' বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, ছোট একটি মহলে তৃণমূল কংগ্রেস মার্কসিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সিপিআই, আরএসপি, এফবির মতো বাম জোটের ছোট শরিকরা প্রকাশ্যেই তৃণমূল সম্পর্কে নতুন মূল্যায়নের কথা ভাবছেন।
ইউপিএ-টু থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনকালে তার দলের ম্যানিফেস্টোতেই প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তৃণমূলের ভেতরে একটা ক্রমবর্ধমান মনোভাব সক্রিয় যে, এই মেনিফেস্টো যতটা বিরোধী একটি দলকে মানায় ততটা শাসক দলকে মানায় না। বস্তুত এই মেনিফেস্টোতেই অনেক বিষয়ের উল্লেখ আছে, যা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিভিন্ন সেক্টরে সিদ্ধান্ত নিতে ও অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্ত করেছে। বর্তমানের ভূমি অধিগ্রহণ নীতি শিল্পায়নের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও রক্ষণশীল জমি অধিগ্রহণ নীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি সাহায্যদাতা প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য নেওয়াও বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। তৃণমূল ব্যবহারকারীদের ওপর ফি চাপাতে চায় না। অভ্যন্তরীণ শিল্পগুলোর দিক থেকে শহরাঞ্চলে জমির অধিকারের সীমা নির্ধারক আইন সংশোধনের দাবি আছে। ইতিমধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য ইনফোসিস যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা থমকে আছে। অথচ চাকরি তৈরির ক্ষেত্রে ইনফোসিসের বিপুল সম্ভাবনা ছিল। এই সমস্যা হলো তৃণমূলের মেনিফেস্টো থেকেই উদ্ভাসিত। পার্টির ভেতরে অনেকেই মনে করেন, অবিলম্বে মেনিফেস্টো সংশোধিত হওয়া দরকার কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব কাগজে-কলমে যা আছে তাই মেনে চলেছেন।
গরিবদের উপকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয় এই সদিচ্ছা বাস্তব অতিক্রম করে চলেছে। রেলের ভাড়া বাড়ানোর বেলায় তার প্রতিবাদের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। কলকাতায় অনির্দিষ্টকালের গণপরিবহন ধর্মঘট নিয়মিত যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যাত্রীদের বড় একটি অংশ তেলের বাড়তি দামের ব্যাপারে রাজি ছিলেন। কিন্তু সরকার বেঁকে বসল আর ধর্মঘটে উৎসাহ জোগাল। মমতার গরিবপন্থি এজেন্ডা তাকে মানুষের কাছে পেঁৗছাতে সহায়তা করে; কিন্তু অনেক সময় বুঝতেও দেয় না তিনি যে নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে চান তা বাস্তবায়নের উপায় তার হাতে নেই।
সুব্রত নাগ চৌধুরী : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের
কলকাতা সম্পাদক
ভাষান্তর :মাহবুব মোর্শেদ
No comments