রূপালি ইলিশের ডাক by সোহেল নওরোজ
বহির্বিশ্বে উন্নয়নশীল একটা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো যে কয়টা হাতেগোনা উপাদান আমাদের রয়েছে, তার মধ্যে ইলিশ অন্যতম। কিন্তু সেই ইলিশ দামে ও প্রতুলতায় ক্রমশ আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ খুব বেশি দিন নয়; ইলিশের মৌসুমে বাজারে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যেত।
মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তও এই মাছ কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরত।
একটি ইলিশ মাছ তার জীবদ্দশায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নদীতে ঢোকে। আর প্রজনন মৌসুমে ৫০-১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে মাছ যত উজানের দিকে ছুটতে থাকে, ততই তার শরীর থেকে লবণ, আয়োডিনসহ কিছু খনিজ ঝরে যায়। এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যই নদীর ইলিশের এত ঘ্রাণ এবং স্বাদ। মূলত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী অববাহিকা হচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশের বিচরণস্থল। এ ছাড়া রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার অববাহিকা। পদ্মা ও মেঘনা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে ইলিশের রয়েছে অভয়াশ্রম। এসব অভয়াশ্রমে এসেই ইলিশ ডিম ছাড়ে। আশ্বিনের পূর্ণিমার রাতে ডিম ছাড়ার কারণেই ৬ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় কারেন্ট জালসহ যে কোনো মশারি জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। একটি ডিম থেকে যেখানে এক লাখ ইলিশ হওয়া সম্ভব, সেখানে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরার প্রতিযোগিতায় নামে জেলেরা। মৎস্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন জাটকা ধরা পড়ে। এর ২০ ভাগ জাটকাও যদি রক্ষা পেত, তাহলে অতিরিক্ত সাতশ' ভাগ ইলিশ এই ভরা মৌসুমে শিকার করা সম্ভব হতো। আর নিধনকৃত জাটকার পুরোটাই যদি রক্ষা করা সম্ভব হতো, তাহলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বিপুল পরিমাণে ইলিশ রফতানি করা যেত।
বিদ্যমান আইন ও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা নিধনের ফলে ইলিশের প্রাপ্যতা কমছে; অন্যদিকে সাগর, নদীর মোহনা ও নদীতে ধৃত ইলিশ ভারতে পাচার হওয়ার দরুন অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ছে। আহরণক্ষেত্র থেকেই ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভারতীয় ফিশিং ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের সময় বাংলাদেশি নাম ধারণ করছে। আবার ইলিশ নিয়ে ভারতের জলসীমায় পেঁৗছে ট্রলারের নাম পাল্টে ফেলছে! বিভিন্ন মোকামের অসৎ ব্যবসায়ীরা ইলিশ পাচারে ভারতীয়দের সহযোগিতা করছে। ফলে ইলিশ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা থামানো যাচ্ছে না। রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর কয়েক দিন ইলিশের দাম কিছুটা কম ছিল। চোরাচালানের কারণে ফের মূল্য বেড়ে গেছে।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম হওয়ায় ইলিশের অগি্নমূল্য। রাজধানীর বাজারে সবচেয়ে বড় আকারের ইলিশের হালি ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিকোচ্ছে। মেগাশপগুলোতে রীতিমতো মৎস্য উৎসবের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে সাতশ' থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে (আকর্ষণীয় মূল্য!) ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ কেবল আমাদের জাতীয় মাছ-ই নয়; জীববৈচিত্র্যের আলোকে অভিপ্রয়াণশীল এ মাছের গুরুত্ব অসীম। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট মাছের ১১ শতাংশের বেশি আসে শুধু ইলিশ থেকে। প্রাণিজ আমিষের ১৬ ভাগ জোগান দেয় এ মাছ। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ইলিশ অভয়াশ্রমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ইলিশ আহরণনির্ভর জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও বর্ধিত ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় এনে বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন নির্বিঘ্ন করা প্রয়োজন। ইলিশ গভীর জলে থাকে। ইলিশের বংশ সংরক্ষণে তাই উজানের নদীগুলোর সঠিক নাব্যতা বজায় রাখার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের রসনাতৃপ্তির এক বড় উপাদান ইলিশ মাছের প্রাচুর্য নিশ্চিত করা গেলে জাতিগত অহমিকা রূপালি ইলিশের মতোই জ্বলজ্বল করবে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
snawroz.bau@gmail.com
একটি ইলিশ মাছ তার জীবদ্দশায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নদীতে ঢোকে। আর প্রজনন মৌসুমে ৫০-১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে মাছ যত উজানের দিকে ছুটতে থাকে, ততই তার শরীর থেকে লবণ, আয়োডিনসহ কিছু খনিজ ঝরে যায়। এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যই নদীর ইলিশের এত ঘ্রাণ এবং স্বাদ। মূলত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী অববাহিকা হচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশের বিচরণস্থল। এ ছাড়া রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার অববাহিকা। পদ্মা ও মেঘনা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে ইলিশের রয়েছে অভয়াশ্রম। এসব অভয়াশ্রমে এসেই ইলিশ ডিম ছাড়ে। আশ্বিনের পূর্ণিমার রাতে ডিম ছাড়ার কারণেই ৬ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় কারেন্ট জালসহ যে কোনো মশারি জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। একটি ডিম থেকে যেখানে এক লাখ ইলিশ হওয়া সম্ভব, সেখানে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরার প্রতিযোগিতায় নামে জেলেরা। মৎস্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টন জাটকা ধরা পড়ে। এর ২০ ভাগ জাটকাও যদি রক্ষা পেত, তাহলে অতিরিক্ত সাতশ' ভাগ ইলিশ এই ভরা মৌসুমে শিকার করা সম্ভব হতো। আর নিধনকৃত জাটকার পুরোটাই যদি রক্ষা করা সম্ভব হতো, তাহলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বিপুল পরিমাণে ইলিশ রফতানি করা যেত।
বিদ্যমান আইন ও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা নিধনের ফলে ইলিশের প্রাপ্যতা কমছে; অন্যদিকে সাগর, নদীর মোহনা ও নদীতে ধৃত ইলিশ ভারতে পাচার হওয়ার দরুন অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ছে। আহরণক্ষেত্র থেকেই ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভারতীয় ফিশিং ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের সময় বাংলাদেশি নাম ধারণ করছে। আবার ইলিশ নিয়ে ভারতের জলসীমায় পেঁৗছে ট্রলারের নাম পাল্টে ফেলছে! বিভিন্ন মোকামের অসৎ ব্যবসায়ীরা ইলিশ পাচারে ভারতীয়দের সহযোগিতা করছে। ফলে ইলিশ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা থামানো যাচ্ছে না। রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর কয়েক দিন ইলিশের দাম কিছুটা কম ছিল। চোরাচালানের কারণে ফের মূল্য বেড়ে গেছে।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম হওয়ায় ইলিশের অগি্নমূল্য। রাজধানীর বাজারে সবচেয়ে বড় আকারের ইলিশের হালি ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিকোচ্ছে। মেগাশপগুলোতে রীতিমতো মৎস্য উৎসবের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে সাতশ' থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে (আকর্ষণীয় মূল্য!) ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ কেবল আমাদের জাতীয় মাছ-ই নয়; জীববৈচিত্র্যের আলোকে অভিপ্রয়াণশীল এ মাছের গুরুত্ব অসীম। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট মাছের ১১ শতাংশের বেশি আসে শুধু ইলিশ থেকে। প্রাণিজ আমিষের ১৬ ভাগ জোগান দেয় এ মাছ। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ইলিশ অভয়াশ্রমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ইলিশ আহরণনির্ভর জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও বর্ধিত ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় এনে বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশের অবাধ বিচরণ ও প্রজনন নির্বিঘ্ন করা প্রয়োজন। ইলিশ গভীর জলে থাকে। ইলিশের বংশ সংরক্ষণে তাই উজানের নদীগুলোর সঠিক নাব্যতা বজায় রাখার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের রসনাতৃপ্তির এক বড় উপাদান ইলিশ মাছের প্রাচুর্য নিশ্চিত করা গেলে জাতিগত অহমিকা রূপালি ইলিশের মতোই জ্বলজ্বল করবে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
snawroz.bau@gmail.com
No comments