কালের পুরাণ-দিনবদলের সাংসদ! by সোহরাব হাসান

ওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ ঘোষণা করেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে। আজ ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি।
আওয়ামী লীগ তার দিনবদলের সনদে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে আনার কথা বলেছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিল। দারিদ্র্য মুক্তি ও বৈষম্য প্রতিরোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। আওয়ামী লীগ গত তিন বছরে সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলেও


দলের গুণধর সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার বুধবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনন্য নজির দেখিয়েছেন এক নারী সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে। ওই সাংবাদিকের অপরাধ, তিনি মিরপুরের মনিপুর স্কুলে ছাত্রভর্তির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন না যে ওই স্কুল বা এলাকাটি কামাল মজুমদারের জমিদারি। তাঁর অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরি করতে আরটিভির সাংবাদিক অপর্ণা সিংহ, জ্যেষ্ঠ ক্যামেরাম্যান সাইদ হায়দার ও স্থানীয় প্রতিনিধি ওসমান গণি ওই স্কুলে যান। অভিযোগের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে তাঁরা স্কুলে ঢুকতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। প্রথমে নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে তাঁদের বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ভেতরে ঢুকলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক হাত দিয়ে ক্যামেরা সরিয়ে দেন এবং তাঁদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রধান ফটকের বাইরে বের করে দেন।
এর কিছুক্ষণ পরই কিছু যুবকসহ প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হন স্থানীয় সাংসদ ও স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি কামাল আহমেদ মজুমদার।
গাড়ি থেকে নেমেই কামাল মজুমদার ও তাঁর সঙ্গে থাকা যুবকেরা তেড়ে এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে গালাগাল শুরু করেন। একপর্যায়ে কামাল মজুমদার নিজেই সাংবাদিক অপর্ণার হাতে মোচড় দিয়ে বুম (শব্দধারক) কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলেন। এতে হাতে গুরুতর আঘাত পান অপর্ণা। খবর পেয়ে অপর একটি চ্যানেলের নারী সাংবাদিকসহ দুই সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাঁদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন সাংসদ।’ (প্রথম আলো ৪ জানুয়ারি ২০১২)।
এই হলেন দিনবদলের সাংসদ। তিনি মানুষের কল্যাণে কিছু করতে না পারলেও সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করতে খুবই পারঙ্গম। কামাল মজুমদার সাংবাদিক লাঞ্ছিত করার কথা অস্বীকার করেছেন। যুদ্ধাপরাধী বা খুনের মামলার আসামিও দায় স্বীকার করেন না। কিন্তু ছবি মিথ্যা কথা বলে না। গতকাল প্রথম আলোর অনলাইনে পাঠক ভিডিওতে দেখেছেন কামাল মজুমদার কী মারমুখী ভঙ্গিতে সাংবাদিক অপর্ণা সিংহের হাত থেকে শব্দধারক ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেন। এ জন্য কামাল মজুমদারের বিরুদ্ধে ছিনতাই ও দস্যুতার মামলা হতে পারে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ছবিতে দেখা যায়, কামাল মজুমদার সাংবাদিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিচ্ছেন। ছবিতে অপর্ণার মোচড়ানো হাতটি আর দেখা যায় না। নিরীহ এক নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করে এই বীরপুঙ্গব পার পেলেও সমবেত বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়ে লেজ গুটিয়ে স্কুল ভবনের ভেতরে চলে যান। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারের পাহারায় সেখান থেকে মাইক্রোবাসে করে চলে যান।
এ ঘটনায় বিএনপি সরকারের আমলের শনির আখড়ার কথা মনে পড়ল। সে সময় পানি ও বিদ্যুতের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ যখন প্রতিবাদ করছিল, পুলিশ ও বিএনপির কর্মীরা তাদের বাধা দেন। বিক্ষুব্ধ জনতা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানে উপস্থিত বিএনপির তৎকালীন সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমেদকে ধাওয়া দেয়। এরপর তিনি এমন দৌড় দিলেন, যা অলিম্পিক প্রতিযোগিতাকেও হার মানায়। সেই থেকে তিনি হয়ে গেলেন দৌড় সালাহউদ্দিন।
তাহলে মিরপুরের সাংসদ কামাল মজুমদারকে মানুষ কী নামে চিনবে? সাংবাদিক নির্যাতনকারী। আমরা এত দিন জানতাম, সাংসদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। এখন থেকে তাঁদের আরও একটি দায়িত্ব বাড়ল। সাংবাদিক পেটানো। এ ধরনের কাজ তিনি এর আগেও করেছেন। পুলিশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পেটানো, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা তাঁর কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। আশুলিয়ায় গাড়ি আটকানোর জন্য পুলিশ কনস্টেবলের গায়েও হাত তুলেছিলেন এই সাংসদ। সুযোগ্য এই পিতার সুযোগ্য পুত্রও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডিত হয়ে এখন আমেরিকায় পলাতক।
কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমীতে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন বিদেশি বহু রাষ্ট্রনেতা ও সংস্থা। প্রশংসা করেছে জাতিসংঘও। আমাদের ধারণা, নারীর এত প্রশংসা পুরুষ কামাল মজুমদারের পছন্দ হয়নি। এ কারণেই তিনি নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করেছেন। তাঁর হাত মোচড়ে দিয়েছেন।
আমাদের সমাজে এখনো নারীকে একটু বাড়তি সমীহ করা হয়। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে কথা বলা হয়। সাধারণত পুরুষের সঙ্গে আরেকজন পুরুষ যতটা উচ্চ স্বরে কথা বলেন, নারীর সঙ্গে সেভাবে বলেন না। কামাল মজুমদার তার উল্টোটাই করেছেন। তিনি কোনো একজন নারীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ও ক্যাডার লেলিয়ে ক্ষান্ত হননি। নিজেই ক্যাডারের ভূমিকায় নেমেছেন। আওয়ামী লীগের সব পুরুষ সাংসদই যদি কামাল মজুমদারকে অনুসরণ করেন, তাহলে ঠিকই দিনের বদল হবে। জঙ্গিবাদিরা একভাবে নারীদের ঘরে আটকে রাখতে চায়, কামাল মজুমদারেরা আরেকভাবে।
এই অসভ্য ও অভব্য আচরণের মাধ্যমে কামাল মজুমদার কেবল একজন নারী সাংবাদিককেই অপমান করেননি। অপমান করেছেন বাংলাদেশের সমগ্র নারী সমাজকে, অপমান করেছেন তাঁর নেত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অপমান করেছেন জাতীয় সংসদের সব নারী সদস্যকেও। এরপর নারী সাংসদেরা সংসদে এই নারী নির্যাতক সাংসদের পাশে বসবেন কী করে? তাঁদের কি একবারও অপর্ণা সিংহের কথা মনে পড়বে না?
আমাদের মনে আছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই সময়ের সাংসদ জয়নাল আবেদিন হাজারি সংসদে দাঁড়িয়ে বাঁধন নামের একটি মেয়ে সম্পর্কে অশ্রাব্য ও অশালীন ভাষায় বিষোদ্গার করেছিলেন। সে সময় তাঁকে নিবৃত্ত করা হলে হয়তো আজ কামাল মজুমদার একজন নারী সাংবাদিককে এভাবে গালিগালাজ করতে বা গায়ে হাত তুলতে সাহস পেতেন না।
জানি না, বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংসদ উপনেতা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে নেবেন। তাঁরা তিনজনই নারী। নারী হয়ে তাঁরা কি নারীর প্রতি এই অপমান সহ্য করবেন? এ কাজটি বিরোধী দলের কোনো সাংসদ করলে আমরা নিশ্চিত সাহারা খাতুনের পুলিশ বাহিনী ওই দিন রাতেই তাঁকে চ্যাংদোলা করে থানায় নিয়ে যেত এবং সত্য উদ্ঘাটনের প্রয়োজনে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো।
কিন্তু কামাল মজুমদার যে সরকারি দলের সাংসদ! তাঁর সাত খুন মাফ। এর আগেও কামাল মজুমদার অনেকবার মাস্তানি করেছেন। ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোয় মিরপুরে একটি হাসপাতালকে দেওয়া তিনি দখল করে নিয়েছেন এই মর্মে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর বিরুদ্ধে তিনি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ২টি ও প্রতিবেদক অরূপ দত্তের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেন। একটি মানহানির (নারী নির্যাতকের আবার মানহানি!)। আরেকটি ক্ষতিপূরণ এবং শেষটি করেছেন সাংবাদিক অরূপ দত্তের বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজির’। তিনটি মামলাই বিচারাধীন। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করব না। কেবল চাঁদাবাজির মামলাটির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কোনো সাংবাদিক চাঁদাবাজি করলে অবশ্যই তাঁর শাস্তি হবে। প্রথম আলোর সাংবাদিক কোথায়, কখন, কীভাবে চাঁদাবাজি করেছেন, তা কামাল মজুমদারকেই প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু প্রমাণ দিতে না পারলে মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিক হয়রানির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের সেই মুরোদ আছে কি?
আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছর পার হতে চলেছে। এই সময়ে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা-কর্মী, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, যুবলীগের নেতা-কর্মীদের ভাগ্য যে বদল হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করলে দেখতে পাবে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে এসব সাংসদ ও নেতা-কর্মীর কী সহায়সম্পদ ছিল, কী ব্যবসাবাণিজ্য ছিল এবং এখন কী আছে। এত অল্প সময়ে বৈধ পথে এত বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া যায় কি না, তাও দুদক তদন্ত করে দেখতে পারে। অবৈধ অর্থ অবৈধ ক্ষমতার প্রসার ঘটায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভা-সমাবেশে প্রায়শ বিগত বিএনপি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু তাঁর দলের সবাই যে দুর্নীতিমুক্ত, সে ব্যাপারে তিনি এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে?
কামাল মজুমদার একা নন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও সাংসদই দেশটাকে তাঁদের জমিদারি ভাবেন। কয়েক দিন আগে একটি সেমিনারে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যে ভাষায় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে গালমন্দ করলেন তা কোনো ভদ্র লোকের মুখে শোভা পায় না। ওই সাংবাদিকের অপরাধ ছিল, তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা বললেও তাঁর নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি বলেননি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনই নাম ও সার্টিফিকেটের জন্য কাঙালপনা দেখান না। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী দেখাচ্ছেন। এমন কী উপস্থাপক ভুল স্বীকার করার পরও তাঁকে কড়া কথা শুনিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমরা হাওয়ায় ভেসে আসিনি।’ তাঁরা হাওয়ায় ভেসে আসেননি বলেই মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন। আর আমজনতা হাওয়ায় ভেসে এসেছে বলেই তাদের ওপর জবরদস্তি করছেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, গত তিন বছরে সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার মুখের ভাষা-ভঙ্গি বদলে গেছে। আগে যাঁরা নাম ছাপার জন্য পত্রিকা অফিসে অফিসে ধরনা দিতেন, টেলিফোনে সাংবাদিকদের অনুরোধ-উপরোধ করতেন, এখন কথায় কথায় সবক দেন, ধমক লাগান। কেউ কেউ তুই- তোকারি করতেও ছাড়েন না। এই হলো দিনবদলের নমুনা।
যখন কোনো সরকারের বা দলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়, তখনই নেতা-নেত্রী-সাংসদেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এটি আমরা ২০০০-২০০১ সালে দেখেছি। ২০০৫-২০০৬ সালে দেখেছি। এবার মেয়াদের দুই বছর বাকি থাকতেই আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-মন্ত্রী ও সাংসদেরা মারমুখী হয়ে উঠেছেন। বাকি সময়টা তাঁরা কী করবেন আল্লাহই জানেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.