গুপ্তহত্যাঃ আরও পাঁচজন নিখোঁজ by গোলাম মর্তুজা
বিদেশগামী আত্মীয়কে বিদায় জানাতে গত ১৭ নভেম্বর সকালে ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন পাঁচজন। ওই দিন দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ এলাকা থেকে তাঁদেরসহ সাতজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ১০ দিন পর আশুলিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁদের একজন জসীমউদ্দীনের (৩৫) লাশ।
এই সাতজন ছাড়াও গত এক বছরে প্রথম আলোর হিসাবে ২২ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের লাশ পাওয়া গেছে। সবার স্বজনদের অভিযোগ, তাঁরা সবাই গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাত রয়েছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চালু করা হয়েছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের বিশেষ অভিযান। সে সময় দেশে শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আইনের মাধ্যমে অভিযানে নিয়োজিতদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ‘ক্রসফায়ার’-এর ঘটনাও বাড়তে থাকে। ওই সময়ে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সে সময় সমালোচনায় সোচ্চার ছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা আছে, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ফোরামে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি অঙ্গীকার করেছিলেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের পাশাপাশি সমাজের অন্য ক্ষেত্রেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে সরকার বদ্ধপরিকর।’ এর পরও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। তবে ক্রসফায়ারের ঘটনা কমলেও বেড়েছে গুপ্তহত্যার অভিযোগ। সরকারের কোনো সংস্থা গুপ্তহত্যার কথা স্বীকার না করলেও গুপ্তহত্যার শিকারদের স্বজনেরা এর জন্য দায়ী করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিশেষ বাহিনীকে।
সর্বশেষ নিহত ও নিখোঁজ পাঁচজনের বিষয়ে বোরহানউদ্দিন থানার পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিরা একটি প্রতারক চক্রের সদস্য। তাঁরা ‘জিনের ব্যবসা’ করেন। মতিঝিল থানার পুলিশ সূত্র জানায়, ওই দিন অপহূত হয়েছিলেন মো. মিরাজ (২৬), মো. দিদার (২৮), জসীমউদ্দীন (৩৫), মো. আকাশ ওরফে বাহার (২৯), শেখ সাদী (৩৮), আরিফ হোসেন (২৮) ও মো. জুয়েল (২২)। এ ঘটনায় ছাড়া পাওয়ার পর মো. মিরাজ মতিঝিল থানায় গত ২০ নভেম্বর একটি অপহরণ মামলা করেন।
মামলার এজাহারে মো. মিরাজ অভিযোগ করেন, গত ১৭ নভেম্বর তিনিসহ তাঁর ভাই মো. দিদার, মামাতো ভাই মো. আকাশ ও ভগ্নিপতি জসীমউদ্দীন বিদেশগামী ছোট ভাই সাব্বিরকে বিদায় জানাতে লঞ্চে করে ঢাকায় আসেন। বেলা আড়াইটার দিকে তাঁরা মালিবাগের হোসাফ টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় একটি মাইক্রোবাসে অজ্ঞাতনামা কয়েকজন তাঁদের উঠিয়ে নেয়। মাইক্রোবাসে চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও দুজন ছিলেন। তাঁদের একজন রামপুরার ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন (২৮) বলে শনাক্ত করেন মিরাজ। আরেকজনের বয়স ২২ বছরের মতো।
এজাহারে মিরাজ উল্লেখ করেন, অপহরণকারীরা তাঁর মামাতো ভাই আকাশের ব্র্যাক ব্যাংকের একটি ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যায়। ওই কার্ডের গোপন শনাক্তকরণ নম্বর নিয়ে মৌচাক-শান্তিনগর এলাকার যেকোনো একটি বুথ থেকে ব্যাংক হিসাবের সব টাকা তুলে নেয়। এরপর তারা মিরাজকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে দুই দিন পর ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, শেখ সাদী নামে দিদারদের এক আত্মীয়ও এ ঘটনায় অপহূত হন। তাঁকেও মিরাজের সঙ্গে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে শেখ সাদীর নাম মামলায় উল্লেখ করেননি মিরাজ। তাঁদের মধ্যে দিদার আধ্যাত্মিক শক্তি, জিন ইত্যাদি বিষয়ে প্রতারণাকারী একটি চক্রের হোতা বলে জানা গেছে। আরিফ হোসেন রামপুরার গ্রামীণ ঐতিহ্য নামের একটি কাপড়ের দোকানের মালিক। তাঁর আরও কয়েকটি ব্যবসা রয়েছে। তিনিও একসময় প্রতারণা করতেন বলে জানা গেছে। আর মামলায় চোখ বাঁধা অন্য যে তরুণের উল্লেখ করেছেন মিরাজ, তাঁর নাম জুয়েল বলে জানা গেছে। জুয়েল একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করেন। পুলিশ জানায়, তাঁদের সবার বাড়ি বোরহানউদ্দিনে। তাই তাঁরা একে অপরকে আগে থেকে চেনেন।
বেঁচে ফিরে আসা দুজন ও তাঁদের স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, ১৭ নভেম্বর সকালে তাঁরা ভোলা থেকে এসে মালিবাগের একটি মাঝারি মানের হোটেলে ওঠেন। সেই হোটেলে বিদেশগামী ভাইকে রেখে দুপুরে নিচে নামলে তাঁদের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। মাইক্রোবাসে আরিফ ও জুয়েল (এজাহারে বর্ণিত চোখ বাঁধা দুজন) আগে থেকে ছিলেন। মাইক্রোবাসে তোলার পর অপহরণকারীরা মিরাজ ও শেখ সাদীকে দেখিয়ে দিদারের কাছে পরিচয় জানতে চায়। উত্তরে দিদার বলেন, তাঁরা কেউ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত নন। পরে তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেওয়া হয়।
মিরাজ ও নিখোঁজ দিদারের মা বিবি হাসিনা বলেন, তাঁর ছোট ছেলে সাব্বির হাসানকে উঠিয়ে দিতে তাঁরা ঢাকায় আসেন। শেখ সাদী তাঁদের আত্মীয়। ঢাকা থেকে সাদী, দিদার, মিরাজসহ তাঁদের সঙ্গীরা অপহূত হন। পরে মিরাজ আর শেখ সাদীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসিনা বিবি বলেন, ‘বাবা, ১২ বছর হইছে আমি বিধবা। পোলাপাইনগুলিরে কষ্ট কইরা বড় করছি। এহন আমার পোলাডারে কারা ধইরে নিল। আমি বাবা মুখ্যসুখ্য মানুষ, এত সব বুঝিও না।’
মিরাজের একজন স্বজন বলেন, এ ঘটনার পর শেখ সাদী কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। মিরাজও আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন না। তাঁর স্বজনেরাও মোবাইল ফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
গত ২৮ নভেম্বর সকালে আশুলিয়ার ঘোষবাগ ও ডিইপিজেড নতুন জোনের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশ থেকে প্রায় একই বয়সের দুই যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর কয়েক দিন পর ঘোষবাগ থেকে উদ্ধার করা লাশটি জসীমউদ্দীনের বলে শনাক্ত করেন তাঁর ভাই জাহাঙ্গীর আলম।
জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, দিদারের সঙ্গে গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় আসার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন জসীম। এরপর তাঁদের সাতজনকে ঢাকার মালিবাগ এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। পরে মিরাজ ও শেখ সাদীকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। এর কয়েক দিন পর জসীমের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। তিনি জানান, বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জের হাটে সুপারির ব্যবসা করতেন জসীম। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
মিরাজের দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এঁদের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
নিখোঁজদের বিষয়ে জানতে চাইলে বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন বলেন, ‘এদের নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার বিষয়ে কেউ থানায় জানায়নি। তবে বিষয়টি আমরা শুনেছি।’ ওসি বলেন, এঁরা জিনের ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জিনের ব্যবসার একটি চক্র এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণা করে নয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সেই লোক বোরহানউদ্দিন থানায় একটি মামলা করেছেন। সেই মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে দিদার, মিরাজদের নাম বেরিয়ে এসেছে।
ওসি বলেন, তাঁরা গভীর রাতে বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে সাধারণ মানুষকে ফোন করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় অলৌকিক শক্তির কথা বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করেন। এমনকি প্রবাসীদেরও তাঁরা প্রতারিত করেছেন বলে তথ্য রয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়]
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চালু করা হয়েছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের বিশেষ অভিযান। সে সময় দেশে শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আইনের মাধ্যমে অভিযানে নিয়োজিতদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ‘ক্রসফায়ার’-এর ঘটনাও বাড়তে থাকে। ওই সময়ে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সে সময় সমালোচনায় সোচ্চার ছিল। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা আছে, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ফোরামে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি অঙ্গীকার করেছিলেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের পাশাপাশি সমাজের অন্য ক্ষেত্রেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে সরকার বদ্ধপরিকর।’ এর পরও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। তবে ক্রসফায়ারের ঘটনা কমলেও বেড়েছে গুপ্তহত্যার অভিযোগ। সরকারের কোনো সংস্থা গুপ্তহত্যার কথা স্বীকার না করলেও গুপ্তহত্যার শিকারদের স্বজনেরা এর জন্য দায়ী করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিশেষ বাহিনীকে।
সর্বশেষ নিহত ও নিখোঁজ পাঁচজনের বিষয়ে বোরহানউদ্দিন থানার পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিরা একটি প্রতারক চক্রের সদস্য। তাঁরা ‘জিনের ব্যবসা’ করেন। মতিঝিল থানার পুলিশ সূত্র জানায়, ওই দিন অপহূত হয়েছিলেন মো. মিরাজ (২৬), মো. দিদার (২৮), জসীমউদ্দীন (৩৫), মো. আকাশ ওরফে বাহার (২৯), শেখ সাদী (৩৮), আরিফ হোসেন (২৮) ও মো. জুয়েল (২২)। এ ঘটনায় ছাড়া পাওয়ার পর মো. মিরাজ মতিঝিল থানায় গত ২০ নভেম্বর একটি অপহরণ মামলা করেন।
মামলার এজাহারে মো. মিরাজ অভিযোগ করেন, গত ১৭ নভেম্বর তিনিসহ তাঁর ভাই মো. দিদার, মামাতো ভাই মো. আকাশ ও ভগ্নিপতি জসীমউদ্দীন বিদেশগামী ছোট ভাই সাব্বিরকে বিদায় জানাতে লঞ্চে করে ঢাকায় আসেন। বেলা আড়াইটার দিকে তাঁরা মালিবাগের হোসাফ টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় একটি মাইক্রোবাসে অজ্ঞাতনামা কয়েকজন তাঁদের উঠিয়ে নেয়। মাইক্রোবাসে চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও দুজন ছিলেন। তাঁদের একজন রামপুরার ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন (২৮) বলে শনাক্ত করেন মিরাজ। আরেকজনের বয়স ২২ বছরের মতো।
এজাহারে মিরাজ উল্লেখ করেন, অপহরণকারীরা তাঁর মামাতো ভাই আকাশের ব্র্যাক ব্যাংকের একটি ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যায়। ওই কার্ডের গোপন শনাক্তকরণ নম্বর নিয়ে মৌচাক-শান্তিনগর এলাকার যেকোনো একটি বুথ থেকে ব্যাংক হিসাবের সব টাকা তুলে নেয়। এরপর তারা মিরাজকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে দুই দিন পর ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, শেখ সাদী নামে দিদারদের এক আত্মীয়ও এ ঘটনায় অপহূত হন। তাঁকেও মিরাজের সঙ্গে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে শেখ সাদীর নাম মামলায় উল্লেখ করেননি মিরাজ। তাঁদের মধ্যে দিদার আধ্যাত্মিক শক্তি, জিন ইত্যাদি বিষয়ে প্রতারণাকারী একটি চক্রের হোতা বলে জানা গেছে। আরিফ হোসেন রামপুরার গ্রামীণ ঐতিহ্য নামের একটি কাপড়ের দোকানের মালিক। তাঁর আরও কয়েকটি ব্যবসা রয়েছে। তিনিও একসময় প্রতারণা করতেন বলে জানা গেছে। আর মামলায় চোখ বাঁধা অন্য যে তরুণের উল্লেখ করেছেন মিরাজ, তাঁর নাম জুয়েল বলে জানা গেছে। জুয়েল একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করেন। পুলিশ জানায়, তাঁদের সবার বাড়ি বোরহানউদ্দিনে। তাই তাঁরা একে অপরকে আগে থেকে চেনেন।
বেঁচে ফিরে আসা দুজন ও তাঁদের স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, ১৭ নভেম্বর সকালে তাঁরা ভোলা থেকে এসে মালিবাগের একটি মাঝারি মানের হোটেলে ওঠেন। সেই হোটেলে বিদেশগামী ভাইকে রেখে দুপুরে নিচে নামলে তাঁদের একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। মাইক্রোবাসে আরিফ ও জুয়েল (এজাহারে বর্ণিত চোখ বাঁধা দুজন) আগে থেকে ছিলেন। মাইক্রোবাসে তোলার পর অপহরণকারীরা মিরাজ ও শেখ সাদীকে দেখিয়ে দিদারের কাছে পরিচয় জানতে চায়। উত্তরে দিদার বলেন, তাঁরা কেউ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত নন। পরে তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দেওয়া হয়।
মিরাজ ও নিখোঁজ দিদারের মা বিবি হাসিনা বলেন, তাঁর ছোট ছেলে সাব্বির হাসানকে উঠিয়ে দিতে তাঁরা ঢাকায় আসেন। শেখ সাদী তাঁদের আত্মীয়। ঢাকা থেকে সাদী, দিদার, মিরাজসহ তাঁদের সঙ্গীরা অপহূত হন। পরে মিরাজ আর শেখ সাদীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসিনা বিবি বলেন, ‘বাবা, ১২ বছর হইছে আমি বিধবা। পোলাপাইনগুলিরে কষ্ট কইরা বড় করছি। এহন আমার পোলাডারে কারা ধইরে নিল। আমি বাবা মুখ্যসুখ্য মানুষ, এত সব বুঝিও না।’
মিরাজের একজন স্বজন বলেন, এ ঘটনার পর শেখ সাদী কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। মিরাজও আতঙ্কে রয়েছেন। তাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন না। তাঁর স্বজনেরাও মোবাইল ফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
গত ২৮ নভেম্বর সকালে আশুলিয়ার ঘোষবাগ ও ডিইপিজেড নতুন জোনের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশ থেকে প্রায় একই বয়সের দুই যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর কয়েক দিন পর ঘোষবাগ থেকে উদ্ধার করা লাশটি জসীমউদ্দীনের বলে শনাক্ত করেন তাঁর ভাই জাহাঙ্গীর আলম।
জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, দিদারের সঙ্গে গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় আসার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন জসীম। এরপর তাঁদের সাতজনকে ঢাকার মালিবাগ এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। পরে মিরাজ ও শেখ সাদীকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। এর কয়েক দিন পর জসীমের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। তিনি জানান, বোরহানউদ্দিনের কুঞ্জের হাটে সুপারির ব্যবসা করতেন জসীম। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
মিরাজের দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এঁদের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
নিখোঁজদের বিষয়ে জানতে চাইলে বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন বলেন, ‘এদের নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার বিষয়ে কেউ থানায় জানায়নি। তবে বিষয়টি আমরা শুনেছি।’ ওসি বলেন, এঁরা জিনের ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জিনের ব্যবসার একটি চক্র এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণা করে নয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সেই লোক বোরহানউদ্দিন থানায় একটি মামলা করেছেন। সেই মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে দিদার, মিরাজদের নাম বেরিয়ে এসেছে।
ওসি বলেন, তাঁরা গভীর রাতে বিভিন্ন ভঙ্গিমা করে সাধারণ মানুষকে ফোন করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় অলৌকিক শক্তির কথা বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করেন। এমনকি প্রবাসীদেরও তাঁরা প্রতারিত করেছেন বলে তথ্য রয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়]
No comments