সীমানার ওপারে স্বজন by সঞ্জয় ঘোষ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে বিশাল অবদান রেখেছেন অনেক বিদেশি নাগরিক। বহু সৃজনশীল মানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে মানবিক ভূমিকা পালন করেছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। তারা সাহস জুগিয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িতদের। স্মরণীয় সেই সব মানুষের মধ্যে স্মরণীয়দের নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
একাত্তরে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ, সহায়-সম্বলহীন ঘরছাড়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের কথা বিবিসিসহ অন্য গণমাধ্যম মারফত বিশ্ববাসী জানতে পারে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালি সেতারবাদক রবিশঙ্কর হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন ছিন্নমূল সেই সব শরণার্থীর বিপন্নতা। এ রকম অমানবিক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতিতে বাঙালি হয়ে বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থেকেই রবিশঙ্করের মাথায় আসে কনসার্টের কথা।
গত শতকের ষাটের দশকে তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের ভাঙন ধরে ১৯৭০ সালেই। জর্জ হ্যারিসনসহ বিটলসের অন্য সদস্যরা তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। হ্যারিসন তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে তার নতুন অ্যালবাম রাগার কাজ করছেন। তখনই রবিশঙ্কর প্রস্তাব দিলেন বাংলাদেশিদের সাহায্য করার জন্য বড় ধরনের কোনো কনসার্ট করা যায় কি-না। প্রাথমিকভাবে রবিশঙ্কর হাজার পঁচিশেক ডলারের একটা তহবিল দাঁড় করানোর ইচ্ছা থেকেই এ কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন। কিন্তু কোনো কিছু করলে বড় পরিসরেই করা উচিত_ এ মত হ্যারিসনের। তাই হ্যারিসন তখন যোগাযোগ শুরু করলেন ভেঙে যাওয়া দলের সদস্যদের সঙ্গে। অনেকেই জড়ো হলেন মহতী এ উদ্যোগে। বিল প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল রাজি হয়ে যান একবাক্যেই। রাজি করানো হয় বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনকেও। জন লেননেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তার আসা হয়নি। ঠিক হলো পুরো জুলাইয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চলবে। এরপর আগস্টে হবে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট দুপুরে শুরু হলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। রাত অবধি চলে কনসার্ট। প্রথম অংশে ছিল রবিশঙ্কর ও তার দলের পরিবেশনা_ সতেরো মিনিট স্থায়ী এ পরিবেশনার নামকরণ হয় 'বাংলা ধুন'। এ পরিবেশনায় তাকে সঙ্গত করেন তবলায় ওস্তাদ আল্লা রাখা ও তাম্বুুরায় কমল চক্রবর্তী।
কনসার্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই বব ডিলান ও হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন আটটি গান। বব ডিলান গাইলেন পাঁচটি। রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেলরাও গাইলেন। আর গিটারের জাদু তুললেন এরিক ক্ল্যাপটন। শেষ পরিবেশনা ছিল কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে লেখা বাংলাদেশ গানটি। 'মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ/হি টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প/বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ.../...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ'। রবিশঙ্কর ও বিটলসের এ উদ্যোগ থেকে সেদিন ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার সংগ্রহ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশ শিশুসাহায্য তহবিলে দেওয়া হয়েছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গ : কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে বাংলাদেশের একাত্তরের ট্র্যাজেডি গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের দুর্দশা দেখতে তিনি ভারতে এসেছিলেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের অভিজ্ঞতা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন 'যশোর রোডে সেপ্টেম্বর' নামের দীর্ঘ কবিতায়। 'লক্ষ্য শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/উদর পূর্তি, বিস্ফোরিত চোখের ধার/যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর/ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।' আজও আমরা যখন মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের 'যশোর রোড' গানটি শুনি, তখন সেই দিনগুলোর দুঃখ-বেদনা-লড়াইয়ের কথাগুলো ভেসে ওঠে। 'আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ' নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ক একই মঞ্চে কবিতা পড়েছিলেন, আমাদের পক্ষে উচ্চারণ করেছিলেন একাত্তরের ২০ নভেম্বর নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে।
জোয়ান বায়েজ : তিনি মার্কিন ফোক গায়িকা ও সমাজকর্মী। ১৯৭১-এ ত্রিশ বছরে পা রাখা জোয়ান বায়েজ সেই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটি গান লেখেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন 'সং অব বাংলাদেশ'। নিজের লেখা এবং সুর করা সেই গানটি গেয়ে সেদিন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বায়েজ। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত ও তহবিল গঠনের জন্য আয়োজন করেন 'ফ্রি কনসার্ট'। এ মহীয়সী গায়িকা বিভিন্ন দেশে ঘুরে তুলে ধরেছিলেন সেই সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর গণহত্যার ইতিহাস।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো : একাত্তরে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতারা। একাত্তরের ১১ জুন তাদের একটি প্রতিনিধি দল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল। এ দাবিনামায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিল আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তার সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের একটি মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন।
আঁদ্রে মালরো : ফ্রান্সের প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক আঁদ্রে মালরো। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে বিশিষ্ট বিদেশিরা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব আঁদ্রে মালরো। মহান এ ফরাসি একাধারে লেখক-রাজনীতিক-সৈনিক। যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক চালিয়েছেন স্পেনের বিপ্লবীদের সহায়তায় চাঁদা তুলতে গেছেন আটলান্টিক পেরিয়ে মার্কিন দেশে। মালরো শুধু যুদ্ধ চলাকালে ফরাসি সরকার ও জনগণকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দুর্গতি সম্পর্কে সচেতন করেই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতার পর নবীন রাষ্ট্রটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর উন্নয়ন-সহায়তা লাভের জন্যও কাজ করেছেন। মালরোর চেষ্টা বিফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী এ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে বাংলাদেশ ভোলেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালে। ঢাকা ছাড়াও গিয়েছিলেন রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিন জেলাতেই।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে যে কণ্ঠসৈনিকদের দুর্জয় অবদান ছিল, তাদের অন্যতম এক কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি গণমাধ্যমগুলো বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল আকাশবাণী আর বিবিসি রেডিও। এ আকাশবাণীতেই সংবাদ, সংবাদ-সমীক্ষা ও সংবাদ-পরিক্রমা পড়তেন দেবদুলাল। তার দৃঢ় কণ্ঠস্বরে উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন আমাদের রণাঙ্গনের সৈনিকরা। সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে, যুদ্ধের শিবিরে শিবিরে তাকে সবাই চিনতেন। তার কণ্ঠস্বরের মহিমা সবাইকে ইন্দ্রজালের মতো আবিষ্ট করে রাখত, উদ্বুদ্ধ করত নতুন প্রেরণায়। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝে-মধ্যে মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেখানকার এক সৈনিক।'
লিয়ার লেভিন : তিনি মার্কিন চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি এক ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরল অসংখ্য ফুটেজ। তার তোলা ফুটেজ থেকেই তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত চলচ্চিত্র 'মুক্তির গান'।
মকবুল ফিদা হুসেন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রয়াত এই চিত্রশিল্পী। নানাভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এ ছাড়া কবিতা লিখে, গান গেয়ে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, ছবি এঁকে পার্শ্ববর্তী দেশের গুণী যেসব মানুষ সেদিন আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তারা হলেন_ ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ঋতি্বক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা মিত্র, হীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ। সীমানার ওপারের এই স্বজনদের আমরা ভুলবো না।
গত শতকের ষাটের দশকে তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের ভাঙন ধরে ১৯৭০ সালেই। জর্জ হ্যারিসনসহ বিটলসের অন্য সদস্যরা তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। হ্যারিসন তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে তার নতুন অ্যালবাম রাগার কাজ করছেন। তখনই রবিশঙ্কর প্রস্তাব দিলেন বাংলাদেশিদের সাহায্য করার জন্য বড় ধরনের কোনো কনসার্ট করা যায় কি-না। প্রাথমিকভাবে রবিশঙ্কর হাজার পঁচিশেক ডলারের একটা তহবিল দাঁড় করানোর ইচ্ছা থেকেই এ কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন। কিন্তু কোনো কিছু করলে বড় পরিসরেই করা উচিত_ এ মত হ্যারিসনের। তাই হ্যারিসন তখন যোগাযোগ শুরু করলেন ভেঙে যাওয়া দলের সদস্যদের সঙ্গে। অনেকেই জড়ো হলেন মহতী এ উদ্যোগে। বিল প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল রাজি হয়ে যান একবাক্যেই। রাজি করানো হয় বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনকেও। জন লেননেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তার আসা হয়নি। ঠিক হলো পুরো জুলাইয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চলবে। এরপর আগস্টে হবে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট দুপুরে শুরু হলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। রাত অবধি চলে কনসার্ট। প্রথম অংশে ছিল রবিশঙ্কর ও তার দলের পরিবেশনা_ সতেরো মিনিট স্থায়ী এ পরিবেশনার নামকরণ হয় 'বাংলা ধুন'। এ পরিবেশনায় তাকে সঙ্গত করেন তবলায় ওস্তাদ আল্লা রাখা ও তাম্বুুরায় কমল চক্রবর্তী।
কনসার্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই বব ডিলান ও হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন আটটি গান। বব ডিলান গাইলেন পাঁচটি। রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেলরাও গাইলেন। আর গিটারের জাদু তুললেন এরিক ক্ল্যাপটন। শেষ পরিবেশনা ছিল কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে লেখা বাংলাদেশ গানটি। 'মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ/হি টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প/বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ.../...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ'। রবিশঙ্কর ও বিটলসের এ উদ্যোগ থেকে সেদিন ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার সংগ্রহ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশ শিশুসাহায্য তহবিলে দেওয়া হয়েছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গ : কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে বাংলাদেশের একাত্তরের ট্র্যাজেডি গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের দুর্দশা দেখতে তিনি ভারতে এসেছিলেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের অভিজ্ঞতা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন 'যশোর রোডে সেপ্টেম্বর' নামের দীর্ঘ কবিতায়। 'লক্ষ্য শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/উদর পূর্তি, বিস্ফোরিত চোখের ধার/যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর/ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।' আজও আমরা যখন মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের 'যশোর রোড' গানটি শুনি, তখন সেই দিনগুলোর দুঃখ-বেদনা-লড়াইয়ের কথাগুলো ভেসে ওঠে। 'আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ' নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ক একই মঞ্চে কবিতা পড়েছিলেন, আমাদের পক্ষে উচ্চারণ করেছিলেন একাত্তরের ২০ নভেম্বর নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে।
জোয়ান বায়েজ : তিনি মার্কিন ফোক গায়িকা ও সমাজকর্মী। ১৯৭১-এ ত্রিশ বছরে পা রাখা জোয়ান বায়েজ সেই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটি গান লেখেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন 'সং অব বাংলাদেশ'। নিজের লেখা এবং সুর করা সেই গানটি গেয়ে সেদিন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বায়েজ। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত ও তহবিল গঠনের জন্য আয়োজন করেন 'ফ্রি কনসার্ট'। এ মহীয়সী গায়িকা বিভিন্ন দেশে ঘুরে তুলে ধরেছিলেন সেই সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর গণহত্যার ইতিহাস।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো : একাত্তরে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতারা। একাত্তরের ১১ জুন তাদের একটি প্রতিনিধি দল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল। এ দাবিনামায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিল আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তার সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের একটি মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন।
আঁদ্রে মালরো : ফ্রান্সের প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক আঁদ্রে মালরো। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে বিশিষ্ট বিদেশিরা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব আঁদ্রে মালরো। মহান এ ফরাসি একাধারে লেখক-রাজনীতিক-সৈনিক। যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক চালিয়েছেন স্পেনের বিপ্লবীদের সহায়তায় চাঁদা তুলতে গেছেন আটলান্টিক পেরিয়ে মার্কিন দেশে। মালরো শুধু যুদ্ধ চলাকালে ফরাসি সরকার ও জনগণকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দুর্গতি সম্পর্কে সচেতন করেই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতার পর নবীন রাষ্ট্রটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর উন্নয়ন-সহায়তা লাভের জন্যও কাজ করেছেন। মালরোর চেষ্টা বিফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী এ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে বাংলাদেশ ভোলেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালে। ঢাকা ছাড়াও গিয়েছিলেন রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিন জেলাতেই।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে যে কণ্ঠসৈনিকদের দুর্জয় অবদান ছিল, তাদের অন্যতম এক কণ্ঠসৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি গণমাধ্যমগুলো বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল আকাশবাণী আর বিবিসি রেডিও। এ আকাশবাণীতেই সংবাদ, সংবাদ-সমীক্ষা ও সংবাদ-পরিক্রমা পড়তেন দেবদুলাল। তার দৃঢ় কণ্ঠস্বরে উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন আমাদের রণাঙ্গনের সৈনিকরা। সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে, যুদ্ধের শিবিরে শিবিরে তাকে সবাই চিনতেন। তার কণ্ঠস্বরের মহিমা সবাইকে ইন্দ্রজালের মতো আবিষ্ট করে রাখত, উদ্বুদ্ধ করত নতুন প্রেরণায়। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝে-মধ্যে মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেখানকার এক সৈনিক।'
লিয়ার লেভিন : তিনি মার্কিন চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি এক ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরল অসংখ্য ফুটেজ। তার তোলা ফুটেজ থেকেই তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত চলচ্চিত্র 'মুক্তির গান'।
মকবুল ফিদা হুসেন : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রয়াত এই চিত্রশিল্পী। নানাভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এ ছাড়া কবিতা লিখে, গান গেয়ে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, ছবি এঁকে পার্শ্ববর্তী দেশের গুণী যেসব মানুষ সেদিন আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তারা হলেন_ ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ঋতি্বক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা মিত্র, হীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ। সীমানার ওপারের এই স্বজনদের আমরা ভুলবো না।
No comments