বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি
বিনম্র শ্রদ্ধায় গতকাল জাতি স্মরণ করেছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। গতকাল ভোরের আলো ফোটার আগেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে হাজারো মানুষ ভিড় করেন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। কারও হাতে ফুলের তোড়া, কালো ব্যানারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে লেখা হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার চিরন্তন উচ্চারণ। আর কণ্ঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্লোগান; দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিস্তম্ভের বেদিমূলে যাওয়ার অপেক্ষা তাদের
চোখেমুখে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নানা বয়সী লাখো মানুষ সকাল থেকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। এ সময় ধ্বনিত হয়েছে ঘাতকদের ফাঁসির দাবি। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত স্মৃতিসৌধ থেকে বারবার উঠে আসছিল একটাই উচ্চারণ_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আসেন এবং ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। রাষ্ট্রপতির পক্ষেও শ্রদ্ধা
জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং তিন বাহিনীর প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার কাছে বিভিন্ন দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী তা পূরণের আশ্বাস দেন। এ সময় প্রবীণ এক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দেশের মানুষও তা-ই চায়।' পরে প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি নিয়ে পালিত দিবসটির সূর্যোদয়ের আগেই জনতার ঢল নামে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। ফজরের আজানের আগেই অনেকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন স্মৃতিসৌধে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হতে থাকে জনতার মিছিল। স্মৃতিসৌধ ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা বেছে বেছে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বাঙালি জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। যার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সহস্রাধিক মেধাবী মানুষ। এরপর থেকে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর এলে সমগ্র জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করে তাদের। লাখো মানুষ ভিড় করেন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। রাজধানীর রায়েরবাজারসহ দেশের অন্যান্য বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শহীদদের পরিবারের সদস্যরাও কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করে স্মরণ করেন প্রিয় স্বজনকে।
ভোর থেকেই দলে দলে বিভিন্ন ব্যানারে অগণিত মানুষ উপস্থিত হন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো স্মৃতিস্তম্ভ এলাকা। মিরপুর মাজার রোডে যান চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় 'রাজাকার নিপাত যাক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, ঘাতক-দালালদের ক্ষমা নাই' প্রভৃতি স্লোগানে পরিবেশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রীর পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই প্রশাসক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দেন। সকাল ৭টার পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার তার সঙ্গে ছিলেন।
সকাল পৌনে ৮টার দিকে স্মৃতিসৌধে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা সব সময়ই বলছি, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কিন্তু সেটা অবশ্যই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য প্রক্রিয়া চালাতে হবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য সরকারি দলের ভূমিকা মুখ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার সে ভূমিকা পালন করবে।'
সকালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পর্যায়ক্রমে পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবং যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। মাঈনুদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) নেতাকর্মীদের একটি দল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন মন্জুরুল আহসান খানের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দলের পক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জেএসডি নেতা আসম আবদুর রবের নেতৃত্বে বেদিতে ফুল দেন একদল নেতাকর্মী। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষে ফুল দিতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব ও সুব্রত ঘোষ। মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আবদুস সালাম, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের অরুণ সরকার রানা ও তারানা হালিমের নেতৃত্বে ফুল দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহায্য সংস্থা, এনজিও, পেশাজীবী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ অগণিত মানুষ স্মৃতিসৌধে এসে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের আহ্বানে সংগঠনটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ও জেলা সদরগুলোতে মানববন্ধন হয়েছে। ঢাকায় মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদ।
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল : রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল বেশি। শিশু-কিশোররাও এসেছিল মা-বাবার হাত ধরে। তাদের সবার মুখে মুখে ছিল একটাই দাবি, যেসব নরপশু দেশের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের হত্যা করেছে, পাকসেনাদের সহায়তা করেছে তাদের বিচার চাই। অনেকের প্লাকার্ডে লেখা ছিল, 'ঘৃণা... ঘৃণা...ঘৃণা...।' তাদের এ ঘৃণা, এ ধিক্কার '৭১-এর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের প্রতি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর সেখানে প্রতীকী বধ্যভূমি গড়ে তোলে। তরুণ-তরুণীরা শহীদ বুদ্ধিজীবী সেজে সেই ভয়াবহতার আবহ জনসমক্ষে তুলে ধরে। তাদের হাত-পা-চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। কারও শরীর বুলেটবিদ্ধ। সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল। ঢাকা হ্যারিটেজ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বিকেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম প্রমুখ রায়েররাজার বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, গণতন্ত্রী পার্টি, জেএসডি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বরিশাল বিভাগ সমিতি প্রভৃতি সংগঠনের নেতারা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন তপুর নেতৃত্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টাররা ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু, নায়েমের মহাপরিচালক প্রফেসর শামসুর রহমান প্রমুখ।
জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং তিন বাহিনীর প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার কাছে বিভিন্ন দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী তা পূরণের আশ্বাস দেন। এ সময় প্রবীণ এক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'দেশের মানুষও তা-ই চায়।' পরে প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি নিয়ে পালিত দিবসটির সূর্যোদয়ের আগেই জনতার ঢল নামে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। ফজরের আজানের আগেই অনেকে শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন স্মৃতিসৌধে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হতে থাকে জনতার মিছিল। স্মৃতিসৌধ ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা বেছে বেছে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বাঙালি জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। যার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সহস্রাধিক মেধাবী মানুষ। এরপর থেকে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর এলে সমগ্র জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করে তাদের। লাখো মানুষ ভিড় করেন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। রাজধানীর রায়েরবাজারসহ দেশের অন্যান্য বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শহীদদের পরিবারের সদস্যরাও কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করে স্মরণ করেন প্রিয় স্বজনকে।
ভোর থেকেই দলে দলে বিভিন্ন ব্যানারে অগণিত মানুষ উপস্থিত হন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো স্মৃতিস্তম্ভ এলাকা। মিরপুর মাজার রোডে যান চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় 'রাজাকার নিপাত যাক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, ঘাতক-দালালদের ক্ষমা নাই' প্রভৃতি স্লোগানে পরিবেশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রীর পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই প্রশাসক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দেন। সকাল ৭টার পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার তার সঙ্গে ছিলেন।
সকাল পৌনে ৮টার দিকে স্মৃতিসৌধে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা সব সময়ই বলছি, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কিন্তু সেটা অবশ্যই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য প্রক্রিয়া চালাতে হবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য সরকারি দলের ভূমিকা মুখ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার সে ভূমিকা পালন করবে।'
সকালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পর্যায়ক্রমে পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকার, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবং যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। মাঈনুদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) নেতাকর্মীদের একটি দল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন মন্জুরুল আহসান খানের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দলের পক্ষে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জেএসডি নেতা আসম আবদুর রবের নেতৃত্বে বেদিতে ফুল দেন একদল নেতাকর্মী। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষে ফুল দিতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব ও সুব্রত ঘোষ। মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার খালেকুজ্জামান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আবদুস সালাম, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের অরুণ সরকার রানা ও তারানা হালিমের নেতৃত্বে ফুল দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহায্য সংস্থা, এনজিও, পেশাজীবী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ অগণিত মানুষ স্মৃতিসৌধে এসে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের আহ্বানে সংগঠনটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ও জেলা সদরগুলোতে মানববন্ধন হয়েছে। ঢাকায় মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমদ।
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল : রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল বেশি। শিশু-কিশোররাও এসেছিল মা-বাবার হাত ধরে। তাদের সবার মুখে মুখে ছিল একটাই দাবি, যেসব নরপশু দেশের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের হত্যা করেছে, পাকসেনাদের সহায়তা করেছে তাদের বিচার চাই। অনেকের প্লাকার্ডে লেখা ছিল, 'ঘৃণা... ঘৃণা...ঘৃণা...।' তাদের এ ঘৃণা, এ ধিক্কার '৭১-এর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের প্রতি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর সেখানে প্রতীকী বধ্যভূমি গড়ে তোলে। তরুণ-তরুণীরা শহীদ বুদ্ধিজীবী সেজে সেই ভয়াবহতার আবহ জনসমক্ষে তুলে ধরে। তাদের হাত-পা-চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। কারও শরীর বুলেটবিদ্ধ। সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল। ঢাকা হ্যারিটেজ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বিকেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম প্রমুখ রায়েররাজার বধ্যভূমিতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, গণতন্ত্রী পার্টি, জেএসডি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বরিশাল বিভাগ সমিতি প্রভৃতি সংগঠনের নেতারা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন তপুর নেতৃত্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টাররা ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু, নায়েমের মহাপরিচালক প্রফেসর শামসুর রহমান প্রমুখ।
No comments