কণ্ঠে যখন মুক্তির গান by শিমুল আহমেদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু সম্মুখ যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নানামুখী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। এই যুদ্ধে মুক্তিপাগল মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের শিল্পীরাও। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা রণক্ষেত্রে রাইফেল আর গ্রেনেড হাতে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা না করলেও গানের মধ্য দিয়ে উৎসাহ দিয়েছে মুক্তিসেনাদের। শিল্পী শাহীন সামাদ বলেন, '১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গানের স্কোয়াড গঠন
করে নাম দেওয়া হয় 'মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'। এ সংগঠনটির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন তৈরি, পাশাপাশি অর্থসংগ্রহ ও কলকাতায় প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেওয়া। আমরা ঘুরে ঘুরে গান করতাম। আমার মনে আছে, সে সময় মাহমুদুর রহমান বেনু ভাই, ইকবাল আহমেদ, শেখ লুৎফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম দা, বিপুল ভট্টাচার্য কাঁধে হারমোনিয়াম নিয়ে ঘুরে ঘুরে কলকাতা-দিলি্লতে গাইতেন। দলকে উদ্বুদ্ধ করতেন ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা আপা [ড. সনজীদা খাতুন]। আমি বয়সে ছোট হলেও তাদের সঙ্গে থাকতাম।'
বিপুল ভট্টাচার্য জানালেন, '১৯৭১ সালের ৩ জুলাই আমরা প্রথম গান করি। পরদিন ৪ জুলাই কলকাতার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্য মিত্রসহ কলকাতার শিল্পীরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। কলকাতার শিল্পীরা আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করায় কাজটি আরও সহজ হয়। আমরা বেশ কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ড করে এনেছিলাম। সেগুলো পরবর্তী সময়ে বেতারের মাধ্যমে শোনানো হতো। এর মধ্যে কয়েকটি গান হলো_ 'আবার
তোরা মানুষ হ', 'মারতে হবে', 'খাটি সোনার চেয়ে খাটি', 'কারার ঐ লৌহ কপাট' ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা মুক্তাঞ্চলে গিয়েও গান পরিবেশন করেছি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা পুরো দল বাংলাদেশে ফিরে আসি।'
এদিকে বিজয়ের চার দশক উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেইসব দিনের কথা বলতে সংসদ ভবনের সামনে একত্র হন চার শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, ফকির আলমগীর, কল্যাণী ঘোষ ও উমা খান। 'আজ ভয়ে নয়, বুক ফুলিয়ে গাওয়া যায়। আজ আর লুকিয়ে লুকিয়ে বেতার কেন্দ্রে যেতে হয় না। বাইরে পাহারা বসিয়েছিলাম, যাতে শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পাই। গান শুনিয়ে উদ্যমী করে তুলেছি মুক্তিপাগল মানুষকে। বাংলার দামাল ছেলেদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেলের মতো গান করেছি'_ বলছিলেন শিল্পী ফকির আলমগীর।
স্বাধীন বাংলা বেতারের অনেক স্মৃতিই অজানা নতুন প্রজন্মের কাছে। উত্তাল সেই দিনগুলোতে শিল্পীরা লুকিয়ে লুকিয়ে গান করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর এক সময় সিদ্ধান্ত নেয়, সংস্কৃতিমনা এই শিল্পীদের রুখতে হবে। তখন চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল। রাজাকারদের সমন্বয়ে পাকহানাদার বাহিনীরা সেখানে হানা দেয়। এ কারণে সেখান থেকে বেতার কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হয় কলকাতার বালিগঞ্জে। মুক্তিপাগল শিল্পীরা তাতেও থেমে থাকেননি। শত ভয়কে তারা জয় করেছিলেন গান গেয়ে। পাশাপাশি তারা গণসংযোগের কাজেও অংশ নিয়েছিলেন। গণসংযোগের মাধ্যমে কলকাতার মানুষকে জানিয়েছেন দেশের কথা। সেই সময়ের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে দরাজ কণ্ঠে কল্যাণী ঘোষ বলেন, 'আমরা গান-বাজনার পাশাপাশি গণসংযোগ করতাম। কলকাতার মানুষদের আমাদের দেশের কথা বলতাম। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা শুনে তাদের চোখও ভিজে যেত। তারা আমাদের কথা শুনে নানাভাবে সাহায্য করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাদের সহযোগিতায় আমরা সঠিকভাবে বেতারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। তখন সবার চোখে একটাই স্বপ্ন_ দেশ স্বাধীন হবে।' তখন গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন তৈরি হতো একসঙ্গে বসেই। উমা খান জানান, 'কোনো আনুষ্ঠানিকতা করে গান-বাজনা করা হতো না। সবার মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট ছিলাম। তাই আমার ভয়ও করত বেশি। তবে মনে সবসময় সাহস ছিল_ আমাদের জয় একদিন হবেই। আমরা একসঙ্গে ছিলাম, এক পরিবারের মতো। তাই ভয় পেলে অন্যজন সাহস দিতেন। ভয় আর স্বপ্ন বোনার মধ্য দিয়ে কেটেছে এক একটি দিন।'
বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পীর চোখে সেদিন সোনালি এক বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিল। যা এখন অনেকটাই ধূসর। ফকির আলমগীর বলেন, 'এখনও না খেয়ে মানুষ মরছে, এখনও অন্যায়-অবিচার হচ্ছে, এখনও শোষকরা কালোহাত বাড়িয়ে আছে। শিল্পীরা এখনও অবহেলায় পড়ে আছেন। তবে আমি অনেক আশাবাদী, একদিন মানুষের মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস তৈরি হবে।'
দেখতে দেখতে কেটে গেল স্বাধীনতার ৪০ বছর। আগামী ১০০ বছর পরও কি মানুষ মনে রাখবে এসব মুক্তপাগল মানুষের কথা? এ প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার বলেন, 'স্বাধীনতার গল্প এখন যেমন নানা রূপ ধারণ করেছে, তেমনি অনেকে নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী হিসেবে দাবি করছেন। এভাবে চললে হয়তো সত্যিটা একদিন মুছে যাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যে গানগুলো গেয়েছিলাম সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক গানের স্বরলিপি হারিয়ে গেছে। তাই এর সঠিক সংরক্ষণ প্রয়োজন আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য।' এ কথার সঙ্গে একমত হলেন কল্যাণী ঘোষ, ফকির আলমগীর ও উমা খান। তাদের ক্ষোভ, শুধু বিজয়ের মাসেই তাদের ডাক পড়ে। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে প্রতিদিন একেকজন শিল্পীকে তিন-চারটি করে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এই বয়সে এত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। কল্যাণী ঘোষ বলেন, 'আমার ৬৫ বছর বয়স হয়েছে। এ সময় একদিনে এত অনুষ্ঠান করা শরীরের জন্য কষ্টদায়ক। অথচ বছরের বাকি সময়ে অলস সময় কাটাই। আজ আমরা সচল আছি বলেই মূল্যায়ন হচ্ছে।'
শিল্পীদের চোখে সোনার বাংলা দেখার স্বপ্নটা বাংলার প্রতিটি মানুষ দেখে। দুর্নীতি বন্ধ হয়ে দেশটা সোনার বাংলায় রূপ নেবে এমন চাওয়া এখন সবার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পীদের মতো অন্যদেরও প্রত্যাশা, স্বপ্নে দেখা বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবেন।
বিপুল ভট্টাচার্য জানালেন, '১৯৭১ সালের ৩ জুলাই আমরা প্রথম গান করি। পরদিন ৪ জুলাই কলকাতার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্য মিত্রসহ কলকাতার শিল্পীরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। কলকাতার শিল্পীরা আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করায় কাজটি আরও সহজ হয়। আমরা বেশ কিছু গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ড করে এনেছিলাম। সেগুলো পরবর্তী সময়ে বেতারের মাধ্যমে শোনানো হতো। এর মধ্যে কয়েকটি গান হলো_ 'আবার
তোরা মানুষ হ', 'মারতে হবে', 'খাটি সোনার চেয়ে খাটি', 'কারার ঐ লৌহ কপাট' ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা মুক্তাঞ্চলে গিয়েও গান পরিবেশন করেছি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা পুরো দল বাংলাদেশে ফিরে আসি।'
এদিকে বিজয়ের চার দশক উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেইসব দিনের কথা বলতে সংসদ ভবনের সামনে একত্র হন চার শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, ফকির আলমগীর, কল্যাণী ঘোষ ও উমা খান। 'আজ ভয়ে নয়, বুক ফুলিয়ে গাওয়া যায়। আজ আর লুকিয়ে লুকিয়ে বেতার কেন্দ্রে যেতে হয় না। বাইরে পাহারা বসিয়েছিলাম, যাতে শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পাই। গান শুনিয়ে উদ্যমী করে তুলেছি মুক্তিপাগল মানুষকে। বাংলার দামাল ছেলেদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেলের মতো গান করেছি'_ বলছিলেন শিল্পী ফকির আলমগীর।
স্বাধীন বাংলা বেতারের অনেক স্মৃতিই অজানা নতুন প্রজন্মের কাছে। উত্তাল সেই দিনগুলোতে শিল্পীরা লুকিয়ে লুকিয়ে গান করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর এক সময় সিদ্ধান্ত নেয়, সংস্কৃতিমনা এই শিল্পীদের রুখতে হবে। তখন চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল। রাজাকারদের সমন্বয়ে পাকহানাদার বাহিনীরা সেখানে হানা দেয়। এ কারণে সেখান থেকে বেতার কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হয় কলকাতার বালিগঞ্জে। মুক্তিপাগল শিল্পীরা তাতেও থেমে থাকেননি। শত ভয়কে তারা জয় করেছিলেন গান গেয়ে। পাশাপাশি তারা গণসংযোগের কাজেও অংশ নিয়েছিলেন। গণসংযোগের মাধ্যমে কলকাতার মানুষকে জানিয়েছেন দেশের কথা। সেই সময়ের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে দরাজ কণ্ঠে কল্যাণী ঘোষ বলেন, 'আমরা গান-বাজনার পাশাপাশি গণসংযোগ করতাম। কলকাতার মানুষদের আমাদের দেশের কথা বলতাম। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা শুনে তাদের চোখও ভিজে যেত। তারা আমাদের কথা শুনে নানাভাবে সাহায্য করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাদের সহযোগিতায় আমরা সঠিকভাবে বেতারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। তখন সবার চোখে একটাই স্বপ্ন_ দেশ স্বাধীন হবে।' তখন গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন তৈরি হতো একসঙ্গে বসেই। উমা খান জানান, 'কোনো আনুষ্ঠানিকতা করে গান-বাজনা করা হতো না। সবার মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট ছিলাম। তাই আমার ভয়ও করত বেশি। তবে মনে সবসময় সাহস ছিল_ আমাদের জয় একদিন হবেই। আমরা একসঙ্গে ছিলাম, এক পরিবারের মতো। তাই ভয় পেলে অন্যজন সাহস দিতেন। ভয় আর স্বপ্ন বোনার মধ্য দিয়ে কেটেছে এক একটি দিন।'
বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পীর চোখে সেদিন সোনালি এক বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিল। যা এখন অনেকটাই ধূসর। ফকির আলমগীর বলেন, 'এখনও না খেয়ে মানুষ মরছে, এখনও অন্যায়-অবিচার হচ্ছে, এখনও শোষকরা কালোহাত বাড়িয়ে আছে। শিল্পীরা এখনও অবহেলায় পড়ে আছেন। তবে আমি অনেক আশাবাদী, একদিন মানুষের মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস তৈরি হবে।'
দেখতে দেখতে কেটে গেল স্বাধীনতার ৪০ বছর। আগামী ১০০ বছর পরও কি মানুষ মনে রাখবে এসব মুক্তপাগল মানুষের কথা? এ প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আবদুল জব্বার বলেন, 'স্বাধীনতার গল্প এখন যেমন নানা রূপ ধারণ করেছে, তেমনি অনেকে নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী হিসেবে দাবি করছেন। এভাবে চললে হয়তো সত্যিটা একদিন মুছে যাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যে গানগুলো গেয়েছিলাম সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক গানের স্বরলিপি হারিয়ে গেছে। তাই এর সঠিক সংরক্ষণ প্রয়োজন আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য।' এ কথার সঙ্গে একমত হলেন কল্যাণী ঘোষ, ফকির আলমগীর ও উমা খান। তাদের ক্ষোভ, শুধু বিজয়ের মাসেই তাদের ডাক পড়ে। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে প্রতিদিন একেকজন শিল্পীকে তিন-চারটি করে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এই বয়সে এত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। কল্যাণী ঘোষ বলেন, 'আমার ৬৫ বছর বয়স হয়েছে। এ সময় একদিনে এত অনুষ্ঠান করা শরীরের জন্য কষ্টদায়ক। অথচ বছরের বাকি সময়ে অলস সময় কাটাই। আজ আমরা সচল আছি বলেই মূল্যায়ন হচ্ছে।'
শিল্পীদের চোখে সোনার বাংলা দেখার স্বপ্নটা বাংলার প্রতিটি মানুষ দেখে। দুর্নীতি বন্ধ হয়ে দেশটা সোনার বাংলায় রূপ নেবে এমন চাওয়া এখন সবার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পীদের মতো অন্যদেরও প্রত্যাশা, স্বপ্নে দেখা বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবেন।
No comments