তার অসমাপ্ত যুদ্ধ
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন লিয়ার লেভিন। এখানে পরিচয় হয় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তিনি ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ। সেই সূত্র ধরে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন 'মুক্তির গান'। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হয়ে আছে ছবিটি। আর তারেক মাসুদ হয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর। আমেরিকার বাসিন্দা
ক্যাথরিন মাসুদকে বিয়ে করে ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্কে চলে যান তারেক মাসুদ। একটি বুক স্টোরে কাজ করেন তিনি। সেখানেই মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী পরিষদের সদস্য তারিক আলীর মাধ্যমে খবর পান একজন আমেরিকান চিত্রগ্রাহক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছেন। স্ত্রী ক্যাথরিনের উৎসাহ আর চেষ্টার কারণেই খুঁজে বের করা হলো লিয়ার লেভিনকে। তারেক মাসুদ জানান, গত ২০ বছর ধরে এই ফোন কলটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন লেভিন। তারপর সবাই মিলে সেসব ফুটেজ দেখলেন। রঙিন আর সশব্দে ধারণ করা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ। সেগুলো নিয়েই শুরু হলো 'মুক্তির গান' ছবির কাজ। লিয়ার লেভিনের ফুটেজগুলো থেকে প্রায় ৬০ মিনিটের, সেই সঙ্গে আরও নানা জায়গা থেকে সংগৃহীত ও কেনা ফুটেজ দিয়ে তৈরি হলো 'মুক্তির গান'। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে এসে ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দেওয়া হয়। কিন্তু বাদ সাধল সেন্সর বোর্ড। প্রায় ছয় মাস আটকে রাখল তারা। অবশেষে কোনো কর্তন ছাড়াই সেন্সর ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয় সেন্সর বোর্ড। ১৯৯৬ সালে ডিসেম্বর মাসে 'মুক্তির গান'-এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। পুরো দেশে এ ছবি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দারুণ প্রশংসিত হয় এটি। এতেই থেমে থাকেননি তিনি। সারাদেশে গ্রামে গ্রামে গিয়ে 'মুক্তির গান'-এর প্রদর্শনী করেছেন। পরের বছরই তিনি নির্মাণ করেন 'মুক্তির কথা'। এ নিয়ে তারেক মাসুদ বলেছিলেন, 'মুক্তির কথা'য় আরও অনেক দুর্লভ ফুটেজ রয়েছে। ছবিটি যখন প্রদর্শিত হলো অনেকেই অবাক হয়েছেন। গ্রামের অজানা-অচেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তুলে এনেছেন এ ছবিতে। দুটি ছবি নিয়ে গ্রামের মাঠে প্রজেক্টর দিয়ে প্রদর্শনী করত তারেক মাসুদ। এসব প্রদর্শনীতে হাজার হাজার দর্শক দেখে তারেক মাসুদ নিজেও মুগ্ধ হয়ে যেতেন। সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ তাকে আরও ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু সেই ভাবনার পুরোটা না দিয়ে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। কিন্তু এমন সম্পদ রেখে গেলেন যা দিয়ে নতুন প্রজন্মের যারা চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী, যারা সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে চান, তারা এসব ফুটেজ ব্যবহার করতে পারবেন। এসব ফুটেজ এবং ছবি নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকের সহযোগিতায় একটি আর্কাইভ গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল তারেক মাসুদের। 'মুক্তির গান' কিংবা 'মুক্তির কথা'র এমন অনেক ছবির মিছিলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলাদেশের গৌরবের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের কথা। এমন স্বপ্ন নিয়েই নিরন্তর কাজ করেছেন তারেক মাসুদ। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন দেশের মানুষকে। কিন্তু সবাইকে রেখে একা চলে গেলেন অনেক দূরে।
No comments