তাঁর হাসিমুখ সাহস ও সান্ত্বনার উৎস হয়ে থাকবে by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
অত্যন্ত পরিণত বয়সে কবীর চৌধুরী চলে গেলেন। যে বয়সে তিনি চলে গেলেন, সে বয়সের হিসাবটা যেভাবে আমরা করব তাতে দেখা যাবে, এই দীর্ঘ জীবনের কোনো ক্ষুদ্র অংশেরই তিনি অপচয় করেননি। অন্য কথায়, তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন, ব্যাপকভাবে সৃষ্টিশীল ছিলেন।
আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, তাঁকে দেখেছি, লেখা চেয়ে কখনো বিমুখ হতে হয়নি। প্রথম দিকে তাঁর লেখালেখি ছিল বিদেশি উপন্যাস বা মূলত আমেরিকান উপন্যাস অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা।
এক পর্বে তিনি আমেরিকার সাহিত্যপাঠের সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে। উপন্যাস ছাড়া তাঁর আরেকটি আগ্রহের বিষয় ছিল নাটক। মুনীর চৌধুরী যেমন নাটকের রচনায় ও অনুবাদে এবং অনেক ক্ষেত্রে নাটকের উপস্থাপনায় তাঁর বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে কবীর চৌধুরীও বাংলাদেশের নাট্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সভাপতি এবং থিয়েটারের সব কাজে ওই সংগঠনের প্রধান পুরুষ রামেন্দু মজুমদার তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।
এক পর্বে তিনি আমেরিকার সাহিত্যপাঠের সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে। উপন্যাস ছাড়া তাঁর আরেকটি আগ্রহের বিষয় ছিল নাটক। মুনীর চৌধুরী যেমন নাটকের রচনায় ও অনুবাদে এবং অনেক ক্ষেত্রে নাটকের উপস্থাপনায় তাঁর বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে কবীর চৌধুরীও বাংলাদেশের নাট্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সভাপতি এবং থিয়েটারের সব কাজে ওই সংগঠনের প্রধান পুরুষ রামেন্দু মজুমদার তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।
উপন্যাস ও নাটকের বাইরে কবীর চৌধুরীর আগ্রহ ছিল কবিতায়। তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আরও অনেক তরুণ কবির কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তাঁর সব অনুবাদকর্মের একটি সাধারণ গুণ দেখা যায়, তা হলো অনুবাদের সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা। তাঁর অনেক অনুবাদকর্ম আমার কাছে দুঃসাহসী মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি অনুবাদের কোনো কর্মই দুঃসাধ্য বা অসাধ্য ভাবেননি। ফল হয়েছে এই যে, তাঁর হাত দিয়ে যত অনুবাদকর্ম আমরা পেয়েছি, তা বাংলাদেশের কোনো একক অনুবাদকের বেলায় দেখতে পাইনি।
প্রশ্ন হতে পারে, অনুবাদকর্মের এই দুঃসাহসী পুরুষ কীভাবে এবং কোন বিবেচনায় এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। এখানে তাঁর পেশাগত পরিচয়ের কথা এসে পড়ে। পেশায় তিনি ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং ইংরেজি সাহিত্যের বিশালতা ও ঐশ্বর্য তিনি তাঁর স্বদেশীয় পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন। বাংলাদেশের একজন ইংরেজির অধ্যাপক তাঁর সংকীর্ণ পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। আমার মনে হয়, এক বিশেষ দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁর সব সাহিত্যকর্মের, বিশেষত, অনুবাদকর্মের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে তিনি তাঁর পেশার অন্য শিক্ষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ছিলেন। অনেকেই তাঁর পথ ধরে বা তাঁর আদর্শ অনুসরণে অনুবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।
যেকোনো সাহিত্যের সূচনাপর্বে অনুবাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি সাহিত্যপাঠক তাঁর নিজের সাহিত্যের বাইরে বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে কৌতূহল মেটানোর মতো ভাষাজ্ঞান রাখেন না। তাঁদের মতো পাঠকের জন্য অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই এবং আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের অগুনতি সাহিত্যপাঠক, যাঁরা বয়সে তরুণ এবং যাঁরা সহজে ইংরেজি পাঠে অভ্যস্ত নন, তাঁদের জন্য কবীর চৌধুরী একটি বড় আশ্রয়ের স্থল।
কবীর চৌধুরী তাঁর কর্মজীবনে বিভিন্ন উচ্চদায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার পর তিনি দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। একপর্যায়ে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব পান। বাংলা একাডেমীর জীবনে তাঁর ওই কার্যকাল একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এ সময়ে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনায় বৈচিত্র্য এনেছিলেন তিনি। একাডেমীর যে পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতো এবং যেখানে বাংলাদেশের অনেক লেখকের গল্প-উপন্যাস-কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে ছাপা হয়েছে, ওই পত্রিকার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায় ছিল তাঁর কার্যকাল।
কবীর চৌধুরী তাঁর মধ্যবয়সের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে একটি মহৎ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবন এ দেশের রাজনৈতিক জীবনের অনেক ভাঙা-গড়ার চিহ্ন বহন করে। রাজনৈতিক জীবনে যখন স্বৈরাচারের প্রভাব তুঙ্গে ছিল, সে সময় যাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে আস্থা রেখেছিলেন এবং সেভাবে সব কর্মে তার প্রমাণ রেখেছিলেন, এঁদের অন্যতম কবীর চৌধুরী। সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একটি ধারা পাকিস্তানের ২৪ বছর চালু ছিল। সেই ধারায় থেকে এ দেশের লেখক-সাহিত্যিকেরা দীর্ঘকাল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উজ্জীবিত রেখেছেন। যাঁরা এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে কবীর চৌধুরীর নাম প্রথমেই করতে হবে। বয়স তাঁকে তাঁর এই প্রতিবাদী ভূমিকা থেকে দূরে রাখেনি এবং আজ আমরা যখন আমাদের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের অগ্রগতির কথা বলি, তখন তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
যেভাবে কবীর চৌধুরী চলে গেলেন, সেটা খুবই চরিত্রসম্মত। তিনি কাউকে কষ্ট দেননি এবং নিজেও কষ্ট পাননি। যতদূর জানা গেছে, এই সদা হাস্যমুখ মানুষটি হাসিমুখেই বিদায় নিলেন এ জীবন থেকে। তাঁর এই হাসিমুখ আমাদের অনেক সাহস ও সান্ত্বনার উৎস হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন হতে পারে, অনুবাদকর্মের এই দুঃসাহসী পুরুষ কীভাবে এবং কোন বিবেচনায় এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। এখানে তাঁর পেশাগত পরিচয়ের কথা এসে পড়ে। পেশায় তিনি ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং ইংরেজি সাহিত্যের বিশালতা ও ঐশ্বর্য তিনি তাঁর স্বদেশীয় পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন। বাংলাদেশের একজন ইংরেজির অধ্যাপক তাঁর সংকীর্ণ পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। আমার মনে হয়, এক বিশেষ দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁর সব সাহিত্যকর্মের, বিশেষত, অনুবাদকর্মের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে তিনি তাঁর পেশার অন্য শিক্ষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে ছিলেন। অনেকেই তাঁর পথ ধরে বা তাঁর আদর্শ অনুসরণে অনুবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।
যেকোনো সাহিত্যের সূচনাপর্বে অনুবাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি সাহিত্যপাঠক তাঁর নিজের সাহিত্যের বাইরে বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে কৌতূহল মেটানোর মতো ভাষাজ্ঞান রাখেন না। তাঁদের মতো পাঠকের জন্য অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই এবং আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের অগুনতি সাহিত্যপাঠক, যাঁরা বয়সে তরুণ এবং যাঁরা সহজে ইংরেজি পাঠে অভ্যস্ত নন, তাঁদের জন্য কবীর চৌধুরী একটি বড় আশ্রয়ের স্থল।
কবীর চৌধুরী তাঁর কর্মজীবনে বিভিন্ন উচ্চদায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার পর তিনি দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন। একপর্যায়ে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব পান। বাংলা একাডেমীর জীবনে তাঁর ওই কার্যকাল একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এ সময়ে বাংলা একাডেমীর প্রকাশনায় বৈচিত্র্য এনেছিলেন তিনি। একাডেমীর যে পত্রিকা ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতো এবং যেখানে বাংলাদেশের অনেক লেখকের গল্প-উপন্যাস-কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে ছাপা হয়েছে, ওই পত্রিকার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায় ছিল তাঁর কার্যকাল।
কবীর চৌধুরী তাঁর মধ্যবয়সের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে একটি মহৎ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবন এ দেশের রাজনৈতিক জীবনের অনেক ভাঙা-গড়ার চিহ্ন বহন করে। রাজনৈতিক জীবনে যখন স্বৈরাচারের প্রভাব তুঙ্গে ছিল, সে সময় যাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে আস্থা রেখেছিলেন এবং সেভাবে সব কর্মে তার প্রমাণ রেখেছিলেন, এঁদের অন্যতম কবীর চৌধুরী। সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একটি ধারা পাকিস্তানের ২৪ বছর চালু ছিল। সেই ধারায় থেকে এ দেশের লেখক-সাহিত্যিকেরা দীর্ঘকাল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উজ্জীবিত রেখেছেন। যাঁরা এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে কবীর চৌধুরীর নাম প্রথমেই করতে হবে। বয়স তাঁকে তাঁর এই প্রতিবাদী ভূমিকা থেকে দূরে রাখেনি এবং আজ আমরা যখন আমাদের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের অগ্রগতির কথা বলি, তখন তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
যেভাবে কবীর চৌধুরী চলে গেলেন, সেটা খুবই চরিত্রসম্মত। তিনি কাউকে কষ্ট দেননি এবং নিজেও কষ্ট পাননি। যতদূর জানা গেছে, এই সদা হাস্যমুখ মানুষটি হাসিমুখেই বিদায় নিলেন এ জীবন থেকে। তাঁর এই হাসিমুখ আমাদের অনেক সাহস ও সান্ত্বনার উৎস হয়ে থাকবে।
No comments