সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ
বাঁধার মুখে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের বিজয়যাত্রা সূচিত হয়েছে। এ ছবির নাম 'জীবন থেকে নেয়া'। জহির রায়হান পরিচালিত এ ছবিটি সেন্সরে নয়, শুটিং পর্যায়েই বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক ছবিই নির্মিত হয়েছে। চার দশকের যুদ্ধের ছবির ইতিহাস ফিরে দেখার প্রয়াসে। লিখেছেন মঈন আবদুল্লা সত্তর দশক : স্বাধীন বাংলার কাহিনীচিত্রের যাত্রা ১৯৭২ সালে শুরু হলেও বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের
অগ্রাভিযান শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালেই। নির্বাসিত স্বাধীন বাংলা সরকারের উদ্যোগে নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড' কেবল বাংলাদেশের নয়, যে কোনো দেশের মুক্তি-সংগ্রামের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের প্রথম ছবিতে বিজয় উল্লাস, জাতীয় ভাবাবেগ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। 'ওরা ১১ জন' ছবির মধ্যে তার ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। এরপর অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের ঘোষণা দেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই মুক্তি পায় চারটি ছবি। চাষী নজরুল ইসলামের 'ওরা ১১ জন', সুভাষ দত্তের 'অরুণোদয়ের অগি্নসাক্ষী', মমতাজ আলীর, 'রক্তাক্ত বাংলা' ও আনন্দের 'বাঘা বাঙালী'। এর মধ্যে প্রথম দুটি ছবিতে কমবেশি মুক্তিযুদ্ধের ছাপ রয়েছে। বাকি দুটি ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনার চেয়ে বাণিজ্যিক লক্ষ্যই বেশি কাজ করেছে বলে সমালোচকরা মন্তব্য করেন। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা'। ছবিটির তাৎপর্য ও তাৎক্ষণিকতার ঊধর্ে্ব উঠে গণহত্যা ও নির্যাতনের মানবিক দিক। এতে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছবিতেও মুক্তিযুদ্ধের মূল রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাপ্রবাহ উপজীব্য করা হয়নি। সত্তর দশকে চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিতীয় ছবি 'সংগ্রাম' নির্মাণ করেন। আলমগীর কুমকুম বানান 'আমার জন্মভূমি'। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে খান আতা বানান 'আবার তোরা মানুষ হ', মিতার 'আলোর মিছিল' ও হারুনুর রশীদের 'মেঘের অনেক রং'। এর মধ্যে 'মেঘের অনেক রং সমালোচকদের প্রশংসা পায়। ছবিটি বিভিন্ন শাখায় পায় জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার। সত্তর দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিগুলোতে যুদ্ধের আবহ থাকলেও সেভাবে যুদ্ধটা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন। এ প্রসঙ্গে চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানাতে যে আয়োজন দরকার হয়, আমরা সে রকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই ছবি নির্মাণ করেছি। ওরা ১১ জন ছবিতে সত্যিকারের অস্ত্র ব্যবহার করেছি। যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন। এরপর যত ছবি হয়েছে তাতে নির্দিষ্ট একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। তাই যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ রূপটা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি।'
আশির দশক : এ দশকে পুরো চলচ্চিত্র শিল্পটি পুঁজিসর্বস্ব হয়ে পড়ে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। এ রকম পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা একটা সংগ্রামের পথ হয়ে দাঁড়ায়। চলচ্চিত্রের এ সংগ্রামে আশার আলো নিয়ে এলো 'সূর্যদীঘল বাড়ী' ও 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' এবং 'ঘুড্ডি। চলচ্চিত্রে এ ত্রিমূর্তির সঙ্গে যোগ হয় পুনার শিক্ষা, ফিল্ম আর্কাইভস আর অনুদানের ত্রিভুজ উদ্যোগ। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে অনুদানপ্রাপ্ত তিনটি ছবি। জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভস আশ্রয় পেল জাতীয় গণভবনের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইনের মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়ল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। শুরু হলো সামরিক শাসন। এমন সময় 'আগামী' আর 'হুলিয়া' দিয়ে শুরু হলো এক নতুন আন্দোলন। এর সঙ্গে শহীদুল হক খান নির্মাণ করেন 'কলমীলতা'।
আশির দশকে ৫৬৭টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির সংখ্যা ছিল তিনটি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনীচিত্র নির্মিত হয়েছে এ সময়ে। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, 'দেশে যখন এরশাদের সামরিক শাসন শুরু হলো তখন চলচ্চিত্রের দুর্দিন চরমে। সে সময় গড়ে উঠল ১৬ মিলিমিটারের বিকল্প ফরম্যাট, বিকল্প প্রদর্শন ব্যবস্থা। সব সুস্থধারার ছবির অন্য নাম হয়ে পড়ল স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। এসব তৎপরতাই তখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বাঁচিয়ে রাখতে অবদান রেখেছে। তিন মিনিটের অ্যানিমেশন, প্রায় এক ঘণ্টার প্রামাণ্যচিত্র থেকে শুরু করে আড়াই ঘণ্টার ছবিকেও মানুষ ভালোবেসে ডাকল শর্টফিল্ম। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র সংকট থেকে উত্তরণে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা ছিল বেশি। অবশ্য এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের সব সমস্যা দূর হয়নি। এটিই বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয়।' নব্বইয়ের দশক : নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। তারপরও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত 'শঙ্খনীল কারাগার' ছবিটি তোলপাড় সৃষ্টি করে। মোস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত এ ছবিটি সরকারি অনুদানে নির্মিত। ১৯৯২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও চারটি শাখায় ছবিটি পুরস্কার পায়। ১৯৯৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম ছবি 'আগুনের পরশমণি'। এ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয় আসাদুজ্জামান নূরকে। আর নায়িকা হিসেবে বিপাশা হায়াতকে নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পরিবারের বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই এর গল্প। এরপর তিন বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো ছবি নির্মিত হয়নি।
১৯৯৬ সালে দুটি ছবি বেশ আলোচিত হয়। এগুলো হলো সেলিনা হোসেনের উপন্যাস নিয়ে আখতারুজ্জামানের 'পোকামাকড়ের ঘরবসতি' ও তানভীর মোকাম্মেলের 'নদীর নাম মধুমতী'। ১৯৯৭ সালে মোরশেদুল ইসলামের 'দুখাই' ও চাষী নজরুল ইসলামের 'হাঙ্গর নদী গ্রেনেড' প্রশংসা কুড়ায়। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। একই বছর খান আতাউর রহমান 'এখনো অনেক রাত' ছবিটি পরিচালনা করেন। এটি তার সর্বশেষ পরিচালিত ছবি।
চলচ্চিত্রে এ দশকে ৭৫৫টি ছবি মুক্তি পেলেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি হচ্ছে ৭টি। এত ছবির ভিড়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সরকারি অনুদান বন্ধ থাকাকে। এ প্রসঙ্গে সুভাষ দত্ত বলেন, 'আমাদের চলচ্চিত্রে এ দশকে মৌলিকত্বহীনতা, সৃজনশীলতার অভাব দেখা দেয়। অহেতুক বাণিজ্যের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া এ জন্য দায়ী। চলচ্চিত্র ক্রমাগত ভ্রান্তপথের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু হয় এ দশকে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানানোর মতো নির্মাতা কম ছিলেন।' ১৯৯৫ সালে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে তারেক মাসুদের 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা'। যুক্তরাষ্ট্রের আলোকচিত্রী লিয়ার লেতিনের ফুটেজ নিয়ে তথ্যভিত্তিক এ দুটি কাহিনীচিত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছে।
একবিংশ শতক : একুশ শতকে চলচ্চিত্র প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দেয় হুমায়ূন আহমেদের 'শ্রাবণ মেঘের দিন' ছবিটি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দেখতে দর্শক সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ২০০২ সালে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না'। যুদ্ধের ছবি না হলেও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর মুক্তির জন্য মানুষের হাহাকার উঠে এসেছে এ ছবিতে। এই দশকে ২০০৫ সাল ছিল মুক্তিযুদ্ধের ছবির জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত। একই বছরে চাষী নজরুল ইসলামের 'মেঘের পরে মেঘ', হুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামলছায়া' ও তৌকীর আহমেদের 'জয়যাত্রা'। তৌকীর পরিচালিত প্রথম ছবি নিয়ে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ বলেছিলেন, 'এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে কয়টি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তা স্বাধীন ধারায় নির্মিত হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ জয়যাত্রা। আশা করি, মুক্তিযুদ্ধ ও চলচ্চিত্র সংগ্রামের এ জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে।'
এবং গেরিলা : ২০১১ সালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত 'গেরিলা' মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করে দারুণ প্রশংসিত হন পরিচালক। ছবিটি দেশের বাইরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার অর্জন করে। এখন ছবিটি সারাদেশে প্রদর্শিত হচ্ছে। গেরিলা উৎসব চলবে ডিসেম্বরজুড়ে। একই সালে মোরশেদুল ইসলামের 'আমার বন্ধু রাশেদ' ছবিটিও প্রশংসিত হয়েছে। শিশুতোষ ছবি হওয়ায় এটিও দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেছে।
কিছু কথা : নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের কথা, ক্ষতের কথা এবং চেতনা ও অর্জনের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আরেকটি কথা না বললেই নয়। শুধু নির্মাতাদের ওপরই নির্ভর করে না মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ। সহযোগিতা দরকার সেনাবাহিনী ও সরকারের। কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়।'
তৌকীর আহমেদ বলেন, 'একটি ছবি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। এত টাকা লগি্ন করার মতো প্রযোজক পাওয়া মুশকিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে উদ্যোক্তা কম।'
তানভীর মোকাম্মেল বলেন, 'সরকারের অনুদান প্রথা বদলাতে হবে এবং অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ছবির কর মওকুফ করতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে এটি শুরু হয়েছে। এতে প্রযোজকরা নতুন করে উৎসাহী হবেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য।'
আশির দশক : এ দশকে পুরো চলচ্চিত্র শিল্পটি পুঁজিসর্বস্ব হয়ে পড়ে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। এ রকম পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা একটা সংগ্রামের পথ হয়ে দাঁড়ায়। চলচ্চিত্রের এ সংগ্রামে আশার আলো নিয়ে এলো 'সূর্যদীঘল বাড়ী' ও 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' এবং 'ঘুড্ডি। চলচ্চিত্রে এ ত্রিমূর্তির সঙ্গে যোগ হয় পুনার শিক্ষা, ফিল্ম আর্কাইভস আর অনুদানের ত্রিভুজ উদ্যোগ। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে অনুদানপ্রাপ্ত তিনটি ছবি। জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভস আশ্রয় পেল জাতীয় গণভবনের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইনের মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়ল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। শুরু হলো সামরিক শাসন। এমন সময় 'আগামী' আর 'হুলিয়া' দিয়ে শুরু হলো এক নতুন আন্দোলন। এর সঙ্গে শহীদুল হক খান নির্মাণ করেন 'কলমীলতা'।
আশির দশকে ৫৬৭টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। কিন্তু তাতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির সংখ্যা ছিল তিনটি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনীচিত্র নির্মিত হয়েছে এ সময়ে। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, 'দেশে যখন এরশাদের সামরিক শাসন শুরু হলো তখন চলচ্চিত্রের দুর্দিন চরমে। সে সময় গড়ে উঠল ১৬ মিলিমিটারের বিকল্প ফরম্যাট, বিকল্প প্রদর্শন ব্যবস্থা। সব সুস্থধারার ছবির অন্য নাম হয়ে পড়ল স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। এসব তৎপরতাই তখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বাঁচিয়ে রাখতে অবদান রেখেছে। তিন মিনিটের অ্যানিমেশন, প্রায় এক ঘণ্টার প্রামাণ্যচিত্র থেকে শুরু করে আড়াই ঘণ্টার ছবিকেও মানুষ ভালোবেসে ডাকল শর্টফিল্ম। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র সংকট থেকে উত্তরণে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা ছিল বেশি। অবশ্য এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের সব সমস্যা দূর হয়নি। এটিই বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয়।' নব্বইয়ের দশক : নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। তারপরও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত 'শঙ্খনীল কারাগার' ছবিটি তোলপাড় সৃষ্টি করে। মোস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত এ ছবিটি সরকারি অনুদানে নির্মিত। ১৯৯২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও চারটি শাখায় ছবিটি পুরস্কার পায়। ১৯৯৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম ছবি 'আগুনের পরশমণি'। এ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয় আসাদুজ্জামান নূরকে। আর নায়িকা হিসেবে বিপাশা হায়াতকে নেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পরিবারের বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই এর গল্প। এরপর তিন বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো ছবি নির্মিত হয়নি।
১৯৯৬ সালে দুটি ছবি বেশ আলোচিত হয়। এগুলো হলো সেলিনা হোসেনের উপন্যাস নিয়ে আখতারুজ্জামানের 'পোকামাকড়ের ঘরবসতি' ও তানভীর মোকাম্মেলের 'নদীর নাম মধুমতী'। ১৯৯৭ সালে মোরশেদুল ইসলামের 'দুখাই' ও চাষী নজরুল ইসলামের 'হাঙ্গর নদী গ্রেনেড' প্রশংসা কুড়ায়। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। একই বছর খান আতাউর রহমান 'এখনো অনেক রাত' ছবিটি পরিচালনা করেন। এটি তার সর্বশেষ পরিচালিত ছবি।
চলচ্চিত্রে এ দশকে ৭৫৫টি ছবি মুক্তি পেলেও মুক্তিযুদ্ধের ছবি হচ্ছে ৭টি। এত ছবির ভিড়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সরকারি অনুদান বন্ধ থাকাকে। এ প্রসঙ্গে সুভাষ দত্ত বলেন, 'আমাদের চলচ্চিত্রে এ দশকে মৌলিকত্বহীনতা, সৃজনশীলতার অভাব দেখা দেয়। অহেতুক বাণিজ্যের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া এ জন্য দায়ী। চলচ্চিত্র ক্রমাগত ভ্রান্তপথের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু হয় এ দশকে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানানোর মতো নির্মাতা কম ছিলেন।' ১৯৯৫ সালে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে তারেক মাসুদের 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা'। যুক্তরাষ্ট্রের আলোকচিত্রী লিয়ার লেতিনের ফুটেজ নিয়ে তথ্যভিত্তিক এ দুটি কাহিনীচিত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছে।
একবিংশ শতক : একুশ শতকে চলচ্চিত্র প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দেয় হুমায়ূন আহমেদের 'শ্রাবণ মেঘের দিন' ছবিটি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দেখতে দর্শক সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ২০০২ সালে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না'। যুদ্ধের ছবি না হলেও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর মুক্তির জন্য মানুষের হাহাকার উঠে এসেছে এ ছবিতে। এই দশকে ২০০৫ সাল ছিল মুক্তিযুদ্ধের ছবির জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত। একই বছরে চাষী নজরুল ইসলামের 'মেঘের পরে মেঘ', হুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামলছায়া' ও তৌকীর আহমেদের 'জয়যাত্রা'। তৌকীর পরিচালিত প্রথম ছবি নিয়ে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ বলেছিলেন, 'এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে কয়টি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তা স্বাধীন ধারায় নির্মিত হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ জয়যাত্রা। আশা করি, মুক্তিযুদ্ধ ও চলচ্চিত্র সংগ্রামের এ জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে।'
এবং গেরিলা : ২০১১ সালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত 'গেরিলা' মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করে দারুণ প্রশংসিত হন পরিচালক। ছবিটি দেশের বাইরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার অর্জন করে। এখন ছবিটি সারাদেশে প্রদর্শিত হচ্ছে। গেরিলা উৎসব চলবে ডিসেম্বরজুড়ে। একই সালে মোরশেদুল ইসলামের 'আমার বন্ধু রাশেদ' ছবিটিও প্রশংসিত হয়েছে। শিশুতোষ ছবি হওয়ায় এটিও দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেছে।
কিছু কথা : নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের কথা, ক্ষতের কথা এবং চেতনা ও অর্জনের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আরেকটি কথা না বললেই নয়। শুধু নির্মাতাদের ওপরই নির্ভর করে না মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ। সহযোগিতা দরকার সেনাবাহিনী ও সরকারের। কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়।'
তৌকীর আহমেদ বলেন, 'একটি ছবি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। এত টাকা লগি্ন করার মতো প্রযোজক পাওয়া মুশকিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে উদ্যোক্তা কম।'
তানভীর মোকাম্মেল বলেন, 'সরকারের অনুদান প্রথা বদলাতে হবে এবং অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ছবির কর মওকুফ করতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে এটি শুরু হয়েছে। এতে প্রযোজকরা নতুন করে উৎসাহী হবেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য।'
No comments