আরেক আলোকে-সরকারের ব্যর্থতা কতকাল চেয়ে দেখব? by ইনাম আহমেদ চৌধুরী
আইনের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গুপ্তহত্যা, গুম, অপহরণ, আইনি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন বছরের খতিয়ানে আমরা এসব অপরাধের পরিসংখ্যানের ক্রমাবনতি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে সবচেয়ে শঙ্কার কথা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়ে গেছে এ মাস মানবাধিকার দিবসের মাস, এ মাস বিজয় অর্জনের মাস; আর এই মাস বাংলার আশাহত মানুষের
স্বপ্নভঙ্গেরও মাস। যে আশা, যে স্বপ্ন নিয়ে এক রক্তঝরা সংগ্রাম অন্তে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল, সে আশা আজ তিরোহিতপ্রায়, স্বপ্ন আজ ভূলুণ্ঠিত। সংবিধানে নির্ধারিত আমাদের ঐতিহাসিক প্রিয় রাজধানী ঢাকাও আজ দ্বিখণ্ডিত। সামরিক বাহিনী সংস্থাপিত সরকারের মেয়াদের অবসানে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল, তারা দিনবদলের স্লোগান দিয়ে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ফলাফলে কী দেখি? মানুষের সহজাত সর্বজনীন নূ্যনতম ভালোভাবে বাঁচার অধিকার ক্রমেই অপসৃয়মান।
প্রথমেই আসে অর্থনৈতিক অধিকারের কথা। মানুষ কর্মসংস্থান চায়, আহার-বাসস্থান চায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে প্রসারিত করতে চায়। কিন্তু অর্থনৈতিক আকাশে আমরা দেখছি শুধু দুর্যোগের ঘনঘটা নয়, সত্যিকার অর্থেই একটি বিপর্যয়। দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগের অনুপস্থিতি, ডলারের হাইজ্যাম্প, দুর্বল শিল্প খাত, দেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি, রিজার্ভের পতন, সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা (পাঁচ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি)। এই দুঃসহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে দেশের একজন নিরপেক্ষ ব্যাংকার-অর্থনীতিবিদ (যাকে সরকার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছিল), সেই ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, 'একের পর এক সরকারের পরাজয় হচ্ছে।' তিনি আরও বলেছেন, 'শেয়ারবাজারের ধস, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীর মরণ ছোবল_ এর জন্য দায়ী শক্তিশালীদের আড়াল করছে সরকার।' রক্ষকই যেখানে ভক্ষক, তখন সাধারণ মানুষ এই সরকারের কাছ থেকে কী মৌলিক-মানবিক অধিকার আশা করতে পারে! আইনের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গুপ্তহত্যা, গুম, অপহরণ, আইনি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন বছরের খতিয়ানে আমরা এসব অপরাধের পরিসংখ্যানের ক্রমাবনতি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে সবচেয়ে শঙ্কার কথা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়ে গেছে। অবস্থা বর্ণনায় আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, 'গুম হয়ে যাওয়া গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকার মানে ব্যর্থরাষ্ট্রের পদধ্বনি শোনা। ক্রসফায়ার যে ক্রমান্বয়ে এমন দিকেই এগিয়ে যাবে, সেটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল।'
এ ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, 'রাষ্ট্র যখন কারও অধিকার বা সুবিধা ক্ষুণ্ন করে, সেটা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন। কাউকে গ্রেফতারের পর হত্যা করে তার বৈধতার জন্য তার বিরুদ্ধে অতীতের বিভিন্ন মামলা ও অপরাধের ফিরিস্তি দেওয়া আইনসিদ্ধ নয়। প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।' কিন্তু এসব ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। গুপ্তহত্যা থামছে না। গুম করা মানুষের লাশ আশুলিয়া আর নদীতে পরিত্যক্ত পাওয়া যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের কথা, পুলিশ বা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে তদন্তই করছে না। তাদের যদি বক্তব্য হয় যে পুলিশ বা র্যাব এসব দুষ্কর্ম করছে না, তাহলে তদন্ত করে দোষী বা অপরাধীদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা নেই কেন?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূতপূর্ব উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এ ব্যাপারে তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, 'এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে কথা বলেছি, তারা কিছুই বলতে পারেনি।' গত ১১ মাসে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে ২২ জন অপহৃত হয়েছে। এর মধ্যে আবার অধিকাংশেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। অধিকাংশ অপহরণই হয়েছে পুলিশ বা র্যাবের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউনিফরমও পরা ছিল। পুলিশ বা র্যাব যদি এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে চায়, তাহলে তারা কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। যখনই অপহরণ বা গ্রেফতার করার জন্য কোথাও অভিযান চালানো হয়, তখনই পুলিশ বা র্যাবের কাছে খবর জানানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। যাতে করে তারা এর আইনগত দিক সম্পর্কে জানাতে পারে এবং হস্তক্ষেপ করে অপহরণের মতো ঘটনা বন্ধ করতে পারে। এ জন্য হটলাইন স্থাপন করে তা জনগণকে জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তেমন কিছুই তো হচ্ছে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ৩৫৯ জনের এ জাতীয় মৃত্যু হয়েছে। হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩২৯ জনের। তিন বছরে নিখোঁজ ৪০ জন। তাছাড়া অন্যান্য পুলিশি নির্যাতনের কথা তো আছেই।
পুলিশ হেফাজতে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে ছুরিকাহত করা হয়। বিরোধী দলের চিফ হুইপ ফারুককে জাতির চোখের সামনে টেনে-হেঁচড়ে অহেতুক নির্যাতন করে তাকে মারাত্মক আহত করা হয়। এগুলো তো হচ্ছে জনগণের চোখের সামনে গণতন্ত্রের ওপরই ছুরিকাঘাত।
ঢাকার একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে অপহরণ করার পর দু'বছরেও হদিস মিলল না। বাংলার মানুষের কাছে সাদা মাইক্রোবাস একটি বিভীষিকার ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্যজনভাবে এই ধরনের সাদা মাইক্রোবাসের উপস্থিতির কথা আমরা শুনেছি বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময়, শুনেছি বিভিন্ন অপহরণের সময়। বিরোধীদলীয় ছাত্রনেতাদেরও উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শামীম হোসেন সোহেল, ইসমাইল হোসেন ও মাসুমের ভাগ্যেও তাই ঘটেছিল। এর মধ্যে দু'জনের লাশ পরে পাওয়া যায়। হাইকোর্ট একটি কেসে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশই দিয়েছেন ছাত্র আবদুল কাদেরকে অহেতুক নির্যাতনের কারণে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। পুলিশি নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; কিন্তু প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। সাংবাদিক হত্যা, মামলা, গ্রেফতারের ঘটনাও বহু ঘটেছে। আমি আরও দুটি বিশেষ ধরনের নাগরিক অধিকার খর্ব করার কথা বলতে চাচ্ছি। একটি হচ্ছে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ব্যর্থতা। গত ১১ মাসে সীমান্তে ২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতীয় বিএসএফ হত্যা করেছে। বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানির কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলানো রক্তাক্ত লাশের চিত্র কখনও জনগণের মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়। সরকার জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদও করতে পারে না। অধিকার নামে একটি মানবাধিকার সংস্থা সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান ছাড়াও জানিয়েছে, বিএসএফ বহু বাংলাদেশি অপহরণ করেছে, যাদের হদিস মেলেনি।
বহমান আন্তর্জাতিক প্রবাহ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা দিয়ে গঙ্গার জলস্রোত বন্ধ। এদিকে আমরা দেখছি টিপাইমুখে একটি সর্বনাশা বাঁধের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বীতরাগ। এগুলো কি মানবাধিকার লালনে সরকারের ব্যর্থতা নয়?
বিজয়ের এই মাসে তাই এ প্রশ্নই জাগে, স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা আর কতকাল চেয়ে দেখব, সয়ে থাকব!
ইনাম আহমেদ চৌধুরী :সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
প্রথমেই আসে অর্থনৈতিক অধিকারের কথা। মানুষ কর্মসংস্থান চায়, আহার-বাসস্থান চায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে প্রসারিত করতে চায়। কিন্তু অর্থনৈতিক আকাশে আমরা দেখছি শুধু দুর্যোগের ঘনঘটা নয়, সত্যিকার অর্থেই একটি বিপর্যয়। দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগের অনুপস্থিতি, ডলারের হাইজ্যাম্প, দুর্বল শিল্প খাত, দেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি, রিজার্ভের পতন, সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা (পাঁচ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি)। এই দুঃসহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে দেশের একজন নিরপেক্ষ ব্যাংকার-অর্থনীতিবিদ (যাকে সরকার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছিল), সেই ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, 'একের পর এক সরকারের পরাজয় হচ্ছে।' তিনি আরও বলেছেন, 'শেয়ারবাজারের ধস, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীর মরণ ছোবল_ এর জন্য দায়ী শক্তিশালীদের আড়াল করছে সরকার।' রক্ষকই যেখানে ভক্ষক, তখন সাধারণ মানুষ এই সরকারের কাছ থেকে কী মৌলিক-মানবিক অধিকার আশা করতে পারে! আইনের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গুপ্তহত্যা, গুম, অপহরণ, আইনি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন বছরের খতিয়ানে আমরা এসব অপরাধের পরিসংখ্যানের ক্রমাবনতি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে সবচেয়ে শঙ্কার কথা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়ে গেছে। অবস্থা বর্ণনায় আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, 'গুম হয়ে যাওয়া গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকার মানে ব্যর্থরাষ্ট্রের পদধ্বনি শোনা। ক্রসফায়ার যে ক্রমান্বয়ে এমন দিকেই এগিয়ে যাবে, সেটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল।'
এ ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, 'রাষ্ট্র যখন কারও অধিকার বা সুবিধা ক্ষুণ্ন করে, সেটা হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন। কাউকে গ্রেফতারের পর হত্যা করে তার বৈধতার জন্য তার বিরুদ্ধে অতীতের বিভিন্ন মামলা ও অপরাধের ফিরিস্তি দেওয়া আইনসিদ্ধ নয়। প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।' কিন্তু এসব ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না। গুপ্তহত্যা থামছে না। গুম করা মানুষের লাশ আশুলিয়া আর নদীতে পরিত্যক্ত পাওয়া যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের কথা, পুলিশ বা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে তদন্তই করছে না। তাদের যদি বক্তব্য হয় যে পুলিশ বা র্যাব এসব দুষ্কর্ম করছে না, তাহলে তদন্ত করে দোষী বা অপরাধীদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা নেই কেন?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূতপূর্ব উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এ ব্যাপারে তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, 'এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে কথা বলেছি, তারা কিছুই বলতে পারেনি।' গত ১১ মাসে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে ২২ জন অপহৃত হয়েছে। এর মধ্যে আবার অধিকাংশেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। অধিকাংশ অপহরণই হয়েছে পুলিশ বা র্যাবের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউনিফরমও পরা ছিল। পুলিশ বা র্যাব যদি এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে চায়, তাহলে তারা কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। যখনই অপহরণ বা গ্রেফতার করার জন্য কোথাও অভিযান চালানো হয়, তখনই পুলিশ বা র্যাবের কাছে খবর জানানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। যাতে করে তারা এর আইনগত দিক সম্পর্কে জানাতে পারে এবং হস্তক্ষেপ করে অপহরণের মতো ঘটনা বন্ধ করতে পারে। এ জন্য হটলাইন স্থাপন করে তা জনগণকে জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তেমন কিছুই তো হচ্ছে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ৩৫৯ জনের এ জাতীয় মৃত্যু হয়েছে। হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩২৯ জনের। তিন বছরে নিখোঁজ ৪০ জন। তাছাড়া অন্যান্য পুলিশি নির্যাতনের কথা তো আছেই।
পুলিশ হেফাজতে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে ছুরিকাহত করা হয়। বিরোধী দলের চিফ হুইপ ফারুককে জাতির চোখের সামনে টেনে-হেঁচড়ে অহেতুক নির্যাতন করে তাকে মারাত্মক আহত করা হয়। এগুলো তো হচ্ছে জনগণের চোখের সামনে গণতন্ত্রের ওপরই ছুরিকাঘাত।
ঢাকার একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে অপহরণ করার পর দু'বছরেও হদিস মিলল না। বাংলার মানুষের কাছে সাদা মাইক্রোবাস একটি বিভীষিকার ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্যজনভাবে এই ধরনের সাদা মাইক্রোবাসের উপস্থিতির কথা আমরা শুনেছি বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময়, শুনেছি বিভিন্ন অপহরণের সময়। বিরোধীদলীয় ছাত্রনেতাদেরও উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শামীম হোসেন সোহেল, ইসমাইল হোসেন ও মাসুমের ভাগ্যেও তাই ঘটেছিল। এর মধ্যে দু'জনের লাশ পরে পাওয়া যায়। হাইকোর্ট একটি কেসে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশই দিয়েছেন ছাত্র আবদুল কাদেরকে অহেতুক নির্যাতনের কারণে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। পুলিশি নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; কিন্তু প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। সাংবাদিক হত্যা, মামলা, গ্রেফতারের ঘটনাও বহু ঘটেছে। আমি আরও দুটি বিশেষ ধরনের নাগরিক অধিকার খর্ব করার কথা বলতে চাচ্ছি। একটি হচ্ছে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ব্যর্থতা। গত ১১ মাসে সীমান্তে ২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতীয় বিএসএফ হত্যা করেছে। বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানির কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলানো রক্তাক্ত লাশের চিত্র কখনও জনগণের মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়। সরকার জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদও করতে পারে না। অধিকার নামে একটি মানবাধিকার সংস্থা সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান ছাড়াও জানিয়েছে, বিএসএফ বহু বাংলাদেশি অপহরণ করেছে, যাদের হদিস মেলেনি।
বহমান আন্তর্জাতিক প্রবাহ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু তিস্তা নদীর ন্যায্য হিস্যা আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা দিয়ে গঙ্গার জলস্রোত বন্ধ। এদিকে আমরা দেখছি টিপাইমুখে একটি সর্বনাশা বাঁধের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বীতরাগ। এগুলো কি মানবাধিকার লালনে সরকারের ব্যর্থতা নয়?
বিজয়ের এই মাসে তাই এ প্রশ্নই জাগে, স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা আর কতকাল চেয়ে দেখব, সয়ে থাকব!
ইনাম আহমেদ চৌধুরী :সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
No comments