রাজনীতি-সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! by সুভাষ সাহা

গোলাম আযম অসাধারণ নিপুণতায় অর্ধসত্য ও মিথ্যার মিশেল দিয়ে তৈরি টিভিতে সম্প্রচারিত বক্তব্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে তার সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ অস্বীকার করলেন। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধকেও তিনি প্রকারান্তরে ভারতীয় পক্ষপুটে চলে যাওয়ার ষড়যন্ত্ররূপেও চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোক বলেন ভালো। ৮৯ বছর বয়স। অনেকের নামধাম, আদর্শ, রাজনীতি সম্পর্কে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারেন।


আবার বলার সময় অনেক সত্যও অর্ধসত্য বা মিথ্যার আড়ালে চেপে যেতে পারেন ঠিক আগের মতো। পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলে থাকবেন, আমি কার কথা বলতে চাইছি। হ্যাঁ, আমি গোলাম আযমের কথাই বলছি। টিভিতে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শুনতে শুনতে বারবার চমকে উঠেছি। যখন তিনি অর্ধসত্য আর মিথ্যার আড়ালে একাত্তর সালে তার বিরুদ্ধে আনা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগগুলো ভুয়া, মিথ্যা ইত্যাকার শব্দ ব্যবহার করে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জনদরদি-অবতার সাজছিলেন, তখন বারবার একাত্তরে যুদ্ধের সময় এখানে দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনীর লে. কর্নেল (অব.) নাদির আলীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ের কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য এ বছরের মার্চে তিনি বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একাত্তরের ভূমিকা সম্পর্কে তার বক্তব্য পত্রিকায় পড়ে আমি তার সম্পর্কে আরও উৎসাহী হয়ে উঠি। মনে মনে ভাবি, বাঙালির বজ্রকঠিন সংকল্পের মাস একাত্তরের এই সময়ে তার একটি সাক্ষাৎকার নিতে পারলে ভালো হয় না! শারীরিক অসুস্থতার কারণে তরুণ সাংবাদিক বিভূতিভূষণ মিত্রকেও সঙ্গে নিলাম। ১৯ মার্চ, শনিবার খুব সকালে নাদির আলীর ঢাকায় ওঠার স্থান ব্র্যাক ইনে গিয়ে হাজির হলাম। বুঝলাম কর্নেল তখনও প্রাতঃকর্ম সেরে প্রস্তুত হননি। ইন্টারকমে তিনি আমাদের ওপরে এসে লাউঞ্জে অপেক্ষা করার জন্য বললেন। কিছুক্ষণ পর তিনি সস্ত্রীক রুম থেকে বেরিয়েই আমার দিকে এসে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। কয়েক ঘণ্টা পরই তার প্লেন ধরার জন্য বিমানবন্দর যাওয়ার কথা। অবশেষে নাশতা সেরেই তিনি লাউঞ্জে চলে এলেন। আলাপের শুরুতেই তিনি আমার পুরো পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি বললাম_ আসলে একাত্তরে আমরা দু'জন ছিলাম দুই মেরুর বাসিন্দা। নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেই আমার প্রতি তার সশ্রদ্ধ দৃষ্টি লক্ষ্য করলাম। এতে নিজেকে গর্বিত মনে হলো। সামান্য পরিচয় শেষে শুরু হলো সাক্ষাৎকার পর্ব। এক পর্যায়ে মনে হলো_ আচ্ছা, সে সময়ে গোলাম আযম, ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ কোনো সংযোগ ছিল কি-না, জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়! কর্নেল পাকিস্তানি সৈন্যরা কী কায়দায় বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল তার বিবরণ যেভাবে দিচ্ছিলেন, তা শুনে আমার শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। আমার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ দেখেই কর্নেল কিছু একটা আঁচ করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে তিনি আমার কাছে খুব কমই বলেছেন। এসব বর্বরতা-নিষ্ঠুরতার দৃশ্য দেখে কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই পাকিস্তান ফিরে গিয়েছিলেন। এরপর অসুস্থ হয়েছিলেন অনেক দিন। বেশ কয়েক বছর পর সুস্থ হয়ে ফিরলেন। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয়, একজন উর্দু কবি হিসেবে।
সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি একাত্তরে পাকিস্তানের দালালদের সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করলেন। বললেন, এরা সিভিলিয়ান হয়েও আমাদের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করার কথা বলত। আর তাদের সে কথা সেনাবাহিনীর লোক হয়েও তাদের শুনতে হতো। কারণ ওপর থেকে সে ধরনেরই নির্দেশ ছিল। আমি পরিস্থিতি অনুকূল বুঝে দীর্ঘক্ষণ মনে পুষে রাখা প্রসঙ্গটির অবতারণা করলাম। কর্নেল বললেন, তিনি এদের অনেককেই চিনতেন। গোলাম আযম, ফজলুল কাদের চৌধুরী... অনেকেই তার কাছে আসত। এরা তার কাছে হিন্দু, আওয়ামী লীগার, মুক্তি ও ভারতীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে অপারেশনের ফর্দ দিত। একবার গোলাম আযমদের পরামর্শ অনুযায়ী অপারেশন করতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রচুর লোককে হত্যা করে। পরে জানা যায়, হতাহতরা সবাই নিরীহ সাধারণ মানুষ ছিলেন। এভাবেই এদের সম্পর্কে তার মধ্যে একটা চরম বিতৃষ্ণার ভাব জন্মেছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অথচ গোলাম আযম অসাধারণ নিপুণতায় অর্ধসত্য ও মিথ্যার মিশেল দিয়ে তৈরি টিভিতে সম্প্রচারিত বক্তব্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে তার সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ অস্বীকার করলেন। শুধু তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধকেও তিনি প্রকারান্তরে ভারতীয় পক্ষপুটে চলে যাওয়ার ষড়যন্ত্ররূপেও চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। এভাবে তিনি একাত্তরে তার এবং তার সঙ্গীদের নাজায়েজ কাজকে জায়েজ করতে চেষ্টা করেছেন। সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
শেষ পর্যন্ত এই ভেবেই সান্ত্বনা খুঁজলাম_ সব অপরাধীই প্রথমে সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে, পরে চাপে পড়লে নিজের কৃতকর্মের পক্ষে হাজারটা যুক্তি উত্থাপন করে। এদের লজ্জা-শরম বলতে কিছু থাকে না। গোলাম আযমদের মতো ঘাগু রাজনৈতিক অপরাধীদের চোখের পর্দা থাকে না, এই সত্যটি এভাবেই আরেকবার উপলব্ধি করলাম।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.