সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর উদ্যোগ by আবুল কাশেম
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকের বর্ধিত আমানতের সুদের হারের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিদ্যমান সুদের হার কম হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কারণ কাঙ্ক্ষিত মুনাফার সুযোগ না থাকায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। ফলে অর্থবছরজুড়ে এ খাত থেকে সরকারের যেখানে ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা, সেখানে চার মাসে মিলেছে মাত্র ৫৯০ কোটি টাকা।
ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে ঋণের জোগান কমে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকের আমানতের সুদের হার বিবেচনা করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তাগিদ পাওয়ার পর ইতিমধ্যে জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর থেকে তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১.৫০ শতাংশ ও পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১২.৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগসীমা প্রত্যাহারের প্রস্তাবও করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানো-সংক্রান্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি শিগগরিই নতুন সুদহার চূড়ান্ত করবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মোট ছয় ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি স্কিমগুলো হলো_পরিবার সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড। আর তিন বছর মেয়াদি স্কিমগুলো হলো_তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক।
সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে অন্যতম নীতিনির্ধারক ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়াতে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির হার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও পরিবর্তন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা চালু হয়নি। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোও আমানতের বিপরীতে সুদের হার বাড়িয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।' তিনি বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের সঙ্গে স্পষ্ট পার্থক্য রেখে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করবে। না হলে মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে না।
জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালক মাহমুদা আক্তার সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর ক্ষমতা পরিদপ্তরের নেই। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সরকার গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি সুদের হার পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।'
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদান্তে মুনাফার হার ১২.০৭ শতাংশ। একই মেয়াদের পেনশনার সঞ্চয়পত্রের নিট মুনাফার হার ১১.৮১ শতাংশ, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের নিট মুনাফার হার ১১.৫৫ শতাংশ ও ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার ১১.৮০ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর এসব স্কিমের সুদের হার বাড়িয়ে ১২.৫০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে।
এ ছাড়া তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মেয়াদান্তে নিট মুনাফা ১০.৭৮ শতাংশ ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের তিন বছর মেয়াদি হিসাবের মুনাফার হার ১০ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে। এসব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়ে ১১.৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে সঞ্চয় পরিদপ্তর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ২০ নভেম্বর ইকোনমিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে সঞ্চয় পরিদপ্তর থেকে পাঠানো প্রতিবেদন দেখে হতাশা ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ওই সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ সঞ্চয়পত্রও বিক্রি না হওয়ায় সুদের হার বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। পরে জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরকে সুদের হার কিভাবে কতটা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর ভিত্তিতেই সুদের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সুদের হার বাড়ানোর প্রস্তাবে সঞ্চয় পরিদপ্তর বলছে, শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ৬.৪০ শতাংশ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৯.২৫ শতাংশ, পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার (পেনশনার) ১৪.৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় মূল্যস্ফীতি ৩.৪০ শতাংশ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৩.৫০ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যস্ফীতি ৩.৪৩ শতাংশ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির হার ১১.৪১ শতাংশ হলেও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম।
প্রস্তাবে বিভিন্ন ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের সঙ্গে তুলনা করে সঞ্চয় পরিদপ্তর বলছে, আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুদের হার বেশি না হলে কেউই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ঝুঁকবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে তিন মাস মেয়াদি আমানতে ৮.৫ শতাংশ, ছয় মাসে ৯ শতাংশ, ১২ মাসে ৯.৫০ শতাংশ এবং দু-তিন বছর মেয়াদি আমানতে ১০ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে। আর বেসরকারি মার্কেন্টাইল ও এঙ্মি ব্যাংক এক মাস থেকে ১২ মাস মেয়াদি আমানতে ১২ শতাংশ এবং ছয় বছরে দ্বিগুণ মুনাফা দিচ্ছে। এ হিসাবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কম। তা ছাড়া সঞ্চয়পত্রের অর্জিত মুনাফার ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত উৎসে কর প্রযোজ্য রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গত অর্থবছরে সরকারের ঋণের চাহিদা খুব একটা ছিল না। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করেছিল সরকার। এ জন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর প্রযোজ্য করাসহ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের ফটোকপিসহ নানা তথ্য বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা ছিল না। সেখানে সরকার সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার বিধান তৈরি করে। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় জাতীয় বিনিয়োগ বন্ড। তা সত্ত্বেও গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে এক হাজার ৯২৩ কোটি টাকা পেয়েছিল সরকার। বিদ্যমান বিধানাবলি ঠিক থাকলেও চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় জনগণ। চলতি অর্থবছরের চার মাসে এ খাত থেকে সরকারের দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সম্ভব হয়েছে মাত্র ৫৯০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ৮০৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ কমে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১৯ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫২ কোটি টাকা।
No comments