চরাচর-পত্রিকাপ্রেমী কাশেম আলী
কাশেম আলী। বয়স ৫০। পেশায় ঠেলাগাড়িচালক। লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। আরো কয়েক ক্লাস পড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিলেন। কিন্তু পরিবারের ঘানি টানতে বই-খাতা ছেড়ে তাঁকে ধরতে হয়েছিল হালের লাঙল। তখন স্কুলের মাস্টারও লেখাপড়া ছাড়তে বারণ করেছিলেন তাঁকে। তবুও তিনি আর স্কুলমুখী হতে পারেননি। পত্রিকা পড়তে পড়তে এভাবেই অবলীলায় তাঁর মনের কথাগুলো বলতে লাগলেন কাশেম আলী।
হবিগঞ্জ জেলার লোকরা ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে তাঁর আদি নিবাস। বাবা নায়েব আলীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠেলাগাড়ি চালান তিনি। এ থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই সংসার চালান। কিন্তু সারা দিনের এই হাড়ভাঙা খাটুনির পর একটু সময় পেলেই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেন তিনি। স্বল্প আয় দিয়ে নিজে কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই, তাই যখন যে দোকানে পত্রিকা চোখে পড়ে, তখন সে দোকানেই পড়তে বসে যান। সেটা হোক সকাল-বিকেল কিংবা সন্ধ্যা। নির্ধারিত কোনো দোকানে নয়, নির্দিষ্ট কোনো পত্রিকাও নয়, যেদিন যে দোকানে, যে জাতের পত্রিকা পান_সেটাই পড়েন তিনি। তবুও প্রতিদিন একবার না একবার তাঁকে পত্রিকা পড়তেই হবে। তাঁর পত্রিকা পড়ার আগ্রহ দেখে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন তিনি? এর জবাব জানতে গিয়ে জানা গেল কাশেম আলীর দুঃখভরা জীবনের কথা। তাঁদের ছিল বাবা-চাচার যৌথ পরিবার। ১০-১২ একর কৃষিজমি চাষ করেই চলে যেত সংসার। কাশেম আলীর বাবা ছিলেন খরম পাইয়া (কাজকাম কিছু করতেন না)। একসময় জমিজমা ভাগ হয়ে গেল। একদিন কাশেম আলী স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁর বাবা তাঁকে বললেন, আমার মতো তোমরাও খরমপাইয়া হয়ে গেলে জমিজমা চাষ করবে কে। তখন বাবার কথা শুনে তিনি হাত থেকে বই-খাতা ঘরে রেখে দিলেন। জমি চাষ করে সংসার চালাতে লাগলেন। কিন্তু পরপর তিনবারের বন্যায় খোয়াই নদের ভাঙনে কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। লেখাপড়া জানা নেই, কৃষিজমিও নেই। সংসার চালাবেন কিভাবে। এদিকে নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশ অচল। তখন অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শ্রীমঙ্গল পাড়ি জমান তিনি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ঠেলাগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দেশের খবর জানতেই তিনি নিয়মিত পত্রিকা পড়েন বলে জানান। তবে তিনি রাগ করে বলেন, পত্রিকার মালিকরা সত্য কথার সঙ্গে মিথ্যা কথাও লেখেন। আবার যেকোনো খবর একটু ভালো করে পড়লে সত্য-মিথ্যা বুঝে নেওয়া যায়। তিনি দেশের রাজনীতির খবরটাই বেশি পড়েন।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
No comments