স্মরণ-বেনিন ট্র্যাজেডি: মৃত্যুহীন প্রাণ by ওয়ালিউল্লাহ্

বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিভিন্ন পদবির কর্মকর্তারা ২০০৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর সুদূর আফ্রিকার বেনিনের সাগর পাড়ে এ দেশের মানুষকে শোকে মুহ্যমান করে শোকগাথা রচনা করে গেছেন। ২৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ বাহিনীর জন্য একটি শোকাবহ দিন হয়ে রয়েছে। সারা বছরের কর্মক্লান্ত দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফেরার দিনটি যে এত বিষাদময় হবে, তা কখনোই লে. কর্নেল সামছুল আরেফিন, মেজর আবদুর রহিম, রওনক আক্তার, ইমতিয়াজ,


মোস্তাফিজ, মোশারফ, বাতেন, ক্যাপ্টেন আরিফ, ফরিদ, আলাউদ্দিন, রকিবুল, জাহিদুল, রফিক, মাবুদ ও সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার শফিকুল ইসলামের পরিবার ভাবতে পারেনি। এসব অফিসারেরা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকায় সিয়েরালিয়ন ও লাইবেরিয়াতে শান্তি রক্ষার জন্য দায়িত্ব পালন করছিলেন। দেশগুলোর জনগণের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহ বিপন্ন করেছে মানবতাকে। যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, যুদ্ধরত অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি, ভিটেমাটি ছাড়া দুস্থ জনগণকে পুনর্বাসন, গৃহ নির্মাণ, খাদ্যের সংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রশাসনিক অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা করা শান্তিরক্ষী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল।
নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য নেতৃত্ব সুলভ গুণাবলির অভাব পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বৈরিতা, সমগ্র আফ্রিকায় শান্তিকে করেছে বিপন্ন। শিশুর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ রেহাই পায়নি সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে। যে বালকটি স্কুল ছেড়েছে, তার আর ফিরে যাওয়া হয়নি বিদ্যায়তনে, যে পরিবারটি গ্রামছাড়া হয়েছে, আর সে ফিরে যেতে পারেনি তার গ্রামটিতে। লাখো মানুষের আবাসস্থল হয়েছে পরবাসে। এই বিপন্ন মানবতার তরে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা। হূদয় দিয়ে ভালোবেসে ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ দেশের জনগণকে সেনা চিকিৎসক দল সেবা দিয়ে মন জয় করেছে। অবকাঠামো নির্মাণ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সেনা প্রকৌশলী দল। বিদ্যালয়ে ফেরার পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করেন সেনা সদস্যরা। সব পদবির কর্মকর্তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করেছেন দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে। দেশটির নিরাপত্তা বিধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন আমাদের সেনা সদস্যরা। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধ করেছেন।
ব্যস্ত দিনগুলো যখন কঠোর পরিশ্রমে অতিবাহিত হচ্ছিল এবং শান্তিরক্ষী বাহিনীর বাংলাদেশি সদস্যরা যখন সে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রয়াসে লিপ্ত, সে মুহূর্তে নিজ দেশে প্রিয়জন অশ্রুসজল নয়নে অপেক্ষা করছিলেন ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য। অপেক্ষা করছিলেন কখন ফিরবেন তাঁদের প্রিয়জন, কাছে বসে শুনতে পারবেন প্রতিদিনগুলোর কথা। কিন্তু সেদিন আর ফিরে আসেনি। অনেক না বলা কথা বলা হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর ২০০৩ এমনি একটি দিন, যে দিনটি শান্তিরক্ষী বাহিনীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে বাংলাদেশের ১৫ জন শান্তিরক্ষীর নাম। ২০০৩ সালের এ দিনটিতে কর্তব্য পালন শেষে তাঁরা ফিরছিলেন দেশে অবকাশ যাপনের জন্য। অকুতোভয় সেনা কর্মকর্তারা সে দেশের মানুষের নিবিড় পরিচর্যা করছিলেন। তাঁদের অসমাপ্ত কাজ ফিরে গিয়ে করারও প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু সে কাজ আর সমাপ্ত করা গেল না, পরিবারকে আর সময় দেওয়া হলো না।
যদিও তাঁদের মৃত্যুতে আত্মত্যাগের গাথা রচিত হয়েছে, কিন্তু এ মৃত্যু জাতির আত্মোৎসর্গকারী সূর্যসন্তানদের ছিনিয়ে নিয়েছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা কর্তব্যপরায়ণতার সর্বোৎকৃষ্ট অবদান রেখে বাংলাদেশের পতাকা হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর পর্যন্ত উড্ডীয়ন করেছেন। লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিয়নে কর্তব্যরত এই ১৫ জন বীর সেনানি বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা ও জাতিসংঘের সাদা-নীল পতাকায় আচ্ছাদিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। এ হলো বীরের ইহজগত থেকে পরলোকে প্রস্থান। এ দেশের মানুষের সঙ্গে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এসব সেনানিকে দিয়েছে বীরের মর্যাদা। শান্তিরক্ষী বাহিনীর সব সদস্য এ মহাপ্রয়াণে অনুপ্রাণিত হবেন যুগ যুগ ধরে। প্রতিবছর শোকাভিভূত পরিবারগুলো শোকে মুহ্যমান হলেও আজও গর্ব ভরে স্মরণ করে বেনিনে তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা, সন্তান, স্বামী ও ভাইয়ের কথা। এ শোক থেকে উৎসারিত হচ্ছে শক্তি—যা অনাদিকাল ধরে অনুপ্রাণিত করবে সব শান্তিকামী মানুষকে।
লে. কর্নেল ওয়ালিউল্লাহ্ (অব.): সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.