রঙ্গব্যঙ্গ-হ্যালো মিস্টার টেন পার্সেন্ট! by মোস্তফা কামাল
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। জারদারির বড় কপাল। পাকিস্তানজুড়ে যাঁর দুর্নাম মিস্টার টেন পার্সেন্ট হিসেবে, তিনি হয়ে গেলেন দেশটির কর্ণধার! বেনজির আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার সৌভাগ্য হয় জারদারির। বেনজির যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন সব ধরনের তদবির-কাজের মধ্যস্থতা করতেন জারদারি। কোনো প্রকল্পের অর্থমূল্য যদি হয় কোটি টাকা, তাহলে জারদারিকে টেন পার্সেন্ট হিসেবে দিতে হতো ১০ লাখ টাকা। টেন পার্সেন্ট হাতে না পেলে
বেনজির তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইলই উত্থাপন করা হতো না। সে কথা মনে রেখেছে দেশটির সেনাবাহিনী। বিচার বিভাগও ভুলে যায়নি অতীত। তা ছাড়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা জারদারির আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তাই তাঁকে প্রেসিডেন্ট করা নিয়ে এই দুই পক্ষই আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু বেনজিরের জন্য আবেগ তখন পাকিস্তানিদের হৃদয়ে। সেই আবেগ এবং পিপিপির প্রতি আমেরিকার সমর্থনকে কায়দামতো কাজে লাগিয়েছেন জারদারি। সেই থেকে তাঁর পদে পদে বিপদ!
জারদারির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে বেনজিরের গ্রামের বাড়ি লারকানায়। সেখানে তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শতাধিক প্রতিনিধি। জারদারি তখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির যুগ্ম চেয়ারম্যান। ছেলে বিলাওয়ালের অনুপস্থিতিতে তিনিই হয়ে ওঠেন পিপিপির প্রধান। সাক্ষাৎকার চাওয়ার পর তিন দিন অপেক্ষা করতে হলো। তারপর ডাক পড়ল। একটা উঁচু ধারণা নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। কারণ অঙ্ফোর্ড পড়ুয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা বেনজিরের স্বামী নিশ্চয়ই মহাজ্ঞানী কেউ হবেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার নিয়ে রীতিমতো হতাশ হলাম।
যাহোক, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলে কথা! এখন ইচ্ছা করলেই আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে পারব না। তাই পাঠকদের উদ্দেশে আমরা তাঁর একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার তুলে ধরছি।
'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি কেমন আছেন?'
'মহা ঝামেলায় আছি। আর ঝামেলার সময়ই আপনি এসে হাজির!'
'আমাকে চিনতে পেরেছেন তাহলে?'
'চিনব না! আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনি ঢাকা থেকে এসে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন!'
'মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ। তো, এখন কী অবস্থা?'
'আর্মি বড়ই যন্ত্রণা করছে।'
'কী রকম?'
'আমাকে তারা কেন জানি সহ্য করতে পারছে না। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার সময়ও তারা বাগড়া দিয়েছিল। সেটা যখন টেকেনি, তখন থেকেই তারা আমাকে চাপে রেখেছে। দেখছেন না, আমার সরকারকে অজনপ্রিয় করতে তারা একের পর এক অঘটন ঘটাচ্ছে। অথচ তারাই এখন প্রচার করছে, আমি নাকি অজনপ্রিয়! কী হাস্যকর! তারা পরিকল্পনা করে অঘটনগুলো ঘটাচ্ছে! বুঝতে পারছেন? আইএসআই প্রধান আমার সামনে এসে কাঁচুমাচু করে বলে, স্যার, আপনি ছাড়া পাকিস্তান অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। আবার ভেতরে ভেতরে আর্মির পক্ষে কাজ করছে। আর্মিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।'
'বলেন কী!'
'আরে ব্রাদার! এরা যে কি বজ্জাত তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর্মি ছাড়া এরা কিছু বোঝে না। এরা সাধারণ মানুষকে বলে 'ব্লাডি সিভিলিয়ান'! সিভিলিয়ান সরকার বা গণতন্ত্র এরা দেখতে চায় না। বিপদে পড়লে লোক দেখানো সরকার বদল করে। কিন্তু নাটাইটা ওদের হাতেই রাখে। আমি আমেরিকাকে বলেছি, আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলে সরাসরি রাখতে হবে। ভায়া আর্মি হয়ে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। এতে ওদের আঁতে ঘা লেগেছে। বুঝতে পারছেন? সেই থেকেই আমার সরকারকে অজনপ্রিয় করার পরিকল্পনা নিয়েছে ওরা।'
'এখন আমেরিকা কী বলে?'
'তারা আর কী বলবে? কেউ বিপদে পড়লে তাকে সহায়তা না করে তাকে খাদে ফালানোর চেষ্টা করে। কাজেই আমেরিকার সঙ্গে থাকাও তো বিপদ!'
'জনগণও তো আপনার কাজে হ্যাপি না!'
'কিভাবে হ্যাপি থাকবে? আর্মি তো আমাকে কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না! আমি বারবার বলে আসছি, লাদেন, মোল্লা ওমর, জাওয়াহিরি_এই উগ্রপন্থী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিও না। আর্মি আমার কথা শোনেনি। আমি তো জানি, আমেরিকার কাছে তাদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে! তারা সুযোগ মতো লাদেনের ওপর হামলা চালিয়েছে! এখন বলা হচ্ছে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমি নাকি ব্যর্থ। আচ্ছা আপনিই বলেন ব্রাদার! আমি ব্যর্থ, না আর্মি ব্যর্থ? তা ছাড়া আমেরিকার সেনারা যখন পাকিস্তানে ঢুকল তখন আমাদের আইএসআই কী করল? তারা কি তখন চোখ বন্ধ করে ছিল?'
'আর্মি আসলে কী চায়?'
'কী চায় বোঝেন না? ক্ষমতা চায়, ক্ষমতা! ক্ষমতার বাইরে ওরা যে বেমানান! দেখেন তো, ওরা আমাকে অজনপ্রিয় বলার কে? আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেছি। পাঁচ বছর শেষ হোক! না, আমাকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে!'
'কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই তো আপনাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরানো যাবে না!'
'সে কারণেই তো এত ষড়যন্ত্র! আর্মি আমাকে অসুস্থ বানাচ্ছে।'
'আপনি কি আসলে অসুস্থ?'
'অসুস্থ ছিলাম। এখন পুরোপুরি সুস্থ।'
'সামরিক অভ্যুত্থানের ভয়ে আপনি নাকি আমেরিকার সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন?'
'দেশের সামনে বিপদ দেখলে আমি তো বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তা চাইবই। এতে আর্মির এত গা জ্বলে কেন?'
'আরেকটা প্রশ্ন করি? আপনাকে মিস্টার টেন পার্সেন্ট বলা হয় কেন?'
'ব্রাদার, আপনি এত খোঁচাখুঁচি কেন করেন? আপনি বোঝেন না, এ সবই আর্মির প্রোপাগান্ডা! বুঝতে পারছেন? একটি কথা আপনাকে স্পষ্ট করে বলি, আমার হারানোর কিছু নেই। আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। আর্মির পাতা ফাঁদে আমরা পা দেব না।'
'ওকে, ধন্যবাদ।'
'আপনাকেও ধন্যবাদ!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
জারদারির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে বেনজিরের গ্রামের বাড়ি লারকানায়। সেখানে তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শতাধিক প্রতিনিধি। জারদারি তখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির যুগ্ম চেয়ারম্যান। ছেলে বিলাওয়ালের অনুপস্থিতিতে তিনিই হয়ে ওঠেন পিপিপির প্রধান। সাক্ষাৎকার চাওয়ার পর তিন দিন অপেক্ষা করতে হলো। তারপর ডাক পড়ল। একটা উঁচু ধারণা নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। কারণ অঙ্ফোর্ড পড়ুয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা বেনজিরের স্বামী নিশ্চয়ই মহাজ্ঞানী কেউ হবেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার নিয়ে রীতিমতো হতাশ হলাম।
যাহোক, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলে কথা! এখন ইচ্ছা করলেই আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে পারব না। তাই পাঠকদের উদ্দেশে আমরা তাঁর একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার তুলে ধরছি।
'মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি কেমন আছেন?'
'মহা ঝামেলায় আছি। আর ঝামেলার সময়ই আপনি এসে হাজির!'
'আমাকে চিনতে পেরেছেন তাহলে?'
'চিনব না! আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনি ঢাকা থেকে এসে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন!'
'মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ। তো, এখন কী অবস্থা?'
'আর্মি বড়ই যন্ত্রণা করছে।'
'কী রকম?'
'আমাকে তারা কেন জানি সহ্য করতে পারছে না। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার সময়ও তারা বাগড়া দিয়েছিল। সেটা যখন টেকেনি, তখন থেকেই তারা আমাকে চাপে রেখেছে। দেখছেন না, আমার সরকারকে অজনপ্রিয় করতে তারা একের পর এক অঘটন ঘটাচ্ছে। অথচ তারাই এখন প্রচার করছে, আমি নাকি অজনপ্রিয়! কী হাস্যকর! তারা পরিকল্পনা করে অঘটনগুলো ঘটাচ্ছে! বুঝতে পারছেন? আইএসআই প্রধান আমার সামনে এসে কাঁচুমাচু করে বলে, স্যার, আপনি ছাড়া পাকিস্তান অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। আবার ভেতরে ভেতরে আর্মির পক্ষে কাজ করছে। আর্মিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।'
'বলেন কী!'
'আরে ব্রাদার! এরা যে কি বজ্জাত তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর্মি ছাড়া এরা কিছু বোঝে না। এরা সাধারণ মানুষকে বলে 'ব্লাডি সিভিলিয়ান'! সিভিলিয়ান সরকার বা গণতন্ত্র এরা দেখতে চায় না। বিপদে পড়লে লোক দেখানো সরকার বদল করে। কিন্তু নাটাইটা ওদের হাতেই রাখে। আমি আমেরিকাকে বলেছি, আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলে সরাসরি রাখতে হবে। ভায়া আর্মি হয়ে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। এতে ওদের আঁতে ঘা লেগেছে। বুঝতে পারছেন? সেই থেকেই আমার সরকারকে অজনপ্রিয় করার পরিকল্পনা নিয়েছে ওরা।'
'এখন আমেরিকা কী বলে?'
'তারা আর কী বলবে? কেউ বিপদে পড়লে তাকে সহায়তা না করে তাকে খাদে ফালানোর চেষ্টা করে। কাজেই আমেরিকার সঙ্গে থাকাও তো বিপদ!'
'জনগণও তো আপনার কাজে হ্যাপি না!'
'কিভাবে হ্যাপি থাকবে? আর্মি তো আমাকে কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না! আমি বারবার বলে আসছি, লাদেন, মোল্লা ওমর, জাওয়াহিরি_এই উগ্রপন্থী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিও না। আর্মি আমার কথা শোনেনি। আমি তো জানি, আমেরিকার কাছে তাদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে! তারা সুযোগ মতো লাদেনের ওপর হামলা চালিয়েছে! এখন বলা হচ্ছে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমি নাকি ব্যর্থ। আচ্ছা আপনিই বলেন ব্রাদার! আমি ব্যর্থ, না আর্মি ব্যর্থ? তা ছাড়া আমেরিকার সেনারা যখন পাকিস্তানে ঢুকল তখন আমাদের আইএসআই কী করল? তারা কি তখন চোখ বন্ধ করে ছিল?'
'আর্মি আসলে কী চায়?'
'কী চায় বোঝেন না? ক্ষমতা চায়, ক্ষমতা! ক্ষমতার বাইরে ওরা যে বেমানান! দেখেন তো, ওরা আমাকে অজনপ্রিয় বলার কে? আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেছি। পাঁচ বছর শেষ হোক! না, আমাকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে!'
'কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই তো আপনাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরানো যাবে না!'
'সে কারণেই তো এত ষড়যন্ত্র! আর্মি আমাকে অসুস্থ বানাচ্ছে।'
'আপনি কি আসলে অসুস্থ?'
'অসুস্থ ছিলাম। এখন পুরোপুরি সুস্থ।'
'সামরিক অভ্যুত্থানের ভয়ে আপনি নাকি আমেরিকার সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন?'
'দেশের সামনে বিপদ দেখলে আমি তো বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তা চাইবই। এতে আর্মির এত গা জ্বলে কেন?'
'আরেকটা প্রশ্ন করি? আপনাকে মিস্টার টেন পার্সেন্ট বলা হয় কেন?'
'ব্রাদার, আপনি এত খোঁচাখুঁচি কেন করেন? আপনি বোঝেন না, এ সবই আর্মির প্রোপাগান্ডা! বুঝতে পারছেন? একটি কথা আপনাকে স্পষ্ট করে বলি, আমার হারানোর কিছু নেই। আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। আর্মির পাতা ফাঁদে আমরা পা দেব না।'
'ওকে, ধন্যবাদ।'
'আপনাকেও ধন্যবাদ!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments