জৈব সার ব্যবহারে যত বাধা by এ এম এম শওকত আলী

বাংলাদেশে বর্তমানে জৈব ও অজৈব সার ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে অজৈব বা রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাত্রাই বেশি। অন্যদিকে জৈব সার কৃষক পর্যায়ে আবহমানকাল ধরেই ব্যবহৃত হয়। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জৈব প্রক্রিয়ায় ফসল উৎপাদন করার বিষয়ে প্রচারকাজও চালু হয়েছে। যুক্তি হলো, জৈব প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত ফসল অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, এর ফলে মাটির উর্বরা শক্তি সুরক্ষা সম্ভব। বর্তমানে অন্যান্য যুক্তিও এ বিষয়ে প্রদর্শন করা হয়।


এক. বিশ্বব্যাপী জ্বালানিদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এর ফলে অজৈব সারের মূল্যও বেড়েছে। দুই. অজৈব সার সব সময় পাওয়া যায় না বিশেষ করে আমদানিনির্ভর দেশে। অজৈব সারে ভেজালেরও আশঙ্কা রয়েছে। তিন. অজৈব সারনির্ভর দেশে এ সারের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পায়। চার. খসড়া কৃষিনীতিতে জমির উর্বরতা রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এসব কারণে জৈব সার উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগবান্ধব-নীতি প্রয়োজন।
বাংলাদেশে জৈব সার ব্যবহারের প্রকৃত অবস্থা কী? কৃষক পর্যায়ে এর ব্যবহার কৃষি মন্ত্রণালয় উৎসাহিত করে থাকে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে বর্তমান কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশে কম্পোস্ট তৈরি ও ব্যবহারের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল। এর ফলে গ্রামে গ্রামে কম্পোস্ট তৈরির জন্য যথেষ্ট উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। ওই সময় ধনচে চাষের জন্যও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের উৎসাহিত করেছিল। উলি্লখিত সময়কালে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা বর্তমানে অনেকাংশে স্তিমিত। তখন এমন সংবাদও প্রকাশিত হয় যে সিরাজগঞ্জের কোনো এক গ্রামের মহিলা ব্যাপক হারে কম্পোস্ট তৈরি ও বিপণন করে লাভবান হয়েছিলেন। একই সময়ে খবর পাওয়া যায় যে একটি এনজিও ঢাকায় বর্জ্য ব্যবহার করে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করেছিল। এ ধরনের উদ্যোগ যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অতি উত্তম বিষয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নগরের বসতবাড়িতে ফুলের শৌখিন চাষ আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। জমির দুষ্প্রাপ্যতা হেতু এ ধরনের চাষ ছাদের ওপরে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও বিষয়টি দেখানো হয়। জৈব সার এ ধরনের চাষের জন্য উপযোগী। এ সারের বহুবিধ উপকারিতা সত্ত্বেও এর উৎপাদন ও বিপণন যথেষ্ট নয়। কারণ সার উৎপাদন ও বিপণনে আইনি নিয়ন্ত্রণ।
নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে দেশে সর্বপ্রথম সার উৎপাদন ও বিপণনের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক আইনি আদেশ জারি করা হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে এ আদেশ অধিকতর সুসংহত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ভেজাল সার তৈরি ও বিপণনে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকরী করা। ২০০৬ সালে আইনি আদেশ বিলুপ্ত করে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়। এর শিরোনাম_'কৃষিকাজে ব্যবহার্য সার ও সার জাতীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন, আমদানি, সংরক্ষণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রণীত আইন'। শিরোনামটি কিছুটা হলেও উদ্ভট। বিতরণ, বিপণন ও বিক্রয় অনেকাংশে সমার্থক। মূলত ভেজাল বা নিম্নমানের সার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রয় বন্ধ করে এর মাধ্যমে কৃষকদের সুরক্ষা করাই এই আইনের উদ্দেশ্য। শুধু কৃষকরাই নয়, জমির উর্বরতাও রক্ষা করা। উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রশ্নাতীত। পরিবেশদূষণ রোধও ছিল এর অন্য একটি প্রধান উদ্দেশ্য। সারের নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করলে জমির উর্বরতা হ্রাসসহ পরিবেশদূষণের আশঙ্কা থেকেই যায়। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রণীত আদেশে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণনে কোনো বাধাই ছিল না। কারণ জৈব সারের উৎপাদন ও অধিকতর ব্যবহার উৎসাহিত করাই ছিল অনুসৃত সরকারি নীতি। নিয়ন্ত্রণ করলে সে লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। তবে নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু বেসরকারি ব্যবসায়ী জৈব সার উৎপাদন ও বিপণনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ওই সময় এ নিয়ে কৃষি গবেষক পর্যায়ে আপত্তি উত্থাপিত হয়। ফলে জৈব সারের জন্য বিনির্দেশও প্রণীত হয়। বলা হয়, নির্ধারিত বিনির্দেশ অনুযায়ী জৈব সার প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য নিবন্ধনেরও প্রয়োজন হবে। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ২০০৬ সালে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের সময় মন্ত্রিপরিষদে জৈব সার আইনের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আলোচিত হয়। তখন মন্ত্রিপরিষদ সভায় বিষয়টি বিবেচিত হয়ে জৈব সারকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে কোনো এক অদৃশ্য কারণে ২০০৬ সালের আইন সংশোধন করে জৈব সারকেও আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কারণেই অনেকের মতে, এ ধরনের উৎপাদন ও বিপণনে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি হয়। আইনের বিভিন্ন বিধানে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা লঙ্ঘন করলে বিভিন্ন মেয়াদে অন্তত ছয় মাস থেকে দুই বছর কারাদণ্ড হবে। অনেকের মতে, এ বিধান জৈব সার উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে ভীতিপ্রদ। এটা মোটেই এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব নয়। অন্যদিকে কিছু অতিউৎসাহী আইন প্রয়োগকারী এসব ধারার অপব্যবহার করতেও পারে। যদিও আইনে কেবল নির্বাচিত পরিদর্শক সারের নমুনা সংগ্রহ ও সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে নমুনা বিশ্লেষণের বিধান রয়েছে, তবুও আইনের অপব্যবহার অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করার আশঙ্কা অবশ্যই থেকে যায়। এ ছাড়া রয়েছে বিপক্ষীয় যুক্তি। তা হলো, নির্ধারিত বিনির্দেশ অমান্য করে উৎপাদন ও বিপণন করলে কৃষক অথবা অন্য ব্যবহারকারীরা প্রতারিত হবেন। তবে এর অন্য কোনো বিকল্প কি নেই। বিকল্প কী তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জৈব সার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও মাত্রা অধিক বা বিশাল হওয়ার কথা নয়। প্রথমেই এর উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণমূলক বেড়াজালে শৃঙ্খলাবদ্ধ করলে এর ব্যবহার কোনো দিন সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
আইনের ভীতিকর পরিবেশ ছাড়াও পদ্ধতিগত জটিলতাও রয়েছে। সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে আইনের একটি বিধান হলো, উৎপাদককে উৎপাদিত সার বা সার জাতীয় দ্রব্যের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য কারখানায় একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান যথার্থ হলেও জৈব সারের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা সহজেই অনুমেয়। এ অনুশাসন বাধ্যতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নেই। সার জাতীয় দ্রব্যের মধ্যে কম্পোস্টও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কম্পোস্ট সার উৎপাদনের জন্য কচুরিপানা, গোবর ও মাটির প্রয়োজন হয়। কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজনেই নিজ বাড়ির আঙিনায় অথবা রাস্তার ধারে গর্তের মধ্যে এ সার তৈরি করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ সার বিপণনও করা হয়। এর জন্য নিবন্ধনের ও পরীক্ষাগারের প্রয়োজন কেন? অবশ্য প্রয়োগকারী সংস্থা এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করে না। কিন্তু এর পরও প্রশ্ন থেকে যায়, যা আগেই বলা হয়েছে। মূল আইনে সারের সংজ্ঞায়ও সার জাতীয় দ্রব্য অন্তর্ভুক্ত। সার জাতীয় দ্রব্য শব্দটি অস্পষ্ট।
২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল সরকার জৈব সারের বিনির্দেশ (Method ) গেজেট বিজ্ঞপ্তির আকারে প্রকাশ করে। এর সঙ্গে অন্যান্য শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়। এক. জৈব সার জৈব উৎস থেকে তৈরি হতে হবে। অজৈব উৎস যথা_প্লাস্টিক অথবা বিষাক্ত বর্জ্য (ঐড়ংঢ়রঃধষ ডধংঃব) ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। যেসব উৎস থেকে জৈব সার প্রস্তুত করা হয়েছে, জৈব সারের মান নির্ধারণের জন্য দাখিলকৃত আবেদনপত্রে তার নাম বা উৎস সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এ শর্ত আপত্তিকর নয়। দুই. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ কারিগরি উপকমিটির আহ্বায়ক কর্তৃক মনোনীত বারি/বিনা/এসআরডিআইর দুইজন প্রতিনিধি সরেজমিন জৈব সার উৎপাদনের স্থান পরিদর্শন করে দৈব চয়নের ভিত্তিতে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাবে। উল্লেখ্য বারি, বিনা, এসআরডিআই, বিএসটিআই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোনো তিনটি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষিত হবে। পরীক্ষার Method (১৯৩১-৩৬) অনুসরণ করা হবে। প্রশ্ন করা যায়, তিনটি কেন? দুটি হলেই তো হয়। যে Method-এর কথা বলা হয়েছে তা বহু পুরনো। এর মধ্যে কোনো নতুন গবঃযড়ফ আবিষ্কৃত হয়েছে কি না তা কি কেউ জানে। এ ছাড়া জৈব সারের মান নির্ধারণের কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অপেক্ষা করতে হবে। চার. নিবন্ধন পাওয়ার পর দৈব চয়নের ভিত্তিতে জৈব সারের নমুনা সংগ্রহ করে বিনির্দিষ্ট গবেষণা ও পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হবে। যথাযথ মান বজায় না থাকলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ শর্তের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ বিপণন-পরবর্তী সময়ে এমন ত্রুটি ধরা পড়লে আইন প্রয়োগ করা যায়। পাঁচ. বিদেশে উৎপাদিত কোনো জৈব সার দেশে আমদানি বা বিপণন করা যাবে না। এ শর্ত কেন? এর একটাই উদ্দেশ্য হতে পারে। তা হলো, দেশজ জৈব সারকে উৎসাহিত করা। ছয়. জৈব সারের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য Integrated Plant Nutrient System (IPNS) পদ্ধতিতে ফিল্ড ট্রায়াল করে এর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করতে হবে। এ শর্ত কেন? অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ হলো গবেষকদের চলমান কাজ। এর বিশ্লেষণের জন্য তো উদ্যোক্তা দায়ী নয়। ভোক্তা সুফল না পেলে ব্যবহার করবে না। বিষয়টি ভোক্তার ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো।
মূল প্রশ্নটি হলো, জৈব সারের বিনির্দেশ প্রণয়ন ও পরবর্তী সময়ে এর অনুমোদনের প্রয়োজন আছে কি না। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ প্রথা রয়েছে। তবে পদ্ধতিগত জটিলতা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মতো নয়। এ অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে সার্বিক বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয় পরীক্ষা করে দেখতে পারে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.