রাজনীতি-আবদুর রাজ্জাক ও কিছু ভাবনা by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যু আমাদের সবাইকে এমন এক যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন বাঙালির রাজনীতি ছিল স্বচ্ছ ও তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কল্যাণ। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক, যে আদর্শ আমরা আমাদের বর্তমান সময় খুব একটা খুঁজে পাই না। তিনি আমাদের অনেকের মতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত ছিলেন। বোধ করি বঙ্গবন্ধুর ওপর তাঁর বিশ্বাসটা অন্য কারও চেয়ে একটু বেশিই
ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা এই যে, আবদুর রাজ্জাক এমনই একসময় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি তার উদ্দেশ্য, তার আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিল এবং রাজ্জাক ছিলেন ওই সব তরুণ রাজনীতিবিদের দলে, যাঁদের মধ্যে ছিল এমন একটি স্বপ্ন, যে স্বপ্নের দ্বারা তাঁরা একটি নতুন দেশ গড়ার লক্ষ্যে যতটা পথ যাওয়া দরকার, ততটা পথ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং ওই দলে ছিলেন তোফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। ছিলেন আরও অনেকে এবং তাঁরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের অনেকেই অনেক দফায় কারাগারে গেছেন কেবল পাকিস্তান আমলেই নয়, বরঞ্চ স্বাধীন বাংলাদেশেও।
আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুর কারণেই হয়তো এসব ভাবনা আমাদের সবার মনে আবার ফিরে এসেছে। মনে পড়ে যায় সেই সব দিনগুলোর কথা, যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গোটা জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিল। রাজ্জাক ছিলেন যুবক এবং অন্যান্য তরুণ নেতার মতো তিনিও তাঁর নিজের মতো করে দেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান রাখার চেষ্টা করেন। তিনি লালবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই ১৯৭২-৭৩ সালে এবং তিনি যে একজন ভালো সংগঠক ছিলেন, তার প্রমাণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ই দিয়েছেন, যখন তিনি মুজিব বাহিনীতে একটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রশ্ন উঠতে পারে এবং ওঠাই স্বাভাবিক যে, মুজিব বাহিনী কতটা আপামর মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। এটা সত্য যে, সে সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কোণঠাসা করতে শেখ মণি ও তাঁর সঙ্গে যেসব তরুণ নেতা ছিলেন, তাঁরা সবাই ব্যস্ত ছিলেন। তাজউদ্দীনের শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি যে দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং যে যোগ্যতার সঙ্গে মুজিবনগর সরকারকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেন সেই বাস্তবতা আজ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অংশ। কেবল দুঃখ এটাই যে, তখনকার তরুণ নেতারা তাজউদ্দীনকে তাঁদের সমর্থন দেয়নি এবং আমাদের দুঃখটা আরও ঘনীভূত হয়, যখন স্বাধীনতা লাভের পর তাঁদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের সঙ্গেও দূরত্ব হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দেন। আজ এতগুলো বছর পরে আমাদের এটা ভুলতে অসুবিধা হয় যে, যে দিন তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিতে হলো, সে দিন থেকেই আমাদের জাতীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারালাম। আর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখেই তাজউদ্দীন আহমদও আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। তাঁর সঙ্গে চলে গেলেন আরও তিনজন মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতা আমাদের।
এসব চিন্তাভাবনা এসে গেল আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে। তাঁর ও তাঁর যুগের অন্যান্যও তরুণ নেতার বিষয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজ্জাক ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশের আদর্শ সব সময় সমুন্নত রেখেছেন। হয়তো তাঁরা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছেন ১৯৭১ সালের পর, কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, তাঁরা সবাই সব সময় দেশের কথা ভেবেছেন, তাঁদের সবার মধ্যেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রদীপ সর্বদা জ্বলে চলেছে। রব ও সিরাজ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করলেন। মাখন কোনো একসময় আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। শেখ মণি সেই ১৫ আগস্টের কালরাতেই নিহত হলেন। তোফায়েল আহমদ, যাঁর কাছ থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু শব্দটি প্রথম শুনি, তিনি সেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রইলেন। তাঁর আরও ওপরে থাকার কথা ছিল দেশের রাজনীতিতে। কিন্তু রাজনীতি যখন পরিবার-নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন খুব একটা বড় কিছু আমরা আশা করতে পারি না। আর তোফায়েল আহমদের মতো বড় মাপের মানুষ সেই পারিবারিক রাজনীতির শিকার হয়ে পড়েন এবং কোনো একসময় হারিয়ে যান। যেমনটি কিছুটা আবদুর রাজ্জাকও হারিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারে তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে। তিনি অবশ্য পানিসম্পদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বেশ ভালোভাবেই সে কাজটি করেছেন। তবুও তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর দক্ষতা আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার কাজে লাগাতে পারত, তাঁকে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়ে। যেমনটি করা যেত তোফায়েল আহমদের ব্যাপারেও। বোধ করি বর্তমান সরকার যেই কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে, সেই সংকট কিছুটা হলেও আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের মতো পরীক্ষিত রাজনীতিবিদেরা সামাল দিতে পারতেন। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এই যে, যদি এসব ব্যক্তিত্ব আরও দৃঢ়ভাবে বর্তমান সময় তাঁদের ভূমিকা পালন করতে পারতেন, তাহলে হয়তো দেশে আমরা সত্যিকার অর্থে একটি সংসদীয় সরকার পেতাম। হয়তো প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এই দুরাবস্থায় ঠলে দিত না। হয়তো রাজ্জাক ও তোফায়েলের মতো মানুষ দলের ভেতরে আর একটু সক্রিয় হলে আজ যে পরিবারতন্ত্র আমাদের জাতীয় জীবনে চেপে বসেছে, সেই বাস্তবতা আমাদের অনুভব করতে হতো।
আবদুর রাজ্জাক আর নেই। তবে তিনি তাঁর আদর্শ তাঁর বিশ্বাস রেখে গেছেন। অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংবোধ ছিল না। সব সময় মুখে একটা হাসি দেখা যেত। কিন্তু এই মানুষটির ভেতরে ছিল একটি দৃঢ়তা, যে দৃঢ়তা আমরা গোটা জাতির মধ্যে লক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে একটু সরে যাননি। তাঁর বাঙালিত্ব তাঁর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি আমাদের সব সময় সাহস যুগিয়েছে। তাঁর চলে যাওয়া একটি অধ্যায়ের আরেকটু খসে যাওয়া। তাঁর সময়ের যাঁরা রয়েছেন তাঁরা একে একে চলে যাবেন। তাঁদের আদর্শ কি আমরা ধরে রাখতে পারব? তাঁদের তৈরি বাংলাদেশ কি আমাদের হাতে নিরাপদ ও সুস্থ থাকবে?
সৈয়দ বদরুল আহসান: সাংবাদিক।
No comments