সময়ের কথা-নিস্তরঙ্গ পদ্মায় এত্তো ঢেউ by অজয় দাশগুপ্ত
আশি ও নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা ছিল_ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের যা যা সমালোচনা করে তাকেই অমোঘ সত্য বলে মেনে নেওয়া। তারা বলল, রেশন ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। তারা বলল, আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দিতে হবে। তারা বলল, রেলপথ ও নৌপথ নয়, সড়কপথে বেশি জোর দিতে হবে। তারা বলল, ধনীদের ঢালাওভাবে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে এবং তারা এ অর্থ কীভাবে ব্যয় করছে সেটা নিয়ে তদারকি করা চলবে না।
আমরা সব মেনে নিলাম এখন শীতে শান্ত নদ-নদী। মাওয়া-কাওড়াকান্দিতে পদ্মা নদীতে এ সময়ে ঢেউ ওঠে না। কিন্তু দুই তীরের মানুষের মনে আনন্দ নেই। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের। স্বপ্নভঙ্গ বরিশাল-খুলনা অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের। এ ব্যথা, কী যে ব্যথা সরকার তা বুঝতে চাইল না। মহাজোট সরকারে মাদারীপুর জেলার দু'জন মন্ত্রী_ সৈয়দ আবুল হোসেন এবং শাজাহান খান। একজন নদীর দায়িত্বে, আরেকজন সড়ক ও সেতুর (অবশ্য সাবেক)। সেতুটি নির্মিত হলে এক প্রান্ত থাকবে মাদারীপুরে, অপর প্রান্ত মুন্সীগঞ্জে। সেতুটি নিয়ে মুন্সীগঞ্জের মানুষের যতটা না, তার চেয়ে ঢের বেশি আগ্রহ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা প্রভৃতি জেলার কয়েক কোটি বাসিন্দার। গোপালগঞ্জ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী সরকারের আমলে যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা চেয়েছিলেন, সেতুটি এমনভাবে নির্মিত হতে হবে যাতে গোপালগঞ্জ সুবিধা না পায়। অথচ মাওয়া-কাওড়াকান্দিতে সেতু হলে ঢাকা-বরিশালের দূরত্ব কমে যায় ঠিক ১০০ কিলোমিটার। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে বরিশাল শহরই পরিণত হবে রাজধানীর সবচেয়ে কাছের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের অধিবাসী। এ জেলায় রয়েছেন আরেকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান। এ জেলায় রয়েছেন আরেকজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শেখ সেলিম। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করছেন। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুরের বাসিন্দা। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীও বৃহত্তর ফরিদপুরের শরীয়তপুর জেলার অধিবাসী। এরপরও পদ্মা সেতুর খবর নেই! কিশোরগঞ্জ জেলাও ভাগ্যবান। সেখানে রয়েছেন রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার, শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক এবং আরও কতজন! কিন্তু এমন হেভিওয়েট লোকজন থাকলেই কি উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হয়? পদ্মা সেতু তো হলো না।
বিশ্বব্যাংক আপারহ্যান্ডে। তারা দুর্নীতি হতে পারে_ এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে টাকার জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের পথ অনুসরণ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্য ফান্ডাররা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা ছিল_ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের যা যা সমালোচনা করে তাকেই অমোঘ সত্য বলে মেনে নেওয়া। তারা বলল, রেশন ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। তারা বলল, আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দিতে হবে। তারা বলল, রেলপথ ও নৌপথ নয়, সড়কপথে বেশি জোর দিতে হবে। তারা বলল, ধনীদের ঢালাওভাবে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে এবং তারা এ অর্থ কীভাবে ব্যয় করছে সেটা নিয়ে তদারকি করা চলবে না। আমরা সব মেনে নিলাম। তারা রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর। তাদের চাপ ছিল, সরকারের অনেক কাজ এনজিওর হাতে তুলে দিতে হবে। কারণ সরকারের কাজে দুর্নীতি হয়; এনজিও ব্যক্তিত্বরা সৎ। তারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংগঠনের কাজ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এ ধরনের প্রচারের পক্ষে অবস্থান নেয়। একবার এক এনজিও ব্যক্তিত্ব তার অফিসে কয়েক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল স্বনির্ভরতার। বিদেশি সাহায্যে উন্নয়ন নয়, বরং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালেন এ বক্তব্যের সমর্থনে লেখনী চালাতে। একজন প্রশ্ন করলেন, আপনি যে সংগঠন পরিচালনা করেন তা বিদেশি সহায়তা গ্রহণ করে। আপনার প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তারা যে গাড়ি ব্যবহার করে তা বিদেশি অর্থে কেনা। বাংলাদেশের সব এনজিওর চিত্র কম-বেশি অভিন্ন। এ অবস্থায় আপনারা কোন মুখে বলবেন যে, বিদেশি সাহায্য গ্রহণ ঠিক নয়? তা বটে, তা বটে। সভা সেদিনের মতো শেষ হলো।
বিশ্বব্যাংক যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ কাজের তদারক করছে। এ সেতু এবং নদী শাসন প্রকল্পসহ দুই পাশের সড়ক নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এসব কাজের কন্ট্রাক্ট কারা পেয়েছে, কীভাবে পেয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক কখনও প্রকাশ করেছে কি? বিএনপি সরকারের আমলে যমুনা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। আর শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে। কিন্তু কেউ এত বড় প্রকল্পের কাজের হিসাব দেয়নি। এ সেতু নির্মাণ ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজনৈতিক নেতা, বড় ব্যবসায়ী এবং ঝানু আমলাদের পকেটে গেছে_ তাতে সন্দেহ নেই। ছোট-বড় সব প্রকল্পেই এটা ঘটে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাংকের যারা সেতুর কন্ট্রাক্টরদের বিল পাসের কাজে যুক্ত ছিল তাদেরও যথেষ্ট ফায়দা মিলেছে এ প্রকল্প থেকে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে যমুনা সেতুর পাঁচ গুণেরও বেশি। এ প্রকল্প যে সরকারের আমলেই হোক, হিসাবের পাওনা চাইবে অনেকেই। এর পরিমাণ ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে বলে তো মনে হয় না। অদূর ভবিষ্যতে এর ব্যত্যয় ঘটবে_ এমন সম্ভাবনা দেখি না। এমনকি ট্রান্সপারেন্সির বসদের বসিয়ে দিলেও না। একবার এক সাক্ষাৎকারে এ সংস্থার এক শীর্ষ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিদেশি অনুদানে কেন সংগঠন চলে? সদুত্তর মেলেনি। কেউ কেউ মনে করেন, জনসাধারণের কাছ থেকে এ সেতুর জন্য অর্থ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে সরকারি প্রকল্পে ১০ কোটি টাকার মধ্যে ৫-৬ কোটি টাকার কাজ হয় এবং বাকিটা নানা জনের পকেটে যায়, সেটা জেনে কেন মানুষ সরকারের হাতে অর্থ তুলে দেবে? এখন যে অর্থ সরকার ব্যয় করে, সেটাও পরোক্ষভাবে তারা দেয়। তাই অতটা গায়ে লাগে না। কিন্তু নিজের পকেটের অর্থ সরাসরি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ায় আপত্তি আসবে অনেকের কাছ থেকে। সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এটা ঘটবে না।
সেতুর কাজ সময়মতো শুরু করতে না পারার প্রধান দায় অবশ্যই সরকারের। বিশ্বব্যাংক মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বলেই মনে হয়। তারা দুর্নীতি দূর করায় আন্তরিক হলে এবং মাত্রাতিরিক্ত খবরদারির মনোভাব কমালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির চিত্রে পরিবর্তন ঘটবে বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশে কী ধরনের দুর্নীতি ঘটে তার একটি ধারণা দেই। একটি প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রকল্পের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার জমা পড়ে দেড়শ' কোটি টাকারও বেশি এবং তারা 'যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়' কাজটি প্রায় পেয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু নির্মোহ মানুষের চেষ্টায় পুনঃটেন্ডার হয় এবং নতুন যোগ্য প্রতিষ্ঠান চলি্লশ কোটি টাকার কমেই কাজটি সম্পন্ন করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংক উভয়েরই এ বিষয়ে ভালো ধারণা রয়েছে।
আরেকটি ঘটনা বলি। একটি প্রতিষ্ঠান একই দিনে ২০ কোটি টাকার কাজের কন্ট্রাক্ট পেয়ে এই দিনে তা সম্পন্ন করে বিল তুলে নেয়। ঘটনাটি সন্দেহজনক হওয়ায় তার তদন্ত হয় এবং দেখা যায় যে, বিএনপি সরকারের আমলের একজন শীর্ষ ব্যক্তির পরিবারের সদস্য তাতে সরাসরি জড়িত। যে ব্যক্তি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কী অবস্থা হয়েছিল_ ভাবুন তো একবার!
পদ্মা সেতুর কাজ থেমে আছে। কবে পিলার বসা শুরু হবে, তা নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা দেখছি না। যারা ভেবেছিলেন, মহাজোট সরকারে বৃহত্তর ফরিদপুরের এত্তো মন্ত্রী, তারা নিশ্চয়ই দ্রুততম সময়ে সেতুর কাজ শুরু করবেন। কিন্তু তারা কেন তা করতে পারেননি_ তার সন্তোষজনক জবাব নেই। বিশ্বব্যাংকের তরফেও জট খোলার আন্তরিক চেষ্টা রয়েছে বলে মনে হয় না। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মেঘনা সেতু নিয়ে। যথার্থ কাজ তিনি করছেন। এ সেতুটি নির্মাণের পর দুই দশকের বেশি চলে গেছে। কিন্তু সময়মতো সংস্কার কাজ করা হয়নি। এখন এমন অবস্থা যে, সেতুটি নাকি ভেঙেও পড়তে পারে। এমনটি ঘটলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথে ফের ফেরিতে ওঠানামা করা হবে_ ভাবা যায়? কিন্তু পদ্মায় কেন সেতু চাই_ সে গুরুত্ব কি তিনি উপলব্ধি করবেন? মেঘনা সেতু চট্টগ্রামের লাইফলাইন হিসেবে চিহ্নিত হতেই পারে। পদ্মা সেতু হলে ঢাকা থেকে দুই-তিন ঘণ্টায় বরিশাল শহরে যাওয়া যেতে পারে_ এটা শুনে অনেকের কাছে শুনেছি_ তাই নাকি? এত কাছে বরিশাল! কিন্তু সেতু যে দূর অস্ত। এ সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে শুভ প্রভাব পড়বেই। এ সেতু চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মংলা বন্দরকে ঢাকার কাছের বন্দরে পরিণত করতে পারে। বেনাপোল বন্দরে খালাস করা ভারতীয় পণ্য খুব কম সময়ে চলে আসবে ঢাকায়। সেতুতে রেললাইন যুক্ত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রকৃতই বিপ্লব ঘটবে। কিন্তু নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে বরিশাল জেলার বাসিন্দাদের মতোই রেললাইনবিহীন জেলার লোক (সুনামগঞ্জের ছাতকে কয়েক কিলোমিটার প্রায় অচল রেললাইন আছে বটে)! সড়কপথের মতোই রেলের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করলে বরিশাল-যশোর-খুলনা অঞ্চলের লোক তাকে সাধুবাদ জানাবে। এ সেতুর কাজ দ্রুত শুরু করা এবং তাতে রেললাইন সংযোজন কেবল মহাকালের ব্যবধান ঘোচানোর জন্যই নয়, অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আনার জন্যও জরুরি। আরও জরুরি রাজনীতির জন্যও। এ বিশাল অঞ্চলের মানুষ ধরেই নিয়েছিল, মহাজোট সরকার সেতুটির কাজ সময়মতো ধরবেই এবং শেষও করে দেবে ঝড়ের বেগে। কিন্তু কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বিশ্বব্যাংক আপারহ্যান্ডে। তারা দুর্নীতি হতে পারে_ এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে টাকার জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের পথ অনুসরণ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং অন্য ফান্ডাররা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিকদের মধ্যে একটি প্রবণতা ছিল_ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের যা যা সমালোচনা করে তাকেই অমোঘ সত্য বলে মেনে নেওয়া। তারা বলল, রেশন ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। তারা বলল, আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দিতে হবে। তারা বলল, রেলপথ ও নৌপথ নয়, সড়কপথে বেশি জোর দিতে হবে। তারা বলল, ধনীদের ঢালাওভাবে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে এবং তারা এ অর্থ কীভাবে ব্যয় করছে সেটা নিয়ে তদারকি করা চলবে না। আমরা সব মেনে নিলাম। তারা রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর। তাদের চাপ ছিল, সরকারের অনেক কাজ এনজিওর হাতে তুলে দিতে হবে। কারণ সরকারের কাজে দুর্নীতি হয়; এনজিও ব্যক্তিত্বরা সৎ। তারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংগঠনের কাজ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এ ধরনের প্রচারের পক্ষে অবস্থান নেয়। একবার এক এনজিও ব্যক্তিত্ব তার অফিসে কয়েক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল স্বনির্ভরতার। বিদেশি সাহায্যে উন্নয়ন নয়, বরং নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানালেন এ বক্তব্যের সমর্থনে লেখনী চালাতে। একজন প্রশ্ন করলেন, আপনি যে সংগঠন পরিচালনা করেন তা বিদেশি সহায়তা গ্রহণ করে। আপনার প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তারা যে গাড়ি ব্যবহার করে তা বিদেশি অর্থে কেনা। বাংলাদেশের সব এনজিওর চিত্র কম-বেশি অভিন্ন। এ অবস্থায় আপনারা কোন মুখে বলবেন যে, বিদেশি সাহায্য গ্রহণ ঠিক নয়? তা বটে, তা বটে। সভা সেদিনের মতো শেষ হলো।
বিশ্বব্যাংক যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ কাজের তদারক করছে। এ সেতু এবং নদী শাসন প্রকল্পসহ দুই পাশের সড়ক নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এসব কাজের কন্ট্রাক্ট কারা পেয়েছে, কীভাবে পেয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক কখনও প্রকাশ করেছে কি? বিএনপি সরকারের আমলে যমুনা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। আর শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলে। কিন্তু কেউ এত বড় প্রকল্পের কাজের হিসাব দেয়নি। এ সেতু নির্মাণ ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজনৈতিক নেতা, বড় ব্যবসায়ী এবং ঝানু আমলাদের পকেটে গেছে_ তাতে সন্দেহ নেই। ছোট-বড় সব প্রকল্পেই এটা ঘটে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাংকের যারা সেতুর কন্ট্রাক্টরদের বিল পাসের কাজে যুক্ত ছিল তাদেরও যথেষ্ট ফায়দা মিলেছে এ প্রকল্প থেকে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে যমুনা সেতুর পাঁচ গুণেরও বেশি। এ প্রকল্প যে সরকারের আমলেই হোক, হিসাবের পাওনা চাইবে অনেকেই। এর পরিমাণ ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে বলে তো মনে হয় না। অদূর ভবিষ্যতে এর ব্যত্যয় ঘটবে_ এমন সম্ভাবনা দেখি না। এমনকি ট্রান্সপারেন্সির বসদের বসিয়ে দিলেও না। একবার এক সাক্ষাৎকারে এ সংস্থার এক শীর্ষ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিদেশি অনুদানে কেন সংগঠন চলে? সদুত্তর মেলেনি। কেউ কেউ মনে করেন, জনসাধারণের কাছ থেকে এ সেতুর জন্য অর্থ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যেখানে সরকারি প্রকল্পে ১০ কোটি টাকার মধ্যে ৫-৬ কোটি টাকার কাজ হয় এবং বাকিটা নানা জনের পকেটে যায়, সেটা জেনে কেন মানুষ সরকারের হাতে অর্থ তুলে দেবে? এখন যে অর্থ সরকার ব্যয় করে, সেটাও পরোক্ষভাবে তারা দেয়। তাই অতটা গায়ে লাগে না। কিন্তু নিজের পকেটের অর্থ সরাসরি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ায় আপত্তি আসবে অনেকের কাছ থেকে। সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এটা ঘটবে না।
সেতুর কাজ সময়মতো শুরু করতে না পারার প্রধান দায় অবশ্যই সরকারের। বিশ্বব্যাংক মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বলেই মনে হয়। তারা দুর্নীতি দূর করায় আন্তরিক হলে এবং মাত্রাতিরিক্ত খবরদারির মনোভাব কমালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির চিত্রে পরিবর্তন ঘটবে বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশে কী ধরনের দুর্নীতি ঘটে তার একটি ধারণা দেই। একটি প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রকল্পের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার জমা পড়ে দেড়শ' কোটি টাকারও বেশি এবং তারা 'যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়' কাজটি প্রায় পেয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু নির্মোহ মানুষের চেষ্টায় পুনঃটেন্ডার হয় এবং নতুন যোগ্য প্রতিষ্ঠান চলি্লশ কোটি টাকার কমেই কাজটি সম্পন্ন করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংক উভয়েরই এ বিষয়ে ভালো ধারণা রয়েছে।
আরেকটি ঘটনা বলি। একটি প্রতিষ্ঠান একই দিনে ২০ কোটি টাকার কাজের কন্ট্রাক্ট পেয়ে এই দিনে তা সম্পন্ন করে বিল তুলে নেয়। ঘটনাটি সন্দেহজনক হওয়ায় তার তদন্ত হয় এবং দেখা যায় যে, বিএনপি সরকারের আমলের একজন শীর্ষ ব্যক্তির পরিবারের সদস্য তাতে সরাসরি জড়িত। যে ব্যক্তি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কী অবস্থা হয়েছিল_ ভাবুন তো একবার!
পদ্মা সেতুর কাজ থেমে আছে। কবে পিলার বসা শুরু হবে, তা নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা দেখছি না। যারা ভেবেছিলেন, মহাজোট সরকারে বৃহত্তর ফরিদপুরের এত্তো মন্ত্রী, তারা নিশ্চয়ই দ্রুততম সময়ে সেতুর কাজ শুরু করবেন। কিন্তু তারা কেন তা করতে পারেননি_ তার সন্তোষজনক জবাব নেই। বিশ্বব্যাংকের তরফেও জট খোলার আন্তরিক চেষ্টা রয়েছে বলে মনে হয় না। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মেঘনা সেতু নিয়ে। যথার্থ কাজ তিনি করছেন। এ সেতুটি নির্মাণের পর দুই দশকের বেশি চলে গেছে। কিন্তু সময়মতো সংস্কার কাজ করা হয়নি। এখন এমন অবস্থা যে, সেতুটি নাকি ভেঙেও পড়তে পারে। এমনটি ঘটলে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথে ফের ফেরিতে ওঠানামা করা হবে_ ভাবা যায়? কিন্তু পদ্মায় কেন সেতু চাই_ সে গুরুত্ব কি তিনি উপলব্ধি করবেন? মেঘনা সেতু চট্টগ্রামের লাইফলাইন হিসেবে চিহ্নিত হতেই পারে। পদ্মা সেতু হলে ঢাকা থেকে দুই-তিন ঘণ্টায় বরিশাল শহরে যাওয়া যেতে পারে_ এটা শুনে অনেকের কাছে শুনেছি_ তাই নাকি? এত কাছে বরিশাল! কিন্তু সেতু যে দূর অস্ত। এ সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে শুভ প্রভাব পড়বেই। এ সেতু চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে মংলা বন্দরকে ঢাকার কাছের বন্দরে পরিণত করতে পারে। বেনাপোল বন্দরে খালাস করা ভারতীয় পণ্য খুব কম সময়ে চলে আসবে ঢাকায়। সেতুতে রেললাইন যুক্ত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রকৃতই বিপ্লব ঘটবে। কিন্তু নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে বরিশাল জেলার বাসিন্দাদের মতোই রেললাইনবিহীন জেলার লোক (সুনামগঞ্জের ছাতকে কয়েক কিলোমিটার প্রায় অচল রেললাইন আছে বটে)! সড়কপথের মতোই রেলের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করলে বরিশাল-যশোর-খুলনা অঞ্চলের লোক তাকে সাধুবাদ জানাবে। এ সেতুর কাজ দ্রুত শুরু করা এবং তাতে রেললাইন সংযোজন কেবল মহাকালের ব্যবধান ঘোচানোর জন্যই নয়, অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আনার জন্যও জরুরি। আরও জরুরি রাজনীতির জন্যও। এ বিশাল অঞ্চলের মানুষ ধরেই নিয়েছিল, মহাজোট সরকার সেতুটির কাজ সময়মতো ধরবেই এবং শেষও করে দেবে ঝড়ের বেগে। কিন্তু কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments