কুমিল্লা সিটি নির্বাচন-আমরা কেমন মেয়র ও কাউন্সিলর পাব? by বদিউল আলম মজুমদার
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনে মেয়র পদে নয়জন, সাধারণ আসন থেকে কাউন্সিলর পদে ২১৭ জন এবং সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর পদে ৬৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আইনগতভাবে সব প্রার্থীকেই তাঁদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে সাত ধরনের তথ্য—তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, আয়ের উৎস, মামলার বিবরণী, নিজের এবং নির্ভরশীলদের সম্পদের বিবরণী ও দায়দেনার তথ্য
ইত্যাদি—মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়েছে। একই সঙ্গে জমা দিতে হয়েছে আয়করদাতা হলে আয়করের বিবরণী। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারা প্রার্থী হলেন এবং কী তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড। উল্লেখ্য, ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’ এবং কতিপয় নাগরিকের উদ্যোগে বহু লড়াই-সংগ্রাম ও উচ্চ আদালতে আবু সাফা গংদের জালিয়াতি প্রতিহতের পর প্রার্থীদের এসব তথ্য প্রদানের আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে মেয়র পদে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী নয়জন প্রার্থীর পাঁচজনই (৫৫ শতাংশ) স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী। বাকি চারজন এসএসসির নিচে। মূল প্রার্থীদের মধ্যে আফজল খান বিএ, এলএলবি; মনিরুল ইসলাম এসএসসি; এয়ার আহমেদ সেলিম অষ্টম শ্রেণী পাস; নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম বিএসএস; এবং আনিসুর রহমান মিঠু বিএ, এলএলবি।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২১৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এসএসসির নিচে ৯৯ জন (৪৫.৬২ শতাংশ), স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৫০ জন (২৩.০৪ শতাংশ)। বাকিদের মধ্যে এসএসসি ২৮ জন (১২.৯০ শতাংশ), এইচএসসি ৩৯ জন (১৭.৯৭ শতাংশ) এবং একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ নেই। সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী ৬৯ জনের মধ্যে ২৪ জনের (৩৪.৭৮ শতাংশ) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে, এসএসসি নয়জন (১৩.০৪ শতাংশ), এইচএসসি ১৬ জন (২৩.১৮ শতাংশ), স্নাতক ১৫ জন (২১.৭৩ শতাংশ) এবং পাঁচজন (৭.২৪ শতাংশ) স্নাতকোত্তর। অর্থাৎ সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বড় অংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তার নিচে এবং তাঁদের অধিকাংশই অষ্টম-নবম শ্রেণী পাস।
নয়জন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে সাতজনই (৭৭.৭৭ শতাংশ) পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। বাকি দুজনের পেশা উল্লেখ নেই। তবে মেয়র পদপ্রার্থীদের পেশা নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। গত ৪ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখের প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রায় সবারই সরকার ও সিটি করপোরেশেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ৯(২)(ছ) ও (জ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হবেন। প্রসঙ্গত, সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ১২ ধারা অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত ব্যক্তিরা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য, যদিও অনেকেই সে দোষে দুষ্ট।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমরা সুজনের পক্ষ থেকে একই তারিখ লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের অযোগ্যতার বিষয়টির প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। রিটার্নিং অফিসার আমাদের ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ লিখিতভাবে জানান যে তিনি মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন; নির্বাহী প্রকৌশলী, এলজিইডি, কুমিল্লা; নির্বাহী প্রকৌশলী, পিডিবি-১ ও পিডিবি-২, কুমিল্লা; নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লা; নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ, কুমিল্লা; নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত, কুমিল্লা; নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লা প্রার্থীদের ঠিকাদারিত্বসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে মনোনয়নপত্র বাছাইকালে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেউই প্রার্থীদের ঠিকাদারিত্বসংক্রান্ত কোনো তথ্য উত্থাপন করেননি বা তাঁদের প্রার্থীদের সম্পর্কে কোনো আপত্তি প্রদান করেননি। ফলে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের অভিযোগে রিটার্নিং অফিসার কোনো মেয়র পদপ্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেননি।
প্রসঙ্গত, মেয়র পদপ্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম তাঁর হলফনামায় পেশা হিসেবে সওজ ও পাউবোর ঠিকাদার বলে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে রিটার্নিং অফিসার তাঁর লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন তানিম এলজিইডির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার হিসেবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দুটি কাজের জন্য নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু কাজ দুটি ২০ অক্টোবর ২০১১ তিনি হস্তান্তর করেন এবং এলজিইডির কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী লিখিতভাবে তাঁর লাইসেন্সের কার্যকারিতা বাতিল করেন। এসব তথ্য থেকে রিটার্নিং অফিসার সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে তানিমও সরকার বা নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নন। আমরা আশা করি, প্রার্থী বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মধ্যে কেউই এ ব্যাপারে তথ্য গোপন করেননি, তা না হলে আইনগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অযোগ্য একজন ব্যক্তি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন।
পেশাগতভাবে সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ১৭০ জনই (৫৭.৬২ শতাংশ) ব্যবসায়ী। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য নির্বাচনের ন্যায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেও ব্যবসায়ীদের ছড়াছড়ি। পক্ষান্তরে সংরক্ষিত নারী আসনের ৬৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪৬ জনই (৬৬.৬৬ শতাংশ) গৃহিণী, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে তাঁদের কোনো আয়ের উৎস নেই এবং কোনো বিত্তশালী সম্ভবত তাঁদের পেছনে রয়েছেন।
মেয়র পদপ্রার্থীর চারজনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে। বর্তমানে আফজল খানের বিরুদ্ধে তিনটি, তানিমের বিরুদ্ধে একটি, চঞ্চল কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে একটি ও মনিরুল হকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। অতীতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। অতীতে আফজল খানের বিরুদ্ধে তিনটি, যার মধ্যে ৩০২ ধারায় একটি; তানিমের বিরুদ্ধে ১৮টি, যার মধ্যে ৩০২ ধারায় একটি; এয়ার আহমেদ সেলিমের বিরুদ্ধে একটি; আনিসুর রহমান মিঠুর বিরুদ্ধে সাতটি এবং মনিরুল হকের বিরুদ্ধে আটটি, যার মধ্যে ৩০২ ধারায় একটি মামলা ছিল।
সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ২১৭ জনের মধ্যে ২৮ জনের (১২.৯০ শতাংশ) বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা রয়েছে এবং ৪৯ জনের (২২.৫৮ শতাংশ) বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সরকার মাহমুদ জাবেদ, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কাজী বেলাল আহম্মদ খান, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী নাজমুল বারী চৌধুরী এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কবির হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা ছিল। অতীতে মামলা ছিল বা বর্তমানে মামলা আছে, এমন সাধারণ আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা ৬৭ জন (৩০.৮৭ শতাংশ)।
প্রার্থীদের ঘোষণা অনুযায়ী কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৯৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর অধিকাংশেরই (২৩৯ জন বা ৮১.০১ শতাংশ) সম্পদই পাঁচ লাখ টাকার নিচে। মাত্র তিনজন (২.০৩ শতাংশ) প্রার্থীর এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ কোটি টাকার ওপর। বিশ্বাস করা দুরূহ যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, বিশেষত মেয়র পদপ্রার্থী ও তাঁদের নির্ভরশীলদের সম্পদের পরিমাণ এত কম।
মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে তিনজনের ঋণ/দায়দেনা রয়েছে। তানিমের ১৭ লাখ, মনিরুল হকের প্রায় ৬২ লাখ এবং মামুনুর রশীদের এক কোটি ২১ লাখ টাকা দায়দেনা রয়েছে। সাধারণ আসনের ২১৭ জন প্রার্থীর মধ্যে মোট ঋণ গ্রহীতা ৩৮ জন (১৭.৫১ শতাংশ), যার মধ্যে তিনজনের ঋণ কোটি টাকার ওপর। সংরক্ষিত আসনের ৬৯ জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন (৭.২৪ শতাংশ) ঋণ গ্রহীতা এবং এঁদের কোটি টাকার ওপরে কারও ঋণ নেই।
আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী আফজল খানের করযোগ্য আয় ১১ লাখ ৪৩ হাজার, প্রদত্ত কর এক লাখ ৪৩ হাজার এবং বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় চার লাখ টাকা। এয়ার আহমেদ সেলিমের করযোগ্য আয় ৩৫ লাখ ৯৩ হাজার, প্রদত্ত কর সাত লাখ ৫৩ হাজার এবং বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। তানিমের করযোগ্য আয় ২৮ লাখ ৯১ হাজার, প্রদত্ত কর পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭২ এবং বার্ষিক ব্যয় পারিবারিক আট লাখ টাকা। মিঠুর করযোগ্য আয় তিন লাখ ২৮ হাজার, প্রদত্ত কর ১৫ হাজার এবং বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় এক লাখ টাকা, যা অতি অল্প বলে মনে হয়।
বিখ্যাত ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম এডিআর [(২০০২) ৫ এসসিসি] মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে ভোটারদের বাকস্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কারণ ভোটাররা তাঁদের বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোটের মাধ্যমে। নাগরিকদের এ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ‘সুজন’ বহু দিন থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রার্থীদের হলফনামা ও আয়কর বিবরণী ওয়েবসাইটে (www.votebd.org) প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকগুলো ‘প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যের ‘তুলনামূলক চিত্র’ বিতরণ করা হয়েছে। আশা করি, এসব তথ্যের ভিত্তিতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তির পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, (সুজন) সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
No comments