শ্রদ্ধাঞ্জলি-রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে কিছু কথা by আবদুল মান্নান চৌধুরী
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করলে ছাত্র সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আবদুর রাজ্জাক তার অকুণ্ঠ সমর্থনে এগিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কেউ কেউ পিটটান দেন। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাকর্মী নির্যাতনেরপর জেলে যান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এরশিকার হলেন ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির
দু'-দু'বারের সাধারণ সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান, মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, জাতীয় সংসদের বহুবার নির্বাচিত সদস্য, আওয়ামী লীগ ও বাকশালের সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, মন্ত্রী, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আবদুর রাজ্জাক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি যখন তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি তখন মানসপটে ফুটে উঠেছে তাকে নিয়ে অনেক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই তিনি কিংবদন্তি ছাত্রনেতা। ১৯৬২ সালে তিনি ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সহ-সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। যতদূর মনে পড়ছে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের একাংশ পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করলে ছাত্র সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আবদুর রাজ্জাক তার অকুণ্ঠ সমর্থনে এগিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কেউ কেউ পিটটান দেন। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাকর্মী নির্যাতনের পর জেলে যান। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এর শিকার হলেন। আমরা রাজ্জাক ভাইয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আর্থিক সহায়তায় কখনও শিল্প ও সাহিত্য সংঘের বাতাবরণে, আবার কখনও ছাত্রলীগের ব্যানারে ৬ দফার কার্যক্রম চালিয়ে যেতাম। আবদুর রাজ্জাকের মতো এমন ৬ দফা অন্তঃপ্রাণ নেতা ছিলেন বলেই সেদিন ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্তি থেকে বেঁচে যায় আর ৬ দফার আন্দোলনও তীব্রতর হয়।
৬ দফার আন্দোলন তথা আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনে ৭ জুন ১৯৬৬ একটি মাইলফলক। সেদিন বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও আমরা তারই নির্দেশে হরতালে নেমেছিলাম। ৭ জুনকে সফল করতে বেশ ক'টি সভা ফজলুল হক হলে আমার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। সেসব সভায় শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, এনতাজ আলী, ফেরদৌস কোরেশী, লুৎফুল হাই সাচ্চু, শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ অনেকেই উপস্থিত থাকতেন। রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রতি রাতে হাতে লেখা পোস্টার টাঙাতে টাঙাতে আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার উপক্রম হতো। মাঝেমধ্যে সিগারেট টেনে ঘুমের ভাবটি কাটাতে আমরা কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যেতাম। বিষয়টি উপলব্ধি করে রাজ্জাক ভাই তার সামনেই আমাদের সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলেন।
৭ জুন যতই ঘনিয়ে আসছিল, আমাদের উদ্দীপনা রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে বেড়েই চলল। ৬ তারিখ রাতে আমাদের ফাইনাল রিহার্সেল হলো। আমাদের কাপড়ের জুতা ও টাইট প্যান্ট পরার পরামর্শ দেওয়া হলো। ৭ তারিখ খুব ভোরে রাজ্জাক ভাই আমাদের সবার হাতে বাঁশের লাঠি বা গাছের গুঁড়ি ধরিয়ে দিলেন। নির্দেশ দিলেন যেন আমরা সকাল ৮টা পর্যন্ত কোনো রকমে পিকেটিং করে যাই। তার মতে, এর পরে হরতালের সফলতার দায়িত্ব টোকাইদের। সেই ভোরে রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা পিকেটিং ছাড়াও গাড়ি ভাঙার কাজে নেমে পড়লাম। তদুপরি কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আমরা কয়েকজন মিলে একটি বাস বর্তমান দোয়েল চত্বরে কাত করে ফেলে দিলাম। ট্যাংকের ঢাকনা খুলে পেট্রোল বের করে আমার পকেটের দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে বাসে আগুন ধরিয়ে দিলাম। এ সময় প্রাইভেট বাসের চলাচল বন্ধ হলেও পুলিশের গাড়ির তৎপরতা বেড়ে গেল, সঙ্গে আমাদের দৃঢ়তাও বাড়তে লাগল। অবশ্য পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্য ও নির্যাতন-নিপীড়নে আমরা এতটা অতিষ্ঠ ছিলাম যে, সেদিনের হরতাল সফল করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রসঙ্গটিও মুখ্য ছিল। হঠাৎ দেখলাম, পুলিশ অফিসার বহনকারী একটি গাড়ি উদ্ধত ভঙ্গিতে দ্রুত ছুটে আসছে। পুরনো হাইকোর্টের সামনাসামনি কার্জন হলের গেটে আমরা দু'জন অবস্থান নিলাম আর দিগ্গি্বদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই গাড়িতে পেটাতে শুরু করলাম। হঠাৎ রাজ্জাক ভাই সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমাকে কার্জন হলের রাস্তায় ফেলে দিলেন। রাস্তায় পড়ে গিয়ে আমার কনুই ছিলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। উত্তেজিত আমি রাজ্জাক ভাইকে এমন আচরণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম। তিনি নিজেও রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েছিলেন। বিড় বিড় করে তিনি বলছিলেন, 'না, এ দেশকে স্ব্বাধীন না করে আমরা মরব না।' এরপর বললেন, 'ডিএসপি আলম তোর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। আমি তোকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে না দিলে তোর মাথার খুলি উড়ে যেত।' এ কথা শোনামাত্র আমার বোধ প্রায় লোপ পাচ্ছিল। আজও মনে করি, সেদিন রাজ্জাক ভাইয়ের কৃপায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেদিন থেকেই পাকিস্তানের কবর রচনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বিএলএফের (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট) কার্যক্রমকে বেগবান করতে এগিয়ে গেলাম।
১৯৬৬ সাল থেকে দু'-দু'বার রাজ্জাক ভাই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আমিও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু তাকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সত্তরের নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এমনকি সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই বাহিনী ব্যবহারের বিকল্প পরিকল্পনাও ছিল।
ক্রমশ আমার ছাত্রত্ব শেষ হতে চলল। এমকম পরীক্ষার সময় আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম বিধায় ভালো রেজাল্টের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সে সময় সৈয়দ রেজাউর রহমানসহ কয়েকজন মিলে আমাকে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এ বিষয়টি রাজ্জাক ভাইয়ের জানা ছিল না। ডাকসু নির্বাচনের আগে আমার ফল প্রকাশিত হলে ছাত্র রাজনীতি দূূরের কথা, পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা থেকেও বিরত রইলাম। এতে রাজ্জাক ভাইয়েরও একটা ভূমিকা ছিল। শেষমেশ শিক্ষকতাই আমার নিয়তি হয়ে গেল। ভালো রেজাল্ট করেও শত বাধা-বিপত্তির মাঝে মুক্তিযুদ্ধের আগেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। রাজ্জাক ভাইসহ আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা খুব খুশি হলেন। অবশ্য এর পর থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের চেয়ে মনি ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলো। কিন্তু ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তার সঙ্গে আবারও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সৃষ্টি হলো।
২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর আমরা যে যেদিকে পারি প্রতিরোধে জড়িয়ে গেলাম। বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী মনি ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই ও সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত করা হলো। আমি পূর্বাঞ্চল মুজিব বাহিনীতে মনি ভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হলাম। তখনই জানতে পারলাম, উত্তর-পূর্বাঞ্চল মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব পেয়েছেন রাজ্জাক ভাই। মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের কথাটা তিনি জানতেন না।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আকস্মিক গৌহাটির কাছাকাছি এক জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে গেল। তিনি একটি খোলা জিপে আর আমি একটি খোলা ট্রাকে পরস্পর মুখোমুখি হলাম। আমাকে দেখে তিনি অনেকটা চিৎকারের ভঙ্গিতে বললেন, 'মান্নান, তুমি এসেছ?' আমি বললাম, 'কেন নয়?' তার জবাব, 'তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুনেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বৃত্তি নিয়ে তুমি চলে গেছ। এমন আরামের জীবন ছেড়ে তুমি এমন দুর্যোগের যাত্রী হবে বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না।' আমি বললাম, 'রাজ্জাক ভাই কি ৭ জুনের শপথের কথা ভুলে গেলেন? বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে যে আমরা মরব না।'
এরপর একসঙ্গে বেশ কিছুদিন দেরাদুনে প্রশিক্ষণে কাটিয়ে আমরা যার যার গন্তব্যে ফিরে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। আমরা স্বাধীন হয়েছি, শত্রুমুক্ত হয়েছি। ১৯৭১ সালেই আমি আমার কাজে ফিরে গিয়েছি। রাজ্জাক ভাই রাজনীতিতে থেকে গেছেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৭৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরই গ্রেফতার হয়ে তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত জেলে ছিলেন। এটাই তার জীবনের প্রথম জেলে যাওয়া নয়। ১৯৬৪-১৯৬৫ সালেও তিনি জেলে ছিলেন এবং জেলে বসেই এমএ পাস করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ৬ দফার আন্দোলনে জড়িয়েও তিনি জেলে ছিলেন।
১৯৯৬ সালে তিনি আবার সংসদে নির্বাচিত হলেন এবং পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব ২০০১ পর্যন্ত পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি দুর্যোগের যাত্রী ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি আবারও সাংসদ নির্বাচিত হলেন এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
ছাত্রজীবনে তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। এমনকি তিনি কুস্তিতে মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান খেতাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনিয়ম ও উদাসীনতা তাকে ধীরে ধীরে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। মাত্র ঊনসত্তর বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে গেলেন। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, রাজ্জাক ভাইয়ের ত্বরিত সিদ্ধান্তে আমি আজও বেঁচে আছি, অথচ তিনি আমাদের মাঝে নেই।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments