চরাচর-কুয়াশায় মোড়ানো সকাল by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
শীতের পারদে কাঁপছে এখন সারা দেশ। কুয়াশার শুভ্র চাদর গায়ে এসেছে শীত। উড়িয়ে দেওয়ার মাতন এসে গাছের পাতাগুলোকে শীত যেন কাঙাল করে তুলছে। পাতাগুলো গাছের শরীর থেকে ঝরে পড়ছে ধীরে ধীরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি পর্যায়ের এক শ ছিয়াত্তর নম্বর গানে বলেছেন_'শীতের পরশ থেকে থেকে, যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে।' ষড়ঋতুর হিসাবে পৌষ ও মাঘ_এ দুই মাস শীতকাল। শীত মানেই শিশিরভেজা প্রহর।
এ সময় সোনালি ফসলে ভরা থাকে মাঠ-ঘাট। শীতের হাওয়া বনবনানীর হৃদয়জুড়ে তীব্র কাঁপন জাগায়। ঘাসে-ঘাসে, গাছের পাতায়, ঘরের টিনের চালে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দ শিহরণ তোলে। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সূর্যহীন শীতের প্রতিটি সকাল। চারদিকজুড়ে কুয়াশা আর কুয়াশা। চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না সেই জমাটবদ্ধ কুয়াশার আবরণ ঠেলে অপর প্রান্তের দৃশ্যপটগুলো। সকাল গড়িয়ে দুপুরের শেষভাগে হয়তো দেখা দেয় সূর্যের কিরণ। চারপাশ হঠাৎ খিলখিল করে ওঠে। তীব্র শীতের কনকনে আমেজ জীবনযাত্রাকে নিমেষেই স্থবির করে তোলে। প্রতিদিন শীত বর্ণনাতীত কষ্ট আর বিড়ম্বনা নিয়ে উপস্থিত হয় গবির-হতদরিদ্র মানুষের ঘরে। প্রচণ্ড হাড়কাঁপানো শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে লাখ লাখ মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সূর্যের দেখা না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাজার হাজার ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষ শীতে একেবারে জবুথবু ও নাজেহাল হয়ে পড়ে। ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্রের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র প্রতীক্ষা আর হাহাকার। হতদরিদ্র দিনমজুর, খেটে খাওয়া ও কৃষিজীবী মানুষ চরম দুর্দশার কবলে পড়ছে। শীতের ফলে উপজেলায় কোল্ড ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দিসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষ মোটা শীতবস্ত্র ব্যবহার করতে না পেরে কোনো রকম খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে। কিন্তু তীব্র শীতে অনেকেই রাতের বেলায় গায়ে একটা মোটা কাপড় দিতে না পেরে কাহিল হয়ে পড়ছে। ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষগুলো গরম কাপড়ের জন্য বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। অপরদিকে এই শীতের আমেজকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে এ দেশের মানুষ। পিঠা উৎসব, যাত্রা, সার্কাস, মেলা, ভ্যারাইটি শো, শীতের কাপড় প্রদর্শনী_নানা আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হয় শীতকে। শীত ঋতুর অপূর্ব শোভিত পোশাকগুলো দেখা যায় ফ্যাশন হাউসগুলোতে। শীতের আরেক উপহার খেজুরের গুড়। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় পাটালি, ঝোলা প্রভৃতি খেজুরের গুড়। এই গুড় দিয়ে তৈরি হয় ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, সেম পিঠাসহ নানা ধরনের মুখোরোচক পিঠা। এবার শীত কিছুটা দেরিতে এল বলেই বোধ হয় প্রকৃতি বিশেষজ্ঞদের অনুমানটা আরো সঠিক হতে চলল_বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি প্রকৃতির গভীর সানি্নধ্য থেকে। উপলব্ধির চেতনায়ও এখন আর ধরা পড়ে না প্রকৃতির সুনিবিড় দৃশ্যপটগুলোর তাৎপর্য। ছয়ঋতু বাংলার প্রকৃতির বুকে যে গভীর সৌন্দর্য শোভা ছড়িয়ে রেখেছে_তাও যেন হৃদয় দিয়ে দেখার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলছি। পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো যে মারাত্মক প্রভাব আঘাত করেছে আমাদের বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্যকে_এর ভয়াল হিংস্রতার বিরূপ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ জানা নেই আমাদের। দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করার দায়ভার তো মানবসভ্যতাকে গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, কান্নার মধ্য দিয়ে, খণ্ড খণ্ড লাশের সমারোহের মধ্য দিয়ে সেই দায়ভার সুদে-আসলে গ্রাস করে নেবেই নির্দয় প্রকৃতি।
No comments